ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম সুপারস্টার।

(শেষ কিস্তি) ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম সুপারস্টার (৬)
KANAN DEVI: THE FIRST SUPERSTAR OF INDIAN CINEMA
কানন দেবীর সাথে ১৯৪৯ সালে পশ্চিবঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপালের সাথে আলাপের সূত্রে পরিচয় হয় রাজ্যপালের নেভাল এ.ডি.সি হরিদাস ভট্টাচার্যের সঙ্গে। পরিচয় থেকে প্রণয় এবং বিবাহ ওই বছরেই।

‘দ্বিতীয় বিয়ে হতেই কেচ্ছা শুরু’ শিরোনামে কানন দেবীর আরেক জীবন নিয়ে শঙ্করলাল ভট্টাচার্য  লিখছেন, ‘আমরা কানন দেবীর যে অতি রূপবান, ভারী ভদ্র, উচ্চমনা ও রসময় স্বামীটিকে দেখেছি, তিনি হরিদাস ভট্টাচার্য। সত্তর দশকের শেষ দু’বছর এবং আশির দশকের শুরুর বছর খানেক তাকে কয়েক বার দেখেছিলাম আনন্দবাজার পত্রিকার অপিস ঘরে। স্নিগ্ধ, সুপুরুষ প্রৌঢ় এসে বসতেন গৌরকিশোর ঘোষের টেবিলে। আমারও একটা জায়গা ছিল সে-ঘরে তখন। প্রথম দিন গৌরদা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘কী রে, চিনিস এঁকে?’’ 

