হিন্দু সমাজে সতীদাহ, বাল্যবিবাহ ও রাত্রিকালীন বিবাহের উৎপত্তি: সাধারণত: এই সব বিষয়ে মুসলমানরা নানারকম প্রশ্ন করে আপনাকে, আপনি যদি সঠিক জবাব না দিতে পারেন আপনি হেয় হবেন এবং সেই সুযোগে ইসলামকে তারা শ্রেষ্ঠধর্ম হিসেবে তুলে ধরবে।
শিক্ষিত মুসলমানদের অনেক প্রশ্নের মধ্যে প্রথম প্রশ্নটিই হবে সতীদাহ প্রথা সংক্রান্ত। সতীদাহ কি হিন্দু ধর্মের প্রথা? নেহরু মার্কা ইতিহাস, যে ইতিহাসের মূল কথা হল মুসলমানদের সম্পর্কে কিছু খারাপ লেখা যাবে না, সেই ইতিহাসের কল্যাণ এ আমরা প্রায় সবাই জানি সতীদাহ হিন্দু সমাজের প্রথা, এতে জীবন্ত হিন্দু বিধবাদের পুড়িয়ে মারা হত।
“কেমন সমাজ ছিল হিন্দু সমাজ, যে সমাজে জীবন্ত মানুষদের পুড়িয়ে মারা হত?”
মুসলমানদের এই প্রশ্নের মুখে পড়েননি এমন শিক্ষিত হিন্দু হিন্দুসমাজে খু্ব কম আছেন। সত্যিই তো সতীদাহ একটি নৃশংস প্রথা। তাই এই প্রশ্নের জবাবে হিন্দুদের মাথা নত করে থাকা ছাড়া অন্য কোন উত্তর থাকে না।
কিন্তু সত্যিই কি সতীদাহ হিন্দু সমাজের প্রথা? রামায়ণ মহাভারতে কি সতীদাহের কোন উল্লেখ আছে?
না, সতীদাহ, বাল্য বিবাহ এবং রাত্রিকালীন বিবাহ ভারতে মুসলিম শাসনের কুফল।
১। রামায়ণে কোথাও এই প্রথার উল্লেখ নেই।
২। মহাভারতের গল্প যেখানে শুরু সেখানে রাজা শান্তনু শেষ বয়সে ধীবর রাজকন্যা সত্যবতীকে বিয়ে করেন। সত্যবতীর দুই পুত্র জন্মানোর পর রাজা শান্তনু মারা যান। রাজা শান্তুনুর জ্যেষ্ঠপুত্র ভীষ্ম রাজা না হওয়ায় হস্তিনাপুর রাজ্য ভীষ্ম ও সত্যবতী মিলে ততদিন পর্যন্ত শাসন করেন যতদিন না সত্যবতীর পৌত্র পাণ্ডুর রাজ্যভিষেক হয়। পাণ্ডু বনে চলে গেলে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে কার্যনিবাহী রাজা নিযুক্ত করা হয় এবং ধৃতরাষ্ট্র কর্তৃক অপমান সইতে না পেরে সত্যবতী বনের এক আশ্রমে চলে যান এবং সেখানে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কয়েক বছর আগে তাঁর মৃত্যু হয়। জীবিত সত্যবতীকে কিন্তু রাজা শান্তনুর মৃতদেহের সাথে দাহ করা হয়নি!
