রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত বাংলাদেশকে ভোট দেয়নি, কিন্তু পাকিস্তান দিয়েছে এই খুশিতে যে সকল ইমানদার পাক-প্রেমিক ভাইয়েরা বগল বাজাতে শুরু করেছেন, তারা শুনুন, রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে ভুল ভাবে উপাস্থাপন করা হয়েছে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনী কর্তৃক রাখাইন জনগোষ্ঠির উপর বর্বরোচিত নির্যাতনকে ‘মানবতা’র সমস্যা না বলে উপস্থাপন করা হয়েছে ‘ধর্মীয়’ সমস্যা হিসেবে। যার কারণে রাখাইন মুসলিম জনগোষ্ঠির পক্ষে নিয়ে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মালদ্বীপ বাংলাদেশকে ভোট দিলেও, অমুসলিম মিয়ানমারের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশকে ভোট দেয়নি অমুসলিম দেশ নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কা।
প্রতিবেশী মিত্র দেশ ভারতের অবস্থান নিয়ে শুরুতেই বাংলাদেশ দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। কারণ এ সংকটে আন্তর্জাতিক সমর্থন পেতে ভারতকে সবার আগে কাছে পাওয়ার আশা করছিল বাংলাদেশ। তখন মোদির মিয়ানমার সফরের এক সপ্তাহ পরে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে দিল্লি থেকে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এক ফোনালাপে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে পাশে থাকার আশ্বাস দেন। কিন্তু ভারত কথা রাখেনি। এটা আকস্মিক নয়, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত যে মিয়ানমারের পক্ষই নেবে এটা পরিস্কার বুঝা যাচ্ছিলো।
বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয়টি হলো- আন্তর্জাতিক বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দিলেও দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মালদ্বীপ ছাড়া অন্য কোনো দেশ বাংলাদেশের পক্ষে মিয়ানমার ইস্যুতে ভোট দেয়নি। প্রতিবেশি দেশগুলোর মধ্যে ভারত ছাড়াও ভোট দান থেকে বিরত ছিলো নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কা। সার্কভূক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দিয়েছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মালদ্বীপ। বিপক্ষে ভোট দেয়া দশটি দেশ হলো- রাশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, মিয়ানমার, সিরিয়া, জিম্বাবুয়ে, কম্বোডিয়া, লাউস এবং বেলারুশ।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাটাকে মানবতার সমস্যা হিসেবে উল্যেখ না করে মুসলমানদের-সমস্যা হিসাবে তুলে ধরেছিল আর এ কারণেই অমুসলমানদের কাছে এর গুরুত্ব ফিকে হয়ে গেলো। এটা রাজনৈতিক সমস্যা, মানবিক দিকটাই প্রধান, এই দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরা হয়নি। এই ‘ইসলাম বিপন্ন’ স্লোগানে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যতটা কাজ দিত, এখন তার হিংস্র আত্মপ্রকাশে মানুষ অন্য দৃষ্টিতে দেখছে এই ধর্মবিশ্বাস আর তার বিশ্বাসীদের। হয়তো প্রশ্ন আসতে পারে- ১৩৫ ভোট যারা দিয়েছে তারা তো সবাই মুসলমান দেশ নয়, হ্যাঁ এটা ঠিক এবং এর যথাযত কারণও আছে। চীনের সাথে মিয়ানমারের সম্পর্ক জেরে চীনের সম্ভব্য শক্তি খর্ব করতে আমেরিকার প্রভাবেই এই ১৩৫ ভোট এসেছে। অমুসলিম যে দেশ সমুহ বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দিয়েছে তাদের কাছে ধর্মের চেয়েও বড় বিবেচ্য হয়েছে বিশ্ব নিয়ন্ত্রন, প্রভাব এবং সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা। এর কবলে পড়ে মানবতা আপাত দৃষ্টিতে বেঁচে গেলেও এটা বললে ভুল হবে না যে, তাদের বেশির ভাগের কাছেই ‘মানবতা’ বড় ফ্যক্টর হিসেবে বিবেচ্য হয়নি।
অপরদিকে দক্ষিন এশিয়ার দেশ সমুহের কাছে রোহিঙ্গা সমস্যাটি বিবেচ্য হয়েছে শুধু মাত্র ধর্মীয় সমস্য হিসেবে। আর এই জন্যই এ অঞ্চলের মুসলিম দেশ সমুহ বাংলাদেশকে ভোট দিলেও, ভোট দেয়নি অমুসলিম রাষ্ট্রগুলো। এবার বগল বাজানো বন্ধ করুন। জ্বরের ঔষধে শুধু শরীরের তাপমাত্রা কমায়, রোগ সারাতে অন্য দাওয়ায় লাগে। ভোট দেওনেওয়ালা দেশ এবং না দেওনেওয়ালা দেশসমুহের এক পক্ষের মাথায় ছিলো সাম্প্রাদায়িকতা, অন্যপক্ষের মাথায় কাজ করেছে কায়েমি স্বার্থ! সেই দৌড়ে ১৩৫ ভোটে আমাদের তাপমাত্রা কমলেও, জ্বর সারবে বলে মনে হয় না। কারনে রোগের গোড়াতে যেতে হলে আমাদের মানবতা’র রুট ধরে এগুতে হবে। কিন্তু এই ১৩৫ ভোটের গুটিকতক বাদ দিলে বাকি ভোট গুলোর নেপাথ্যে ধর্ম এবং নিয়ন্ত্রনের স্বার্থটাই বেশি কাজ করেছে, মানবতা নয়!
বিভাগ: