বাংলা সনের প্রবর্তক কে? সম্রাট আকবর নাকি রাজা শশাঙ্ক? ছোটবেলা থেকেই তো পাঠ্যপুস্তকে পড়ে আসলাম বাংলা সনের প্রবর্তক সম্রাট আকবর।বলা হয়ে থাকে, ফসল ওঠার সময় জানতে কর আদায়ের সুবিধার জন্য তিনি এই সনের প্রবর্তন করেন। সম্রাট আকবর বাধ্য হয়ে হিজরী সনের অবাস্তবতা বুঝতে পেরেই হিজরী ৯৬৩ সনের সাথে মিল রেখে ওই সালকে বাংলা ৯৬৩ হিসেবে ঘোষণা করে এবং বাংলা সনের চালু করেন। কৃষকদের ফসল তোলার সময় সম্পর্কে জানার সুবিধার জন্য এই সাল চালু হয় বলে একে বলে ফসলী সন।
ষষ্ঠ এবং সপ্তম শতকের কিছু সময় বাংলা তথা গৌড়ের রাজা ছিলেন শশাঙ্ক। তিনি প্রথমে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনস্থ পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা অর্থাৎ বর্তমান ভারত-বাংলাদেশের বাংলা এলাকার সামন্ত শাসক ছিলেন। ষষ্ঠ শতকের শেষ দশকে শেষ গুপ্ত সম্রাট হীনবল হয়ে পড়লে, শশাঙ্ক গুপ্ত অধীনতা মুক্ত হয়ে নিজেকে বাংলা তথা গৌড় রাজ্যের রাজা হিসেবে ঘোষণা করেন। এই ঘটনা ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দের এবং সেই বছর থেকেই বাংলা সনের চালু হয়।
এই ব্যাপারে শ্রী সুনীল কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘বঙ্গাব্দের উৎস কথা’ শীর্ষক একটি পুস্তিকায় বলেছেন, ”সৌর বিজ্ঞান ভিত্তিক গানিতিক হিসাবে ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ এপ্রিল সোমবার, সূর্যোদয় কালই বঙ্গাব্দের আদি বিন্দু।”
বহু ভাষাবিদ রহমতুল্লাহ বাঙ্গালি তাঁর বঙ্গাব্দের জন্মকথা গ্রন্থেও ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গাব্দের সূচনা এবং রাজা শশাঙ্কই বঙ্গাব্দের প্রবর্তক বলে মত প্রকাশ করেছেন।
এখন দেখা যাক, বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে সম্রাট আকবরকে তারই আমলের রচিত ইতিহাস কতটুকু স্বীকৃতি দেয়!
“আইন-ই-আকবরী” নামে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালের সময়ের একটি বিখ্যাত গ্রন্থ আছে, কিন্তু এই গ্রন্থে বাংলা সন বা ফসলী সন চালুর ব্যাপারে কোন উল্লেখই নেই। কিন্তু আকবর ১০৭৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ইরানে প্রচলিত জেলালি সৌর পঞ্জিকা অনুসরণে ভারতে ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তারিখ-ই-ইলাহী নামে একটি সৌর পঞ্জিকা চালু করেন, কিন্তু কয়েক দশক পর এই তারিখ-ই-ইলাহী পঞ্জিকার ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে মুখ থুবড়ে পড়ে।
এবার একটু তুলনামূলক আলোচনায় যাওয়া যাক। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই ফেব্রুয়ারি আকবরের রাজ্যভিষেক হয়, সেই সময় থেকে বাংলা সন চালু হলে পহেলা বৈশাখ ১৫ ই এপ্রিল না হয়ে নিশ্চয়ই ১৪ই ফেব্রুয়ারি হত। তাহলে বর্তমানে পহেলা বৈশাখ ১৪ বা ১৫ই এপ্রিল হয় কেন? রাজ্যভিষেকের সময় আকবরের বয়স ছিলো মাত্র ১৩ বছর, সেই সময় কি তার পক্ষে খাজনা আদায়ের সুবিধার কথা ভেবে, ফসল তোলার সাথে সঙ্গতি রেখে এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ক্যালেণ্ডার চালু করার আদেশ দেওয়া সম্ভব ছিল? এর বিপরীতে ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে আকবরের তারিখ-ই-ইলাহীর মত সৌর পঞ্জিকা প্রচলন বেশি যুক্তিসঙ্গত, কারণ ইতিমধ্যে তাকে বেশ কিছুদিন রাজ্য পরিচালনা করতে হয়েছে এবং আরবী হিজরী সালের অবাস্তবতা তাকে একটি সৌর পঞ্জিকা প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছে। তাছাড়া এই সময়ের পূর্বে ইরান থেকে নূরজাহানের পিতা, আকবরের সভায় এসেছিলেন। সুতরাং তাঁর কাছ থেকে ইরানী সৌর পঞ্জিকা এবং তার কার্যকারিতার বিষয়ে আকবরের জেনে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
রাজা শশাঙ্ক প্রবর্তিত বাংলা সনের আদি বিন্দু ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই এপ্রিল। পরে বেশ কয়েকবার পঞ্জিকা সংস্কারের কারণেই মনে হয় এই ১২ই এপ্রিল বর্তমানে ১৪ বা ১৫ই এপ্রিলে এসে পৌঁছেছে। কিন্তু সম্রাট আকবরের নামে চালানো বাংলা সনের আদি বিন্দু ১৫৫৬ সালে ১৪ই ফেব্রুয়ারি তো কিছুতেই ১৫ই এপ্রিলে এসে পৌঁছতে পারে না। যদি বলা হয় পঞ্জিকা সংস্কারের কারণে ১৪ই ফেব্রুয়ারি, বর্তমানের ১৪/১৫ই এপ্রিলে পৌঁছেছে, তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে এই পঞ্জিকা কে, কবে সংস্কার করল?