পাণ্ডুর মৃতদেহের সাথে পাণ্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রীর মৃতদেহ একসাথে দাহ করা হয়। এই ঘটনাকে কেউ কেউ সহমরণের দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরেন।
এই ঘটনাটার ব্যাখ্যা: পাণ্ডু যেদিন কুন্তীকে বিয়ে করেন সেদিন রাতেই পাণ্ডুকে যুদ্ধযাত্রা করতে হয়। যুদ্ধজয় করে ফেরার পথে মদ্ররাজ তাঁর কন্যা মাদ্রীর সাথে পাণ্ডুর বিয়ে দেন, মাদ্রীকে নিয়ে পাণ্ডু হস্তিনাপুরে ফিরে আসেন। এরপর পাণ্ডু দুই স্ত্রীকে নিয়ে বনগমন করেন এবং সেখানে ভুলক্রমে হরিণরূপে সহবাসরত এক ঋষি ও তাঁর স্ত্রীকে তীর মেরে হত্যা করেন। ঋষি মৃত্যুর পূর্বে তাঁর স্বরূপে পাণ্ডুকে দর্শন দিয়ে অভিশাপ দেন, পাণ্ডু স্ত্রীসহবাস করলেই তৎক্ষণাৎ মারা যাবেন। পাণ্ডু প্রাসাদে ফিরে আসেন এবং সবাইকে জানান যে তিনি ঋষিকে হত্যা করেছেন, প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য তিনি স্থায়ীভাবে রাজ্য ছেড়ে বনে চলে যান। বনেই চলছিল পাণ্ডু ও তাঁর দুই স্ত্রীর সংসার। দেবতাদের আশীর্বাদে কুন্তীর সন্তান লাভের বরের কথা জানতে পারেন পাণ্ডু। তাঁর অনুমতি নিয়ে কুন্তী তিন পুত্র এবং মাদ্রী দুই পুত্র লাভ করেন, জন্ম নেয় পঞ্চপাণ্ডব। তারপর পাণ্ডু মাদ্রীর প্ররোচনায় তাঁর অভিশাপের কথা ভুলে মাদ্রীর সাথে সহবাসে লিপ্ত হন এবং তাঁর মৃত্যু হয়। মাদ্রীর কারণেই যে পাণ্ডুর প্রাণ গেল তা জেনে স্বামীর শোক সইতে না পেরে মাদ্রী স্বামীর শোকে আকস্মিকভাবে প্রাণত্যাগ করেন এবং স্বামী স্ত্রী দুজনকে এক সাথে দাহ করা হয়।
মুসলিম বা ইংরেজ আমলে সতীদাহের যে রূপ আমরা জানি, এঘটনা সেরকম কিছু নয়। পাণ্ডুর সঙ্গে তাঁর জীবিতা স্ত্রী কুন্তীকে কিন্তু দাহ করা হয়নি। কুন্তী কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পরও বেঁচে ছিলেন। সুতরাং মহাভারতেও সতীদাহের কোন ঘটনা ঘটেনি। রামায়ণে আর মহাভারতে সতীদাহের কোন ঘটনা নেই। হিন্দু ধর্মের কোন প্রাচীন গ্রন্থে সতীদাহের মত কোন ঘটনার উল্লেখ নেই, তাই সতীদাহ হিন্দুধর্মের কোন প্রথা নয়। তাহলে মধ্যযুগে সতীদাহ প্রথা এল কোথা থেকে?