বললাম, ‘‘আলাপ হয়নি। তবে চিনি।’’ 
সঙ্গে সঙ্গে হরিদাসবাবু পিছনে আমার দিকে ঘাড়ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কী করে চিনলেন?’’ 
বলেছিলাম, ‘‘আপনার করা ছবি দেখে।’’ 
বাড়াবাড়ি করছি না, কিন্তু সে দিন ওই কথায় ওঁর সোনালি ফ্রেমের চশমা ও কাঁচাপাকা চুলের (বেশিটাই পাকা) সুন্দর মুখে যে ভালো লাগার ছোঁওয়া দেখেছি, তা ভোলার নয়। গৌরদাও পরে বলেছিলেন, ‘‘তুই যে শুধু কানন দেবীর বর বলে ওঁকে চিনিস না, সেটা ওঁর ভাল লেগেছে।’’ 
১৯৪৯-এ কানন দেবীর বর হওয়ার আগে থেকেই কিন্তু হরিদাস ভট্টাচার্য কেউকেটা। যখন বিয়ে হচ্ছে, তখন তিনি ক্যাপ্টেন হরিদাস ভট্টাচার্য। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ড. কৈলাসনাথ কাটজুর এডিসি। কলকাতার মোস্ট এলিজিবল ব্যাচেলারদের এক। মেয়েরা ওঁকে বর আর তাদের মায়েরা ওঁকে জামাই করতে চায়। কিন্তু হঠাৎ একদিন এই যুবকের চোখ পড়ল কানন দেবীর ওপর।’
আর হরিদাস ভট্টাচার্য তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘‘এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম ড. কাটজুর সঙ্গে। সেখানেই দেখা কানন বালার সঙ্গে। প্রায় বাধ্য হয়েই সেখানে এসেছিল ও। সারাক্ষণ মঞ্চে থেকেও একটি কথাও বলেনি।’’ 
এরপর তাদের দ্বিতীয় দেখা রাজভবনে গান গাইতে এলেন যখন কানন। সেই আমন্ত্রণও হরিদাসই জানিয়েছিলেন। এর পর ফের সাক্ষাৎ যখন নায়িকার ছবির শ্যুটিং-এর পারমিশন জোগাড় করে দিলেন রাজ্যপালের এডিসি। কারণ লোকেশন হল সরকারি ঘেরাটোপের ফলতা। কাননের প্রেমের সঙ্গে আবার জুড়ে গেল ফলতা। কানন দেবী বলেছেন, একজন জীবনসঙ্গীর কাছে যা কিছু তার চাওয়ার ছিল, সবই পেয়েছিলেন হরিদাসের কাছে। সব চেয়ে বড় পাওয়া হরিদাসের মনের জোর। কাননের অতীত নিয়ে কোনওই প্রশ্ন বা কৌতূহল ছিল না ওঁর। বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে যা চর্চা লেগে গেল এবং কাগজপত্রে যা লেখালেখি শুরু হলো তাতে বিয়ে টেকানো তো তিন দিনের প্র্যাকটিসে ট্র্যাপিজের খেলায় নামার সামিল। কাননের বুকটা দমে যেত হরিদাসের কথা ভেবে। কিন্তু হরিদাসকে টলায় কে! তোয়াক্কাই করলেন না এসব কেচ্ছার কেত্তনের। বর-বৌয়ের সব ব্যাপারেই যে মতের মিল একই রকম। হরগৌরী যোগ, তাও নয়। কিন্তু ওঁদের সুন্দর ভাবে বেঁধে রাখল তিনটে জিনিস- ভেতরের টান, বাগানের নেশা আর সিনেমার প্রেম।
কানন ও হরিদাসকে নিয়েই একটা স্বতন্ত্র বৃত্তান্ত হয়, এবং সে-জন্য কানাঘুষোর ওপর নির্ভর করতে হয় না। ওঁদের দ্বৈত পরিচালনার শ্রীমতী পিকচার্সের ছবি তো বাংলা সিনেমার ইতিহাসে জায়গা নিয়েছে। প্রযোজিকা হিসেবে কানন দেবী এবং পরিচালক হিসেবে হরিদাস ভট্টাচার্য এক দুরন্ত হিট জুটি। শ্রীমতী পিকচার্সের প্রথম হিট ‘মেজদিদি’-তে হরিদাসসহ পরিচালক। তিনি স্বাধীনভাবে পরিচালনায় এলেন ‘নববিধান’ ও ‘দেবত্র’-য়। ‘দেবত্র’-য় একবারই মাত্র কানন দেবী, উত্তম ও সুচিত্রা সেনের ত্রয়ী একসঙ্গে পর্দায় এলেন। তবে হরিদাস ভট্টাচার্যকে আমরা ভুলিনি, ভুলব না, ‘আঁধারে আলো’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘ইন্দ্রনাথ, শ্রীকান্ত ও অন্নদাদি’, ‘অভয়া ও শ্রীকান্ত’ এবং থ্রিলার ছবি ‘শেষ অঙ্ক’-র জন্য। আর কানন দেবীকে তো বাঙালি প্রেমে পড়ে, নিন্দে করে, ভালোবেসে, গাল পেড়ে, তারপর বুকে ধরে কাটিয়ে দিয়েছে  যুগের পর যুগ। ‘আমি বনফুল’ গেয়ে বাঙালিকে এক কালে মাতিয়েছিলেন যে-নায়িকা, তাকে আর প্রশ্ন করার ছিল না ‘তুমি কোন কাননের ফুল, কোন গগনের তারা’? 
শেষ দিন অবধি অবশ্য হরিদাস ও কানন একসঙ্গে থাকতে পারেননি। ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। যদিও তার মাত্র ক’বছর আগে কানন দেবী আত্মকথায় লিখছেন, ‘‘যখন হরিদাস ভট্টাচার্যকে বিয়ে করি তখন লোকের ধারণা ছিল এ বিয়ে পনেরো দিন টিকবে হয়। সেই বিয়েই তো চব্বিশ বছর টিকে গেল।’’ ১৯৭৭ সালের জানুয়ারিতে হরিদাস ও কানন দেবী গিয়েছিলেন দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে। কানন দেবী সে দিন দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার নিলেন। আর ১৯৮৯ সালের এক দিন ওঁর টাকা-পয়সা, কাগজপত্র, শখের পিস্তল ও রিভলভার গুছিয়ে হরিদাস ওঁদের ১নং রিজেন্ট গ্রোভের বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। কিছু দিনের মধ্যে কানন দেবীও ১৭ই জুলাই, ১৯৯২-এ বেল ভিউ ক্লিনিকের এক নির্জন কেবিনে প্রায় চুপি চুপি সংসার ছেড়ে চলে গেলেন। সেই কেবিনের আশেপাশের কোনও একটিতে বছর কুড়ি বাদে জীবন শেষ করলেন সুচিত্রা সেনও। 
জীবনে সম্মান, মর্যাদা কেউ কারো হাতে তুলে দেয় না। অতি সহজ বস্তুও পাবার পথে বহু বিঘ্নতায় ভরা। অনেক পোড় খেয়ে, অনেক বেদনা বয়ে, অনেক রক্ত ঝরা অন্তর্দ্বন্দ্বের বন্ধুর পথে চলে কাননবালা দেবীর মতোন মানুষেরা বোঝেন পৃথিবীটা মোটেই সরল নয়। কঠিন পর্বতের মতো এবড়োখেবড়ো। গাঁইতি দিয়ে কেটে কেটে তাকে সমতল করে নিজের চলার পথ নিজে তৈরি করে নিতে হয়। এই পথের বিবরণ জানাবার তাগিদ পাওয়া যায় তার আত্মজীবনীতে। জীবনে কোনো কাজের সাফল্য লাভই যে কঠিন নয়, সেটা সুষ্পষ্ট হয় তার স্মৃতিচারণ পাঠে। পথের মেয়ে থেকে তিনি জেদ, সংগ্রাম এবং আত্মবিশ্বাসের জোরে নিজেকে উন্নীত করেছিলেন অনন্য উচ্চতায়। সত্যিই এমন একটা মহৎ জীবন আমাদের বহু কিছু শিক্ষা দেয় আজও। বাংলা ছবির হার্টথ্রব নায়িকা-গায়িকা, ভারতীয় চলচ্চিত্রের মহা তারকা কানন দেবীর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
(সমাপ্ত)