কোন ঘটনা ঘটার আগে, সেই বিষয়ে কোনো কথাবার্তা ইতিহাসে থাকা একেবারে অসম্ভব। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে যদি বাংলা সন চালু হত, তাহলে তার আগে বাংলা সন তারিখ ইতিহাসে থাকতেই পারে না। কিন্তু আকবরের বহু পূর্বে প্রতিষ্ঠিত মন্দিরের প্রতিষ্ঠাফলক, পুঁথি বা বইপুস্তকে বাংলা সন ও তারিখের উল্লেখ পাওয়া গেছে, এগুলো এলো কোথা থেকে?
পৃথিবীর সকল সাল শুরু হয়েছে ১ থেকে এবং এটাই যুক্তিসঙ্গত। তাহলে ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ অনুযায়ী ৯৬৩ হিজরি সনকে ভিত্তি ধরে বাংলা সন চালু করতে হবে কেন এবং বাংলা সন ১ থেকে শুরু না হয়ে ৯৬৩ থেকে শুরু হবে কেন? আকবর যদি বাংলা সন চালু করেই থাকে, তাহলে ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দকেই বাংলা ১ সন হিসেবে ধরে হিসেব করতে অসুবিধে কি ছিল?
বাংলা বার ও মাসের নামগুলো এসেছে ভারতীয় জ্যোতিষ বিজ্ঞানের দেওয়া বিভিন্ন গ্রহ ও নক্ষত্রের নাম থেকে। রবি, সোম বা বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, এই নামগুলো কি আকবরের সময় থেকে ভারতে প্রচলিত হয়েছে, না অনেক আগে থেকেই প্রচলিত আছে? যদি আকবরের সময় থেকেই এগুলো প্রচলিত হয়ে থাকে, তাহলে মহাভারতে উল্লিখিত মহর্ষি জৈমিনী এবং পরে বরাহ, মিহির, খনার মতো বিখ্যাত জ্যোতিষীগণ কিভাবে এবং কোন ক্যালেণ্ডার অনুযায়ী তাদের হিসেবে নিকেশ করত?
এবার সংক্ষেপে যে ৩টি প্রশ্ন করলে আকবরের বাংলা সন চালু করার এই ইতিহাস সম্পূর্ণ ধ্বসে পড়বে, সেই ৩টি প্রশ্ন আপনাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে লেখাটা শেষ করব।
-প্রথম প্রশ্নঃ আকবর সমগ্র ভারতের সম্রাট ছিলেন নাকি শুধু বাংলার সম্রাট ছিলেন?
উত্তর- আকবর ছিলেন সমগ্র ভারতের সম্রাট।
দ্বিতীয় প্রশ্নঃ ফসল কি শুধু বাংলাতেই হত নাকি সমগ্র ভারতে হত?
উত্তর- সমগ্র ভারতেই হত, এখনও হয়।
তৃতীয় প্রশ্নঃ সমগ্র ভারতে ফসল হওয়া সত্ত্বেও এবং আকবর সমগ্র ভারতের সম্রাট হওয়ার পরেও কেন শুধু বাংলা এলাকার জন্য বাংলা সন চালু করতে যাবেন? বাংলা ছাড়া অন্যান্য রাজ্যের খাজনা বা কর কি তাঁর প্রয়োজন ছিল না?
১ম দুটির দরকার নেই, শেষ প্রশ্নটার উত্তর দিতে হবে সেই সকল মানুষদের যারা সম্রাট আকবরকে বাংলা সনের প্রবর্তক মনে করেন।
আমরা এই মিথ্যাগুলোকে খেতে এবং বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি এবং এখনও হচ্ছি। সময় এসেছে এসব মিথ্যা থেকে বের হয়ে সত্য খুঁজতে এবং সত্যের পথে চলতে।