প্রথম যে সতীদাহের কাছাকাছি ঘটনাটি পাওয়া যায় তা ঘটে ৭১২ খ্রীষ্টাব্দে মুহম্মদ বিন কাশিমের কাছে সিন্ধুর শেষ হিন্দু রাজা দাহির পরাজিত হলে। রাজপরিবারের মেয়েরা সম্মান বাঁচাতে বিষ খেয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন।
এমন সময় একজন মন্ত্রী রাণীকে জানান, “মুসলিম সৈন্যরা খুবই নৃশংস এবং অমানবিক, তারা নারীদের মৃতদেহকেও ধর্ষণ করতে ছাড়ে না।”
এই কথা শুনে মৃত্যুর পর দেহের পবিত্রতা রক্ষার্থে রাণীরা আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন এবং অন্তঃপুরের সব মেয়েরাও ঐভাবেই আত্মাহুতি দেন। এইভাবে ভারতবর্ষে সতীদাহ প্রথা শুরু হয়।
এরপর যখনই কোন হিন্দু রাজা মুসলমানদের কাছে পরাজিত হয়ে রাজ্য হারিয়েছেন তখনই সেখানকার নারীরা সিন্ধু রাজপরিবারের নারীদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। প্রথমত: যোদ্ধা পুরুষদের বিধবা স্ত্রীরা এবং পরে সকল বিধবারা এভাবে মৃত্যুকেই শ্রেয় মনে করে আগুনে আত্মাহুতি দিতে শুরু করেন সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়। হিন্দু সমাজকে দূষণের হাত থেকে রক্ষার জন্য নারীদের এই আত্মবিসর্জন কালক্রমে হিন্দু সমাজে খুব শ্রদ্ধার বিষয় হয়ে ওঠে এবং সতীত্ব রক্ষার জন্য তাঁরা নিজেদের দাহ করছেন, তাই এর নাম হয়ে ওঠে সতীদাহ। শত শত বছর ধরে চলার পর এটা হিন্দু ধর্মের অঙ্গ হয়ে ওঠে।
সিন্ধু রাজপরিবারের মহিলাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে পরবর্তী পরাজিত রাজপরিবারের মেয়েরা আগুনে ঝাঁপ দিলেন এবং কালক্রমে এটা একটা প্রথা হয়ে দাঁড়াল।
প্রথা যে কত শক্তিশালী তা আমাদের কোন ধারণাই নেই। সব হিন্দু পরিবারে ভাইফোঁটার উৎসব থাকলেও আমার ঘনিষ্ঠ এক পরিবারে কোন ভাইফোঁটা নেই। কারণ খুঁজতে গিয়ে জানতে পারলাম দুপুরুষ আগে কোন এক ভাইফোঁটা উৎসবের পরের দিন যে ভাইকে ফোঁটা দেওয়া হয়েছিল সেই ভাই মারা যান। এর পর ওই পরিবারে বিশ্বাস ঢুকে যায় তাদের জন্য ভাইফোঁটা অশুভ। তার পর থেকে তারা এই উৎসব বাদ দেয় এবং এখন ১০০ বছর পরও পারিবারিক প্রথা মেনে তারা ভাইফোঁটা পালন করে না। প্রথা এমন শক্তিশালী, যখন তা কোন কারণে বন্ধ হয়, তা যেমন বন্ধই থাকে, তেমন যখন কোন প্রথা কোথাও শুরু হয় সেটাও চলতে থাকে। যখনই কোন হিন্দু রাজ্যের ওপর মুসলমান শাসকদের দৃষ্টি পড়েছে এবং হিন্দু রাজা যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন, তখনই মুসলমান সৈন্যদের ধর্ষণ এমনকি মৃতদেহকেও ধর্ষণের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য পূর্বসুরী সিন্ধু রাজপরিবারের মেয়েদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে পরবর্তী রাজপরিবারের মেয়েদের এরকম করতে থাকেন, যেহেতু পরাজিতদের মেয়েদের মুসলমান সৈন্যরা নির্বিচারে ধর্ষণ করত, কোরান হাদিসে তার অসংখ্য উদাহরণ আছে, এবং আছে ইতিহাসেও।
