ভারতের সেক্যুলার, লিবারাল ও বামপন্থিরা তাদের দেশে হিন্দুত্ববাদকে হুমকি মনে করলেও বাংলাদেশের সেক্যুলার-লিবারাল হিসেবে পরিচয়দানকারীরা ও বামপন্থিরা ইসলামপন্থিদের বাংলাদেশের জন্য হুমকি মনে করেন না। আহমদ ছফাকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিলো, বাংলাদেশে ইসলামিক মৌলবাদীদের তিনি হুমকি মনে করেন কিনা। উত্তরে তিনি তাদের গ্রামের সৈয়দ বাড়ির উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, এই বাড়ির মেয়েরা আগে ঘরের বাইরে বের হতো না-এত কঠিন পর্দা মেনে চলত, এক প্রজন্ম পরেই যখন সৈয়দদের অর্থনীতি ধসে গেলো তখন এই বাড়ির মেয়েরাই বাসে করে গার্মেন্টেসে চাকরি করতে গেছে…। তিনি অর্থনীতিকেই বড় করে দেখেছেন। ইসলাম ও ইসলামপন্থিদের বাংলাদেশের জন্য হুমকি মনে করতেন না। বাংলাদেশে কোন মৌলবাদী সমস্যা আছে বলেই তিনি মানতেন না। ছফার অনেক প্রশংসা পাওয়া যায় ফরহাদ মজহারের লেখায়। ফরহাদ মজহারকে আবার ভালো পায় ব্রাত্য রাইসু, সলিমুল্লাহ খান, ফারুক ওয়াসিস, পিনাকি ভট্টাচার্য। এরা সকলেই ভারতীয় হিন্দু বিরোধী বাংলাদেশী মুসলিম জাতীয়তাবাদী। তারা সদাসর্বদা ‘দিল্লির আগ্রাসনের’ বিরুদ্ধে জেগে থাকা অতন্দ্র প্রহরি। এদের বাইরে আছে লিবারাল ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী সমাজ। এদের ৯০ ভাগই আওয়ামী দলীয় রাজনীতিকেই তাদের সেক্যুলারিজমের উপরে স্থান দেন। যেমনটা বামপন্থিরাও তাদের রাজনীতিকেই উপরে রাখেন সেক্যুলারিজমের প্রশ্নে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে যত কথা বলা হয় তার সবটাই ‘হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ’ নামের একটি সংগঠন থেকে বলা হয় যা ঐ ধর্মের অনুসারীদের নিয়ে গড়া একটি সংগঠন। বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা বিচ্ছিন্নভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতনে মানববন্ধন করলেও সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে এই বিষয়ে একমত নয়। হিন্দুদের নিরবে দেশত্যাগ সম্পর্কে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠদের মত মনে করেন, ভালো থেকে ভালো খেয়েও তারা ভারতে চলে যায়…। কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দিন উমার মনে করেন, বাংলাদেশে হিন্দুরা নয় বরং মুসলিমরাই নির্যাতিত। কারণ এখানে ৯০ ভাগই মুসলিম। কাজেই নির্যাতনের পার্সেন্টে মুসলিমরাই বেশি নির্যাতিত…! ভারতীয় বামপন্থিরা কি ভারতে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে এরকম পার্ভাট তত্ত্ব হাজির করেন? তারা কি মনে করেন- ভারতে হিন্দুত্ববাদ কোন সমস্যা নয়?
দেখুন, ভারতে লিবারাল ও সেক্যুলাররা নরেন্দ মোদীর বিজয়ে ভারতের আত্মার পরাজয় বলছেন। কিন্তু আবহমান বাংলার কয়েক শতাব্দীর মন-মেজাজের সঙ্গে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর কি একজন রাজনীতিবিদের কথা বলা যাবে যাকে বলা চলে বাংলার প্রকৃত নেতা? বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে কাগজে কলমে ‘মুসলিম’ বানিয়েছিলো ওআইসি’তে যোগদানের মাধ্যমে। সরকারিভাবে ইসলামের প্রচার প্রসারের জন্য জনগণের টাকায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা ও টিভি-রেডিওতে কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান সম্প্রচারের সিদ্ধান্ত সদ্য জন্মানো বাংলাদেশে নেয়া হয়েছিলো। এরপর জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদা জিয়া, (অপর জনের নাম নেয়া যাবে না) এই দেশটাকে যেভাবে ইসলামিকরণ করেছে তাদের কাউকে ‘নরেন্দ মোদী’ হতে হয়নি আমাদের দেশের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের কাছে। ভারতে সংখ্যালঘু নিপীড়নের বিরুদ্ধে সেক্যুলাররা সোচ্চার হলেও বাংলাদেশে তার চিত্র উল্টো। যারা আওয়ামী লীগার সেক্যুলারপন্থি, তারা বিরোধী শাসনে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাকে নিয়ে ফলাও করলেও নিজ দলের শাসনে করা ঘটনাগুলোকে আড়াল করতে চান। অভিনেতা পিযুষ বন্দোপাধ্যায় সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে মুখ খোলায় মুনতাসির মামুন তার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। ঘটনাটা ঘটেছিলো মামুনের প্রিয় দলের সময় তাই এসব নিয়ে মুখ খোলা মানে ‘স্বাধীনতার স্বপক্ষের’ দলকে হেয় করা! মোদীর জমানায় যেভাবে ভারতের সেক্যুলার প্রতিষ্ঠানগুলি দুর্বল হয়ে যাবার অভিযোগ করেছিলো সেক্যুলাররা তেমনভাবে বাংলাদেশের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তচিন্তার লোকজন দাঁড়ায়নি। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের ইসলামুনুভূতি, বই প্রকাশনা বাজেয়াপ্ত, মুক্তচিন্তার নাস্তিক লেখকদের প্রতি একাডেমির রোষ- এসব দেখেও তারা কখনই দেশের সর্বনাশ দেখেননি। বরং একটি বইকে নিষিদ্ধ করতে কয়েকজন তথাকথিত প্রগতিশীর বুদ্ধজীবী রীতিমত মতামত প্রকাশ করেছিলেন।
বাংলাকে পরী আউলিয়ার দেশ, শহীদ-গাজির বাংলাদেশ বলে চিল্লায় গান গেয়েও বাংলার আত্মার পরাজয় এখানে কেউ দেখেনি। ‘মুসলিম বাংলা’ নামের সুলতানী আমলকে যেভাবে এখানকার ঐতিহাসিকরা নিজেদের ইতিহাস হিসেবে গর্ব করেন, যেভাবে সেইসব আমাদের পাঠ্যবইতে নিজেদের পূর্বপুরুষদের কীর্তি হিসেবে পড়ানোর জন্য অন্তর্ভূক্ত করেন- কেউ কোনদিন প্রশ্ন করেনি এসব বাংলা ও বাঙালীর আত্মার পরাজয় কিনা? ‘বাঙালী মুসলমান’ নাকি ‘মুসলমান বাঙালী’ এটাই এখনকার সেক্যুলার ও মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের’ মাঝখানের দেয়াল। অর্থ্যাৎ তাদের দুপক্ষই নিজেদের ‘মুসলিম’ পরিচয় নিয়ে দ্বিমত নেই!
Susupto Pathok