১৯৮২ সালে খোমিনি এই তুহেদ পার্টিকে ইরানে নিষিদ্ধ করে কমিউনিস্টদের সঠিক মূল্য চুকিয়েছিলো।

ইরানের ইসলামিক বিপ্লব নিয়ে উচ্ছ্বাসিত ছিলেন মিশেল ফুকো। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ছাত্র অবস্থাতেই মিশেল ফুকো ফ্রান্সের সমাজতান্দ্রিক দলে যোগ দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সময় দর্শন বিভাগে তিনি বামপন্থি শিক্ষকদের নিয়োগ দিতে থাকেb। শাসকগোষ্ঠি এই কমিউনিস্টদের বিপ্লবী কর্মকান্ডে ও ছাত্রদের মদদদাতা হিসেবে চিহিৃত করে শেষে দর্শন বিভাগটাই উঠিয়ে দিয়েছিলেf। সেই মিশেল ফুকো স্টালিনের কিছু কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে সমাজতান্দ্রিক সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। তিনি যখন ইরানের রুহুল্লাহ খোমিনিকে সমর্থন করেন তখন বিশ্বে শোরগোল পড়ে যায়। অনেক বামপন্থি তাদের বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।

ইরানের রেজা শাহ পাহলভি তখন ক্ষমতায়। রেজা শাহ মার্কিন সমর্থিত, পশ্চিমা সেক্যুলার প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ ইরান গড়ে ছিলেন। তাকে বলা হতো ‘ইরানের কালাম পাশা’। রেজা শাহ’র শাসনে ইরান জুড়ে মানুষের ক্ষোভ বাড়ছিলো। তার একনায়কত্ব, রাষ্ট্রীয় নানা অনিয়মে মানুষ অসন্তুষ্ঠ ছিলো। কিন্তু তিনি ইরানকে করে তুলেছিলেন আধুনিক। তার শাসনে ইরানে দুজন নারী মন্ত্রী হয়েছিলো। তাদের একজন মাহনাজ আফকামি। এই মহিলা ইরানের নারী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে যুগান্তকারি কিছু সিদ্ধা্ন্ত নিয়েছিলেন। যেমন বিবাহবিচ্ছেদে নারীদের পুরুষদের মত সমান অধিকার- ইসলামী আইনে যা মানা হয় না। মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করে দেন ১৮। কর্মজীবী নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ধার্য করে দেন। ইরানের নারীদের তখন সরকারি সফরে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারতসহ পাশ্চত্য দেশগুলিতে সফর করানো হতো। নানা দেশের নারী নেত্রীরা ইরান সফর করতেন। এতে ইরানী নারীরা প্রগতিশীল আধুনিক চিন্তা ও ভাবনার কাছাকাছি আসার সুযোগ পেতো। এরকম সময় রেজা শাহ’র সরকারের পতন ঘটে এবং খোমিনির ইসলামিক বিপ্লব ইরান জয় করে নেয়। মাহনাজ আফকামি তখন আমেরিকাতে সরকারি সফরে ছিলেন। খোমিনির হাত থেকে তিনি বেঁচে গেলেন। কিন্তু রেজা শাহ’র মন্ত্রী সভার আরেক নারী মন্ত্রী ফারুক পারসা, যাকে নিজের গুরু মানতেন মাহনাজ আফকামি তাকে ফাঁসি দেয়া হলো। তাকে বলা হলো সে বেশ্যা, কারণ সে ও মাহনাজ আফকামি আল্লার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে নারীদের ঘর থেকে বের করে এনে। ফারুক পারসার ফাঁসি কার্যকর করা হলো ইরানের একটি পতিতালয়ে! খোমিনি সমগ্র ইরানে ঘোষণা করে দিলেন, কুফরি পারিবারিক আইন বাতিল করে কুরআনের নিয়ম অনুয়ায়ী নারীদের বিবাহ, তালাক, সম্পত্তির অধিকার ও অন্যান্য বিষয় মান্য করা হবে। নারী পুরুষকে পৃথক করে দেয়া হলো। হিজাব বা বোরখা ছাড়া নারীদের ঘর থেকে বের হওয়া নিষিদ্ধ করে দেয়া হলো। বস্তুত সমগ্র ইরানে ইসলামিক বিপ্লব তাদের এক হাজার বছর পিছনে টেনে নিয়ে গেলো। সেই ইরানকে যখন মিশেল ফুকোর মত চিন্তক তাত্ত্বিক দার্শনিক উচ্ছ্বাসিত সমর্থন জানান তখন তারা আসলে কোন জিনিসটাকে সমর্থন করেন? মিশেল ফুকো ব্যাখ্যা করেছিলেন ইরানের ইসলামিক বিপ্লবকে কেন তিনি সমর্থন করেছেন, তিনি বলেছিলেন, ইরানের এই বিপ্লবকে ‘ইসলামিক’ বা ‘মৌলবাদী’ তকমায় না ফেলে এটাকে সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমাদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে ইরানের মহান এক বিপ্লব হিসেবে দেখা উচিত…।

কি পরিচিত লাগছে না কন্ঠস্বর? হ্যাঁ, আজো আমরা এরকম কন্ঠস্বর শুনতে পাই ইরানের বিপ্লবের ৪০ বছর পূর্তিতে। একদা নষ্ট বাম থেকে এখন সুফিবাদী ইসলামিক সমাজতন্ত্রী ফরহাদ মজহারের পাক্ষিক চিন্তা পত্রিকায় যারা লেখে তাদের মধ্যে অন্যতম সলিমুল্লাহ খান। তিনি আহমদ ছফা’র একজন শিষ্য। আহমদ ছফাকে এখন আমি নির্দ্বিধায় ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদী’ বলি আর তার জন্য আমাকে গবেষণা করতে হয় না। সলিমুল্লাহ খান ও বাত্য রাইসুরদের মত লোক যাকে গুরু বা ‘মহাত্মা’ বলে ডাকে তার আদর্শ সম্পর্কে সন্দেহ থাকে না। ছফার ভারত বিরোধীতা কতটা ভূ-রাজনৈতিক কারণ ছিলো আর কতটা হিন্দু বিদ্বেষ জনিত সেটা নিয়ে তর্ক করা যেতে পারে। যাই হোক, ফরহাদ মজহারের কর্মচারীদের একজন একবাল আহমেদ ইরানের বিপ্লবকে ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন! জনাব একবাল আহমেদ লিখেছিলেন, ‘উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগে ইরানি বিপ্লব ছিল ফরাসি বিপ্লবের মতোই অনন্য এবং পরবর্তী বিকাশের ভিত্তি প্রসবিনী, ঠিক যেমনি ফরাসি বিপ্লব ছিল শিল্প-বিপ্লবের যুগে’। বিষয়টাকে সহজভাবে বুঝার জন্য বলি, মনে করুন রাজশাহীর বাঘমারার বাংলা ভাইয়ের উত্থানের সময় যদি নোয়াম চমস্কি এটাকে শ্রেণীহীন মানুষের উত্থান বলে বাহবা দেন কেমন লাগবে আপনার কাছে? বাংলা ভাই কিন্তু তার ইসলামিক টিম দিয়ে সীমান্তের সমাজ বিরোধী, চোর ডাকাত থেকে শুরু করে অসৎ চেয়ারম্যান মেম্বারদের শায়েস্তা করেছিলো। অনেক গরীব লোক তার কাছে বিচার দিয়ে সুফল পেয়েছিলো। কিন্তু বাঘমারাকে কথিত বাংলা ভাই বাংলাদেশ থেকে অঘোষিতভাবে বিচ্ছিন্ন করে শরীয়া আইন বাস্তবায়ন করেছিলেন। থানা পুলিশ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে সে ইসলামিক আইনে দোররা মারা, পাথর মারা, হাত কাটা আইন প্রয়োগ করতে শুরু করে। প্রগতিশীল লোক, সস্কৃতিকর্মী ও কর্মজীবী নারীদের প্রতি সে নির্মম হয়ে উঠে। এখন যদি কেউ তার শরীয়তী কারবারকে দূরে রেখে শোষিত মানুষের হয়ে দাঁড়ানোকে বড় করে দেখতে বলে কেমন হয়? হামাস, হিজবুল্লাহ’র মত দলগুলো দখলদারদের বিরুদ্ধে লড়লেও তারা কিন্তু প্রগতির শত্রু। এরা যখন ক্ষমতা পাবে তখন ইরান, সৌদি আরবের মত এক হাজার বছর পিছনে নিয়ে যাবে মানুষকে। এসব থেকে সবচেয়ে বড় মূল্য চুকায় নারীরা। এখনো বামপন্থিরা মার্কিন সামাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা চোর জোচ্চর ইতর বদমাশ বাছাই করতে নারাজ। যে কোন মূল্যে তাদের প্রধান শত্রুকে বধ করতে পারলেই হলো। তাতে ইরানী নারীরা ধুঁকে ধুঁকে মরুক কিচ্ছু যায় আসে না! ইরানের কমিউনিস্ট পার্টি তুহেদ ছিলো খোমিনির বিপ্লবের মিত্র। ১৯৮২ সালে খোমিনি এই তুহেদ পার্টিকে ইরানে নিষিদ্ধ করে কমিউনিস্টদের সঠিক মূল্য চুকিয়েছিলো। ২০১৮ সালের ইরাকের নির্বাচনে ইসলামিক নেতা মুক্তাদা আল সদরদের দলের সঙ্গে ইরাকের কমিউনিস্ট পার্টি জোট করে নির্বাচনে লড়েছিলো। কারণ মুক্তাদা আল সদর হলেন কট্টর মার্কিন বিরোধী হিসেবে পরিচিত। আমাদের ফেইসবুক বিপ্লবীদের শামিমা বেগমের মানবাধিকার রক্ষার জন্য দৌড়ঝাপ কিন্তু এসবের বাইরে কিছু নয়। মোটেই এটা তাদের মানবাধিকারের পক্ষালম্বণ নয়। ইতিহাস থেকেই দেখিয়েছি ইরানের নারীদের অন্ধকারে নিমজ্জিত করতে হাত মিলিয়েছিলো কারা এবং এখনো সেই অন্ধকারের বার্ষিকী উদযাপনে কারা যোগ দিচ্ছে। কারা ইসলামী সন্ত্রাসবাদের সমালোচনাকে ‘ইসলামোফোবিয়া’ বলে হায় হায় করে উঠে, কারা ইসলামের সমালোচনায় ‘মুসলিম বিদ্বেষ’ খুঁজে পায় মনে করে দেখুন। সলিমুল্লাহ কলিমুল্লাহ রইসউদ্দিনরা যখন মানবতার কথা বলবে তখন বুঝবেন ভেতর ধান্দা আছে!
Susupto Pathok