এরপর এল ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ, আলাউদ্দিন খিলজী ৪ বছর আগে তাঁর পিতৃব্য সম্রাট জালালউদ্দীন খিলজীকে হত্যা করে সিংহাসনে আরোহণ করেছেন। তিনি} সেইসময় ইসলামী আইনে বিশেষজ্ঞ উলামাদের নিয়ে এসেছিলেন সৌদি আরব থেকে। তারপর তিনি ইসলামী শাসন বিষয়ে তাঁদের পরামর্শ চাইলেন। তাঁদের পরামর্শ অনুসারে আরও নতুন দুরকম কর চাপল অমুসলিমদের ওপর। তার একটি ছিল নজর ই বেওয়া। কোন অমুসলিম মহিলা বিধবা হলে তার জন্য প্রতি বছর কর সংগ্রহ করা হত তাঁর বাপের বাড়ী বা শ্বশুর বাড়ী যাঁরা তাঁর দায়িত্ব নিতেন বা তাঁকে আশ্রয় দিতেন। এই করের ফলে একদিকে যেমন রাজকোষ ভরে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু বিধবাদের দায়িত্ব নিতে বাপের বাড়ী আর শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা করের চাপে অস্বীকার করলে মুসলিমদের পক্ষে সহজ হত তাদের অপহরণ করা। করের পরিমাণ মোটেও কম ছিল না, উপরন্তু এই কর আদায় করা হত অন্য সব কর, জিজিয়া কর আর তীর্থকরের ওপরে। কাজেই এই অতিরিক্ত করের হাত থেকে বাঁচতে এবং হিন্দু বিধবা মহিলাদের মুসলিমদের হাত থেকে রক্ষা করতে বিধবাদের তাঁদের স্বামীদের চিতায় দাহ করার প্রথা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং হু হু করে বাড়তে থাকে।
রাজা রামমোহন রায় তাঁর বাল্যকালে তাঁর বৌদিকে সতী হতে দেখেন, এই বিষয়টি তাঁকে গভীরভাবে ব্যথিত করে। এরপর তিনি ১৮২৯ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর বৃটিশ সরকারের ভাইসরয় উইলিয়াম বেন্টিক এর সহায়তায় সতীদাহ বন্ধে একটি আইন পাশ করাতে সমর্থ হন। এভাবেই ভারতে আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হয় সতীদাহ প্রথা। কিন্তু এই সতীদাহ প্রথা বন্ধে মুসলমান ও সেকুলার ঐতিহাসিকরা খুঁজে পান মুসলিম শাসকদের অবদান। মুসলমান শাসকরা সতীদাহ বন্ধ করতে সত্যিই উদ্যোগী হলে এর জন্য রাজা রামমোহন রায়কে এত যুদ্ধ করতে হত না, আর এটা ১৮২৯ সালে ইংরেজ আমলে বন্ধ না হয়ে ১৭৫৭ সালের আগেই হত। মুসলমানদের এটা একটা ষড়যন্ত্র, মুসলিম শাসকদের অত্যাচারের কারণেই যে ভারতে সতীদাহ প্রথার উদ্ভব হয়েছে এই ইতিহাসকে চাপা দিতেই তাদের এই অপপ্রচার! কিন্তু সত্য চাপা থাকে না, সত্য একদিন না একদিন প্রকাশ হয়ই এবং তা প্রকাশিত হয়েছে।
এবার বাল্যবিবাহের কথা, আমরা সবাই জানি বা শুনেছি যে হিন্দু রাজারা মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার জন্য স্বয়ংবর সভার আয়োজন করতেন। সেখানে প্রাপ্তবয়স্ক সাবালিকা মেয়েরা নিজেদের পছন্দ মত বর পছন্দ করে নিতে পারতেন বলেই ঐ অনুষ্ঠানের নাম স্বয়ংবর সভা। তাহলে হিন্দু ঐতিহ্যে বাল্য বিবাহ এল কোথা থেকে?
