একজন জগতজ্যোতি দাসঃ

একজন জগতজ্যোতি দাসঃ
—————————
এই প্রজন্মের অনেকেই তার নামও হয়ত জানেনা। চিনে না এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। যাদের রক্তের ঋণ এই স্বাধীন বাংলাদেশ কোনদিন শোধ করতে পারবে না, জগতজ্যোতি দাস তাদের মাঝে অন্যতম। সুনামগঞ্জ থেকে সর্বপ্রথম ১১৪ জনের মুক্তিযোদ্ধ্বা দল প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্য ভারত যান সেই দলের নেতৃত্বে ছিলেন জগতজ্যেতি নামের এই তরুণ।
.
প্রশিক্ষণ শেষে জগতজ্যতির দল দেশে প্রবেশ করলে তাদেরকে ভাটি অঞ্চলে পাকবাহিনীকে বাধা দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়, কারণ সড়কপথে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ বেশী থাকায় পাকবাহিনী তাদের রসদ আনা-নেয়ার জন্য এই অঞ্চলের জলপথ ব্যবহার করত। প্রশিক্ষিত চৌকস যোদ্ধাদের নিয়ে জগতজ্যোতি গঠন করে একটি গেরিলা দল, যার নাম দেওয়া হয় ‘দাস পার্টি’। কুশিয়ারা নদীতে পাকিস্তানিদের একটি কার্গো ডুবিয়ে শুরু হয় তাদের অভিযাত্রা। এই ‘দাস পার্টি’ হাওর অঞ্চলে চালায় একেরপর এক সফল অপারেশন। যার ফলে পাক বাহিনীর কাছে ‘দাস পার্টি’ হয়ে দাঁড়ায় একটি ভয়ংকর আতংকের নাম। দাস পার্টির আক্রমনের তীব্রতায় বাধ্য হয়ে এই রুটে পাকবাহিনী নৌচলাচল বন্ধ করে দেয়। পাকিস্তান সরকার রেডিও তে ঘোষণা করে এই রুট দিয়ে চলাচলকারীদের দায়দায়িত্ব সরকার নেবে না।
.
‘দাস পার্টির’ ভয়ে পাক সেনারা সরাসরি তাদেরর সাথে যুদ্ধ্বে অবতীর্ণ না হয়ে তাদেরকে ফাঁদে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়।  তাদেরর অবস্থান সম্পর্কে রাজাকারদের মাধ্যমে জেনে নিয়ে  রাজাকারদের টোপ হিসাবে  ব্যবহার করা হয়। রানীগঞ্জ, কাদিরগঞ্জ, শেষে  দিরাই শাল্লা অভিযান ও আশুগঞ্জ শাহাজ়ীবাজার বিদ্যুত লাইন বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে ‘দাস পার্টি’  ১৬ নভেম্বর সকাল আট টায় ভেড়ামোহনা নদীতে পৌছে, বদলপুর ইউ পি অফিসের সামনে পৌছার পর তাঁরা দেখেতে পান ৩-৪ জন রাজাকার ব্যবসায়ীদের নৌকা থেকে চাঁদা আদায় করছে। জ্যোতি রাজাকারদের  ধরে আনতে নির্দেশ দেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের দেখেই পিছু হঠতে থাকে কৌশলী রাজাকাররা। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন জগতজ্যোতি- ভাবতেও পারেননি কী ফাঁদ তাঁর সামনে। তাঁর সাথের ১০/১২ জন মুক্তিযোদ্ধা আর সামান্য গোলাবারুদ নিয়েই তাড়া করেন তিনি রাজাকারদের।
.
