“হিন্দুত্ব এবং একজন হিন্দু”
ডাঃ মৃনাল কান্তি দেবনাথ
হিন্দুত্ব একটি “জীবন আদর্শ, জীবন শৈলী, জীবন ধারন পদ্ধতি, মানুষের জীবনের সংবিধান”। যিনি বা যারা সেই আদর্শ, পদ্ধতি, শৈলী বা সংবিধান মেনে চলেন , নিজের দৈনন্দিন জীবনে প্রতিফলিত করে জীবন যাত্রা নির্বাহ করেন তিনিই হিন্দু।
কোনো একটি আদর্শ, জীবন ধারনের একটি নির্দিষ্ট প্রনালী ( নিত্য কর্ম পদ্ধতি) , মানুষ হিসাবে অন্য মানুষের, অন্য প্রানী এবং সৃষ্টি কর্তার প্রতিটি সৃষ্টির প্রতি কি ব্যাবহার হবে সেই ভাবনা চিন্তা এং মনন এর দ্বারা একজন ভালো মানুষ হবার সাধনা খুব সহজ নয়।।
ধর্ম কি? ধর্ম মানুষের জীবনে কেনো প্রয়োজন। ধর্ম ছাড়া কি মানুষ চলতে পারে না????
“যা মানুষ কে ধরে রাখে তাকেই বলে ধর্ম”। একটি নদীর দুই পাড় উঁচু বাধ দিয়ে ধরে না রাখলে প্লাবন হয়। মানুষের জীবনেও সেই একই রকম প্লাবন হয়। জীবন নদীর স্রোত নানা ভাবে বয়ে চলে। কখনো সোজা স্রোত কখনো উলটো স্রোত। নদীর মুল স্রোত চলে মধ্যখান দিয়ে, উলটো স্রোত চলে দুই পাশ দিয়ে। সেই উলটো স্রোতে সব ময়লা এসে জমা হয়, মধ্যখানের স্রোতের জল থাকে পরিষ্কার। জীবন ধারনের পথ যদি উলটো হয় তবে সেই উলটো স্রোত জীবনে ময়লা জন্মায়। জীবন হয় পুতিগন্ধময়, অশান্তির আগার, রোগ ভোগের নরক।
অনেকে বলবেন, প্রগতির সংগে সংগে জীবন ধারনের আংগিক না পাল্টালে পিছিয়ে পড়তে হয়। খুবই সত্যি কথা। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে মধ্য যুগীয় জীবন ধারন সম্ভব নাকি??? ভুলটা এই খানেই হয়। বৈজ্ঞানিক উন্নতি এবং আবিষ্কারের সংগে সংগে জীবন ধারনের নিত্য পদ্ধতি পালটায়, পাল্টিয়েছে। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু ধর্ম সেখানে নয়। বৈজ্ঞানিক ধ্যান ধারনার সংগে ধর্মের কোনো সম্বন্ধ নেই, কোনো দন্দ্ব নেই। ,কোনোদিন ছিলো না।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সংগে তাল মিলিয়ে ‘জলপড়া, জড়ি বুটি,তুক তাক, দেবীর থানে রোগ আরোগ্য কামনা এক প্রকার বাতুলতা।। ছেলে মেয়ের চাকরীর জন্য বা রোগ আরোগ্য কামনা করে নানা দ্রব্য ভর্তি থালি দেব দেবীর থানে পুজোর নাম করে দিয়ে আসা ধর্মের অবমাননা।। ‘Hysteria’ রোগী মুখ দিয়ে যা বলে তাই দৈব বানী মনে করার মধ্যে মুর্খতা আছে ধর্ম নেই।।
পৃথিবী সুর্য্যের চারিদিকে ঘোরে না সুর্য্য পৃথিবীর চরিদিকে ঘোরে এই বিশ্বাস এবং মারামারি, অক্ষত যোনী একজন মহিলার সন্তান প্রসব হতে পারে এই বিশ্বাস পাগলের প্রলাপ উক্তি।
কতো ইঞ্চি দাড়ি রাখতে হবে, গোফ কামানো উচিত কি অনুচিত, গোফ কামিয়ে দাড়ি রাখবো কতো ইঞ্চি, কোন দিকে ফিরে সৃষ্টি কর্তাকে ডাকবো, যৌনাঙ্গের কিছু অংশ না কাটলে ধার্মিক হওয়া যাবে না এগুলো উন্মাদের উদ্বাহু নৃত্য ছাড়া আর কিছু নয়।
একজন মানুষ, ‘টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সির’ এট্যাকের ঘোরে যা বললো সেটাই ধর্ম, এই অত্যুগ্র বিশ্বাস ধর্মান্ধতার সৃষ্টি করে। নিজের অপরিমিত ক্ষমতার লালষা, নিজের একছত্র আধিপত্য অন্য সকলের ওপরে চাপিয়ে দিয়ে নিজের নাম যশ ভক্তি আদায় করার “নার্সিসিষ্টিক মানসিক রোগের’ চিন্তা ভাবনা প্রসুত ঔপনিবেশিক পদ্ধতিকে ধর্মের খোলষ পরিয়ে অশিক্ষিত, অবৈজ্ঞানিক, খুন রাহাজানি করতে ওস্তাদ মানুষদের নিজ দলে সামিল করে তাদের খেপিয়ে দিয়ে , “মানুষের রক্তে হোলি খেলার” পৈশাচিক পরিতৃপ্তি লাভ করা ধর্ম তো নয়ই ,এটা এক ধরনের শয়তানি।
এই সবের মধ্যে আর সব আছে “ধর্ম” নেই, কারন এই সব মানুষকে ধরে রাখতে পারে না।
হিন্দু ধর্মকে আসলে বিকৃত করে পারসীকরা নাম টি দিয়েছে এবং সেটাই প্রচলিত হয়ে গেছে। প্রাচীন ভারতবর্ষে, , আজ থেকে প্রায় দশ হাজার বছর আগে থেকে, সিন্ধু, সরস্বতী, গঙ্গা, যমুনা , নর্মদা, কাবেরীর তীরে নির্জনে অনেক জ্ঞান তপস্বী জ্ঞানের সাধনা করেছেন। মানুষ জ্ঞান লাভ করে, দেখে, শুনে এবং ঠেকে। এ ছাড়াও জ্ঞান লাভের আর একটী পদ্ধতি আছে, যার নাম “নৈসর্গিক জ্ঞান” (Intuitive Knowledge). যারা বিজ্ঞান কেই প্রাধান্য দেন তারা জানেন, কতো কিছু আজকাল “ Cloud” এ থাকে এবং সেখান থেকে নিজের ল্যাপটপে ডাউনলোড করে নিলেই হলো। সেটা যদি হতে পারে, তাহলে, “সৃষ্টি কর্তা এই বিশ্ব সৃষ্টি করে তার অনু পরমানুতে চৈতন্য রুপে নিজেকে ছড়িয়ে রেখেছেন” এই বিশ্বাস বা জ্ঞান মিথ্যা কোথায়????