স্বয়ংবর সভাতে বেশীর ভাগ সময় নানারকম শক্তির প্রতিযোগিতা রাখা হত এবং তাতে যারা জয়লাভ করতেন তাঁরাই ঐ রাজকন্যাকে বিয়ে করতে পারতেন। মহাভারতে এরকম দুটি ঘটনা আছে । প্রথমটি ঘটে কাহিনীর শুরুতে, মহামহিম ভীষ্ম, তাঁর সৎ ভাই বিচিত্রবীর্যের বিয়ের জন্য স্বয়ংবর সভায় শক্তির প্রতিযোগিতায় জিতে কাশীর রাজার তিন মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে আসেন।এর মধ্যে তিন বোনের দুই জন বিচিত্রবীর্যকে বিয়ে করতে রাজী হন, কিন্তু অপর বোন অম্বার বক্তব্য ছিল ভীষ্মকেই তিনি বিয়ে করবেন যেহেতু ভীষ্মই তাঁকে জয় করেছেন। কিন্তু ভীষ্মের আবার প্রতিজ্ঞা ছিল আজীবন ব্রহ্মচারী হয়ে থাকবেন। আমরা যে ভীষ্মের প্রতিজ্ঞার কথা বলি এ হল সেই প্রতিজ্ঞা। এই প্রতিজ্ঞার জন্য ভীষ্ম অম্বাকে বিয়ে না করতে রাজী হলেন না। এরপর নানাভাবে অম্বা ভীষ্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেও তাঁকে পরাজিত করে বিয়েতে বাধ্য করতে ব্যর্থ হন। পরের জন্মে বীর যোদ্ধা হয়ে জন্ম নেবার ও ভীষ্মকে যুদ্ধে হত্যা করার সংকল্প নিয়ে তিনি আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এরপর তিনি পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কন্যারূপে শিখণ্ডী নামে জন্মগ্রহণ করেন এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তাঁর ছোঁড়া তীরে ভীষ্মের মৃত্যু হয়।
মহাভারতে দ্বিতীয় স্বয়ংবর সভার ঘটনাটি ঘটে পাঞ্চালী বা দ্রৌপদীর বিয়ের সময়। এই স্বয়ংবর সভা থেকে অর্জুন পাঞ্চালীকে জয় করেন।
মহাভারতের এই দুটি স্বয়ংবর সভার অর্থ হল রামায়ণ মহাভারতের যুগে কোন বাল্য বিবাহ ছিল না, কারণ বালিকাদের নিজের বিবাহের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার কোন ক্ষমতা থাকে না। তাহলে বাল্য বিবাহ হিন্দু সমাজে কখন শুরু হল? এর কারণও সেই জঙ্গল রাজ অর্থাৎ মুসলিম দুঃশাসন।
কোরান-হাদিস অনুসারে ইসলামিক দেশে বসবাসরত সকল অমুসলিমরা কাফের, তাই তারা হত্যার যোগ্য। যদি কোন কারণে তাদের হত্যা করা না হয় তাহলে তারা জিম্মি, এই জিম্মিদের জিজিয়া কর দেওয়ার বিনিময়ে তাদের প্রাণ বাঁচাতে হয় এবং ইসলামিক দেশে বসবাস করতে হয়। কাফেরদের সব সম্পত্তি হল গণিমতের মাল। মুসলমানরা চাইলেই সেই গণিমতের মাল যেভাবে খুশি যখন তখন ভোগদখল করতে পারে। হিন্দু মেয়েরাও এই গণিমতের মালের মধ্যে পড়ে। মুসলিম শাসকরা যখন ভারত দখল করতে আসেন তখন তাঁরা সৌদি আরব বা আফগানিস্তান থেকে তাঁদের বৌমেয়েদের সঙ্গে করে আনতেন না। তখন হিন্দু মেয়েরাই হত মুসলমানদের অসীম যৌন কামনার বলি।