পাক ক্যাম্প সেখান থেকে থেকে মাত্র ২০০ গজ দুরে। পাক সেনাদের আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে দাস পার্টি। অবস্থা দেখে সহযোদ্ধা ইলিয়াস জগতজ্যোতিকে জিজ্ঞেস করেন, কি করব দাদা? জ্যোতি বলেন, “তোর যা ইচ্ছা তুই কর। পিছু হটলে কেউ রেহাই পাবেনা। তারা আমাদের তিন দিকে ঘিরে ফেলেছে যুদ্ধ করতে হবে।” সবাইকে বাঁচাতে তার সঙ্গে থাকার জন্য ইলিয়াস কে নির্দেশ দেন জ্যেতি। রণাঙ্গণে পরিস্হিতির ভয়াবহতা চিন্তা করে এক পর্যায়ে জ্যোতি তার দলকে ফিরে যাবার নির্দেশ দিয়ে একটি মাত্র এলএমজি নিয়ে নিজে একাই যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। এজন্য জ্যোতি সহযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী মমিনকে নির্দেশ দেন যাতে অন্যরা তাদের জীবন বাঁচিয়ে নিরাপদ স্থানে সরে যায় । এরপর দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন মাত্র দুইজন, জ্যোতি ও ইলিয়াস। সুস্থির এবং দৃঢ় মনোবলের সঙ্গে তারা যুদ্ধ করতে থাকেন তারা একটানা। কিন্তু হঠাৎ ইলিয়াস পাঁজরে গুলিবিদ্ধ হন। জ্যোতি পিছু না হটে তার মাথার লাল পাগড়ি খুলে শক্ত করে ইলিয়াসের বুকে‌ এবং পিঠে বেঁধে দেয়, যাতে তার রক্তক্ষরণ থেমে যায়। ইলিয়াস সেই অবস্থায় মেশিনগান নিয়ে ক্রমাগত গুলি ছুড়তে থাকে পাক হানাদারদের ওপর। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ম্যাগজিন লোড করে শত্রুর অবস্থান দেখতে মাথা উঁচু করতে মুহুর্তে ১টি গুলি জগতজ্যোতির চোখে বিদ্ধ করে। মেশিনগান হাতে উপুড় হয়ে পাশের বিলের পানিতে নিশ্চল হয়ে ঢলে পড়েন জ্যোতি। শেষ বারের মতো শুধু বলে উঠেন ‘’আমি যাইগ্যা’’(আমি চলে যাচ্ছি)।ইলিয়াস  পিছন ফিরে দেখেন বিলের পানিতে ডুবে যাচ্ছে তার প্রিয় কমান্ডারের দেহ। ডুবন্ত দেহকে শেষ বিকেলের রক্তিম আভায় শেষবারের মতো তুলে ধরেন। কোমর পানিতে কাদার মধ্যে নিজের হাতে ডুবিয়ে দেন সহযোদ্ধার দেহ। যেন সুযোগ পেলে পুনরায় এসে লাশ তুলে নিতে পারেন।
.
কিন্তু, জগতজ্যোতির লাশকেও ভয় পেয়েছিল হানাদার পাক বাহিনী ও রাজাকাররা। তাই রাতেই বিল থেকে তাঁর লাশ তুলে আনে তারা। ভোর হওয়ামাত্র  জ্যোতির নিহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে দেয় রাজাকারেরা। আজমিরীগঞ্জ বাজারে নিয়ে আসা হয় তাঁর লাশ। মুক্তিকামী মানুষের বুকে ভয় ধরাতে জনসন্মুখে তার লাশের উপড় চলে পৈশাচিক বর্বরতা। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিণতি মানুষকে দেখাতে ঈদের দিন তার  দেহ বেধে রাখে বাজারের বিদ্যুতের খুটির সাথে। তুলে রাখা হয় সেই ছবি।  পাকসেনাদের দোসররা বিকালে তার লাশ ভাসিয়ে দেয় ভেড়ামোহনার কালো জলে।

এমনকি জগতজ্যোতির পিতা-মাতাকে সেই অবস্থায় সন্তানের লাশ দেখানো হয়। দেখানো হয় নিজের সন্তানের সাথে বর্বরতা। তাঁরা বাড়ি ফিরে দেখেন রাজাকাররা দাড়িয়ে থেকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে তাদের বসতভিটা। সাহস করে কেউ  সেদিন দেয়নি বাড়িয়ে সাহায্যের  হাত।
.
এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে তার অসীম সাহস আর বীরত্বের জন্য একাধিকবার বীরশ্রেষ্ট খেতাব দেওয়ার ঘোষনা দেওয়া হলেও কোন এক বিচিত্র কারণে সে খেতাবে তাকে আর ভূষিত করা হয়নি আজো। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার তাকে ভূষিত করেন ‘বীর বিক্রম’ উপাধিতে।
.
তথ্য সুত্রঃ
১। ‘একাত্তরের দিরাই-শাল্লা’, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী
২। ‘দাস পার্টির খোঁজে।‘,  হাসান মোরশেদ
.
.
.
*** আফসোস, যে অল্প কয়েকজন মানুষ এই বীর মুক্তিযোদ্ধার গল্প সাধারণ জনগনকে জানানোর চেষ্টা করেছিলেন, Hasan Murshed তাদের একজন। আজ তার মাথার উপর মামলা ঝুলছে, কারণ তিনি তাঁর লেখা বইতে একজন রাজাকারকে রাজাকার বলে ডেকেছিলেন।