সেই জ্ঞান যা মহাবিশ্বে বর্তমান, সেটা বৈজ্ঞানিকেরা তাদের পরীক্ষাগারে পাটিগনিতের ব্যাবহার করে জানতে চান। ভারতের প্রাচীন জ্ঞান তপস্বীরাও নির্জনে সেই জ্ঞান লাভের চেষ্টাই করে গেছেন। তাদের জ্ঞান না্না ‘আপ্তবাক্য’ বা লিখিত ভাবে আমাদের সামনে বর্তমান। মুনি বিশ্বামিত্র তাই বলেন “ এই মহাবিশ্বের কোথাও এক জ্ঞানী বরেন্য ভর্গ পুরুষ আছেন যিনি দেবতাদের জ্ঞান দান করেন, আমি তার কাছেই সেই ‘ধীশক্তি’ প্রার্থনা করি”।
জ্ঞানী সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে জ্ঞান লাভ করতে যা করতে হয় সেটা হলো “সাধনা”। গরুর মাংস খাবার উৎসব করে, সাধারন মানুষকে ঠকাবার চিন্তা মাথায় নিয়ে, জিনস পরে বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়ে শুড়িখানায় সিগারেটের ধোয়া উড়িয়ে সেই জ্ঞান লাভ করা যায় না।
প্রথমেই চাই, আধুনিতার মোহ এবং নিজের অর্ধ পরিপক্ষ বুদ্ধির অহংকার ত্যাগ। নিজের মানসিকতার পরিবর্তন। জ্ঞান অপাত্রে সৃষ্টি কর্তা দান করেন না। তাহলে তারা দানব হয়ে যায় স্বর্গ দখল করতে চায়। দানবেরা তার তাই মুর্খ থাকে , বিনাশ লাভ করে।
নিজের মানসিকতার পরিবর্তন এবং ধর্মীয় সাধনার কিছু প্রাথমিক এবং অবশ্য করনীয় পদ্ধতি অনেক আগেই সনাতনী বা বৈদিক ঋষিরা দিয়ে গেছেন। সেগুলো হলো—— “ শম= সমতা, সবাই সমান এই মান্যতা দেওয়া, যম= রিপুর সংযম ( কাম,ক্রোধ, লোভ, মোহ, মৎ,মাৎসর্য্য ), নিয়ম= নিত্য কর্ম, নিত্য সাধনা, সত্য= সব সময়, সব ক্ষেত্রে সত্যকে আশ্রয় করে থাকা, অহিংসা= বিনা কারনে কাউকে বা কোনো কিছুতে মনে হিংসা পোষন না করা, অচৌর্য= অন্যের জিনিষ না বলে বা ধোকা দিয়ে না নেওয়া, অপরিগ্রহ= কোনো কিছুর জন্য কারো কাছ থেকে উপঢৌকন না নেওয়া, নিদিধ্যাসন= রোজ নির্জনে কিছুক্ষন বসে সৃষ্টি এবং সৃষ্টি কর্তার বিশাল রুপ ধ্যান করা, স্বাধ্যায়= প্রতিদিন নিয়ম করে জ্ঞানী ব্যাক্তিদের লিখে রাখা জ্ঞান রাজি অধ্যয়ন করা। ধারনা= নিজের জীবনকে সৃষ্টির মুল স্রোতে রেখে, আপ্তবাক্য স্মরনে রেখে, অধ্যয়নের দ্বারা যে জ্ঞান একটু একটু করে নিজের মন এবং বুদ্ধিতে আসে সেটা ধরে রেখে নিয়ত সেই মতো নিজেকে চালিত করা।। —- হরি ঔং তৎ সৎ।
যারা এটা করে তারাই সনাতনী বা বৈদিক বা হিন্দু। এটাই ‘হিন্দুত্ববাদ’। বাকি সব বুজরুকি।।
হিন্দুত্ব না জেনে না মেনে, নিত্য সাধনা করে নিজের জীবনে প্রতিফলিত না করতে পারলে, শুধু হিন্দু হিন্দু করে চীৎকার চেচামিচি করলে ‘হিন্দু’ হওয়া যায় না।