কোন রাজ্য দখল করার সময় সবক্ষেত্রেই হিন্দু পুরুষদের হত্যা করা হত আর বাঁচিয়ে রাখা হত মেয়েদের। সম্মান রক্ষার জন্য যেসব মেয়ে আত্মহত্যা করতেন তাঁরা মরতেন, জীবিতদের মধ্যে সুন্দরীদের বন্দিনী করে সোজা পাঠান হত মুসলিম শাসকের হারেমে। তাঁরা ভোগে লাগতেন রাজা বাদশাদের। আর অন্য যুবতী মেয়েদের ভোগ করত এবং পরে বলপূর্বক ধর্মান্তরিতা করে মুসলমান বানিয়ে বিয়ে করে নিত সাধারণ সৈনিক আর অন্য মুসলমানরা। এখানে দুটি তথ্য বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য, ভারতের মুসলমানরা তারা ধর্মান্তরিত হোক বা বহিরাগত কেউ কোন চাষবাস বা ব্যবসা বাণিজ্য বা শ্রমের কাজের সাথে যুক্ত ছিল না, তারা সবাই ছিলেন হয় শাসনকার্য অথবা লুঠপাটের সাথে যুক্ত। মুসলমান শাসকদের হারেমে যত মেয়ে থাকত তার সবাই ছিল হিন্দু পরিবারের। কারণ ইসলামের তলোয়ারের সামনে ভারতের যে সব হিন্দু মুসলমান হয়েছে, ধর্মীয় নির্দেশ- মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই, এই সূত্র অনুসারে মুসলমান শাসকরা তাদের যতটা সম্ভব সুযোগ সুবিধা দিয়ে শাসনকার্যের সাথে যুক্ত করেছেন এবং তাদের ওপর কোনো রকম নির্যাতন করেন নি। তাই মুসলমান মেয়েদের হারেমে থাকার কোন প্রশ্নই নেই।
নজর ই মারেচা: এই করটিও আলাউদ্দিন খিলজীর আমলে প্রচলিত হয়। অমুসলিম প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে মেয়েদের বিয়ে করতে সরকারী অনুমতি লাগত এবং এই অনুমতি পাওয়া যেত অর্থের বিনিময়ে।
এই কর থেকে বাঁচার জন্যও হিন্দুরা বাল্যবিবাহ প্রথা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
প্রথম ধাক্কাতে কিছু হিন্দু মেয়ের স্থান হারেমে এবং বাকিদের স্থান মুসলমানদের বাড়িতে হলেও, জন্ম তো আর থেমে থাকে না। যখনই কোন হিন্দু পরিবারে কোন মেয়ের জন্ম হত আর যখনই তারা একটু বড় হত তখনই মুসলমানরা এসে তাদের ধর্ষণ করত এবং উঠিয়ে নিয়ে যেত। এই সমস্যা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য হিন্দু সমাজপতিরা একটা উপায় বের করলেন। তা হল জন্মের পর মেয়েদের ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রাখা এবং যত কম বয়সে সম্ভব মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া, মেয়েদের স্তন উদগত হওয়ার আগেই! কারণ যৌন বিজ্ঞানের মত হল স্তন উগদত হওয়ার আগে কোন মেয়ে কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। মেয়েদের স্তন যত বড় হয় তারা তত সুন্দরী আর আকর্ষণীয়া হয়ে ওঠে। তাই কারও চোখে না পড়ার জন্য সবচেয়ে উপযোগী বয়স হল আট। এই বয়সের পর থেকে মেয়েদের স্তনের বৃদ্ধি শুরু হয়। এই আট বছর বয়সে মেয়ের বিয়ে দেওয়াকে হিন্দু সমাজে শ্রেষ্ঠ মনে কর হত, আর এর নাম ছিল গৌরীদান।
হিন্দু বিয়ে চুপচাপ করে হয় না, এর থাকে নানা আয়োজন। হিন্দু বিবাহের সকল রীতি শেষ করতে মোটামুটি তিন দিন লাগে। ভারতে মুসলমানরা আসার আগে বিয়ে হত দিনের বেলায়, ভারতের যেসব এলাকায় মুসলিম শাসনের ছোঁয়া লাগেনি এখনও সেসব এলাকাতে বিয়ে হয় দিনের বেলায়। কিন্তু দিনের বেলায় মেয়েদের বিয়ে দেওয়া মুসলমানদের অত্যাচারে অসম্ভব হয়ে উঠল। কারণ বাড়িতে লুকিয়ে রাখার ফলে এবং বয়স বেশী না হওয়ায় মুসলমানদের চোখে মেয়েরা না পড়লেও যখন তাদের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে তখন মুসলমানরা ঠিকই বুঝতে পারত যে এ বাড়িতে মেয়ে আছে আর সে নাবালিকা নয়, সাবালিকা! তাই সে ভোগযোগ্য! আট বছর বয়সেও মেয়েদের বিয়ে দিতে গিয়ে যখন হিন্দুরা সমস্যায় পড়তে আরম্ভ করল তখন হিন্দু সমাজপতিরা নতুন সমাধান বের করলেন, তা হল গোপনে চুপি চুপি চোরের মত রাতের বেলায় বিয়ে দিয়ে মেয়েকে বিদায় করে দেওয়া। এজন্য জ্যোতিষীরা রাতের বেলায় শুভলগ্ন খুঁজে বের করে বিয়ের জন্য শুভ দিন বের করে ফেলতে লাগলেন}। এভাবেই শুরু হয়েছিল,আট বছর বয়সে গৌরী দান অর্থাৎ বাল্য বিবাহ এবং রাতের বেলায় সাত পাক ঘোরানোর নিয়ম।
মুসলমানদের বিয়ে কিন্তু দিনের বেলাতেই হয় যেহেতু তাদের ঐ রকম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয় না। হিন্দু ছাড়া আর কোন জাতির বিবাহ রাতের বেলা হয় না। অথচ হিন্দু বিয়ে এক প্রকার যজ্ঞ এবং হিন্দু শাস্ত্রে রাতের বেলা কোনপ্রকার যজ্ঞ করার নিয়ম নেই। একমাত্র বিবাহের যজ্ঞ ছাড়া অন্য সব ধর্মীয় যজ্ঞ দিনের বেলাতেই করা হয়।
প্রথা যে কত শক্তিশালী হতে পারে তার উদাহরণ মুসলমানদের দুঃশাসনের ফলে হিন্দুসমাজে বাল্য বিবাহের যে আবির্ভাব ঘটল মুসলিম শাসন শেষ হওয়ার ১০০ বছর পরও সেই প্রথা থেকে হিন্দুরা মুক্ত হতে পারছিল না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ইতিহাস ভিত্তিক উপন্যাস “সেই সময়” পড়লে দেখতে পাবেন, ১৮৫০/৬০ সালেও ৮/১০ বছর বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হত যে বয়সে মেয়েরা পুতুল খেলাই ছাড়ে না, বিয়ে কী বস্তু সেটা বুঝে ওঠা অনেক দূর। “সেই সময়” উপন্যাসের যুগের হিন্দুরা কিন্তু মোটেই অনিরাপদ নন, কিন্তু প্রথা সহজে সমাজ থেকে দূর করা যায় না।
হিন্দুরা আধুনিক আর প্রগতিশীল, এখন আর গৌরীদান প্রথা নেই। কিন্তু আলোকসজ্জা, কর্মব্যস্ত দিনের শেষে সবার উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার সুবিধার কারণে রাত্রীকালীন বিবাহ হিন্দু সমাজে এখনও টিঁকে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। সেই সঙ্গে হিন্দুরা এই ইতিহাসও জানুক যে কেন হিন্দু বিবাহ রাতের বেলা হয়, অবশ্য নেহরু মার্কা ইতিহাসের বেড়াজাল ভেদ করে যদি সব হিন্দুকে তা জানানো যায়।
প্রাচীন হিন্দু সমাজে অসূর্যস্পর্শ্যা বলে একটা শব্দ ছিল। এর অর্থ সুর্যের আলো যাকে স্পর্শ করে নি। পৃথিবীতে কোন কিছু সূর্যের আলো স্পর্শ করবে না, বাস্তবে এটা কি সম্ভব? এই অসম্ভবকে মুসলিম শাসন কালে হিন্দুদের সম্ভব করতে হয়েছিল, মেয়েদের রক্ষা করার জন্য।
কোন বাড়িতে হিন্দু মেয়ের জন্ম হয়েছে কিনা এই খোঁজ নেওয়ার জন্য মুসলিম শাসকরা নারী গুপ্তচর নিয়োগ করতেন, তাদের বলা হত সিন্ধুকী। এই সিন্ধুকীদের হাত থেকে মেয়েদের রক্ষা করার জন্য তাদের একেবারে ঘরের বাইরে বের করা হত না। যে ঘরের বাইরে বের হয় না, তার গায়ে সূর্যের আলো লাগবে কোথা থেকে? এর থেকেই উৎপত্তি হয় অসূর্যস্পর্শ্যা শব্দের। হিন্দু মেয়েদের এই অসূর্যস্পশ্যতা সারাজীবনেও ঘুচত না। গোপনে চুরি করে রাতের বেলা বিয়ে দেওয়ার পর তাদের কাপড়ে ঘেরা পালকিতে করে শ্বশুরবাড়ি ও বাপের বাড়ি আনা নেওয়া করা হত, ফলে তখনও সূর্যের আলো তাদের গায়ে লাগত না, আর শ্বশুরবাড়িতে গিয়েও তাদের অন্তঃপুরেই বন্দী থাকতে হত। বৌ সুন্দরী হলে আর তারা সিন্ধুকীদের নজরে কোনভাবে পড়ে গেলে মুসলমান শাসকদের হাত থেকে বিবাহিতা মেয়েদেরও রক্ষা ছিল না।
হিন্দু বধূরা মুসলিম শাসনের আগে কোনদিন ঘোমটা কাকে বলে জানতেন না। মুসলমানদের নজর এড়ানোর জন্য হিন্দু বৌরা এত বড় ঘোমটা দেওয়া শুরু করল যাতে কোনভাবে তাদের মুখ দেখা না যায়। বাংলায় এই ধরণের ঘোমটা এখন কেউ দেয় না, ঘোমটার প্রচলন প্রায় উঠে গেছে, কিন্তু ভারতের অনেক স্থানে মেয়েরা এমন ঘোমটা এখনও দেয়। শৌচালয় নিয়ে করা দীপিকা পাড়ুকোনের একটি বিজ্ঞাপনে নববিবাহিতা মেয়েটিকে যেরকম এক হাত লম্বা ঘোমটা পরা অবস্থায় দেখেছেন, মুসলিম শাসনকালে হিন্দু পরিবারের বৌদের ঘোমটা ছিল ঠিক সেরকম। সুফী দরবেশদের অনেকেই বেশ ভাল এবং উদার মুসলমান বলে মনে করেন, এই সুফী দরবেশরাই মুসলিম শাসকদের গোয়েন্দা বা সিন্ধুকী হিসেবে কাজ করতেন। কোন হিন্দু পরিবারে কটা মেয়ে আছে সেই খোঁজ নবাব, সুলতান আর বাদশাদের এঁরাই দিতেন। সাধারণ মুসলিম সৈন্যদের হিন্দু বাড়িতে ঢোকায় কিছুটা প্রতিবন্ধকতা থাকলেও সুফী দরবেশদের এই সমস্যা ছিল কম।
এই রকম চরম অনিশ্চয়তা ও বিপদের মধ্যে জিজিয়া কর দিয়ে কোনরকমে আত্মরক্ষা করে টিঁকে থাকতে হয়েছে আমাদের পূর্বপুরুষদের। এসব ইতিহাস আমাদের ভোলা উচিত নয়, কাউকে ভুলতে দেওয়াও উচিত নয়। শত্রুকে চিনতে ভুল হলে বা তাকে চিনিয়ে না দিলে আমাদের আগামী প্রজন্ম তাদের দ্বারা বারবার ক্ষতির শিকার হবে। আমাদের প্রত্যেকের উচিত একটি শক্তিচর্চা ভিত্তিক হিন্দু সমাজ নির্মাণ করতে যে যেখানে আছেন সেখান থেকেই কাজ করা। তাহলে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষা দিতে পারব এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মুখে নেহরু গান্ধীকে বর্তমানে আমরা যেমন গালি দিই সেরকম গালি খেতে হবে না।