দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যখন সবাই বাড়ী ফিরে আসে তখন নাকি ভিটেতে শিয়ালমতি গাছ হয়েছিলো।

লেখিকাঃ মৌসুমী চৌধুরী

আমি একজন হিন্দু, বাড়ী বাংলাদেশে। ক্লাস সিক্সের সমাজ বইয়ে পড়েছিলাম সিন্ধু নদের তীরে আমার পূর্বজরা ছিলো বলে আমাদের নাম হয়েছে হিন্দু। আমি কখনও ঐ নদ দেখি নি, নদটি এখন পাকিস্তানের। শুনেছি আমাদের সভ্যতার নাম মহেঞ্জেদারো-হারাপ্পা। আমি কখনও যাই নাই আমার সভ্যতার পটভূমিতে। আমার ধর্মের একটি পবিত্র নদীর নাম “গঙ্গা” বাংলাদেশে এসে এই নদীর নামই হয়েছে “পদ্মা”। বছরে একটি দিন “মা গঙ্গা” বাংলাদেশের নদীতে আসেন ঐদিন অষ্টমী স্নান হয়। নয়তো “গঙ্গা” নাইতে আমাকে কোলকাতা যেতে হয়।

আমি হিন্দু, আমার প্রধান ধর্ম গ্রন্থের নাম বেদ। বেদ সংস্কৃত ভাষায় লেখা। শুনেছি বাংলার উৎপত্তি সংস্কৃত থেকে কিন্তু সংস্কৃতের প্রথম অক্ষর কি আমি জানি না। বাংলা ভাষা থেকে বাংলাদেশের সংস্কৃতি সবই নাকি হিন্দুয়ানী, সবই আমাদের। মানে হিন্দুদের।

যখন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো তখনও আমরা হিন্দু ছিলাম। যুদ্ধের পরে কিছুদিন বোধ হয় মানুষ হিসেবে গোনা হত আমাদের। তারপর নিজের দেশেই আমরা আবার হিন্দু হয়ে গেলাম।

আমাদের বাড়ীটা একটা সময় অনেক বড় ছিলো এটাও আমি শুনেছি। আমার ঠাকুরদাদার দুই ভাই সাত বোন ছিলেন। তিন ভাইয়ের আবার দশজন করে ছেলে মেয়ে ছিলো। ১৯৬৩ সালের পরে আমার ঠাকুরদাদার বড় ভাই (আমার বাবার জ্যাষ্ঠা) কাউকে কিছু না বলে বর্ধমান চলে যায়। ১৯৭১ সালে আমার ঠাকুরদা যখন তাঁর ছোট ভাইকে নিয়ে কোলকাতা যায় তখন আমাদের পরিবারের মেয়েদের ওখানে রেখে ফিরে আসে সবাই। ফিরে এসে কিন্তু কোলকাতা আর ফিরে যান নি তারা। ১৯৭৫ সালে যখন বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলে তারপরে অর্ধেক বাড়ীর জমি বিক্রি করে দেয় দুই ভাই মিলে কারণ কোলকাতা চলে যাবে। কিন্তু আমরা আজও বাংলাদেশেই থাকি। আমার ঠাকুরদাদা আর তাঁর ছোট ভাইয়ের কোলকাতা ভালো লাগে নাই।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে যখন সবাই বাড়ী ফিরে আসে তখন নাকি ভিটেতে শিয়ালমতি গাছ হয়েছিলো। পাকিস্তানিরা সব পুড়িয়ে দিয়েছিলো। শুনেছি তখনই লুট হয়েছিলো আমাদের রূপার খগড় যা দিয়ে বাড়ী মহিষ বলি হত। ছোট থেকেই আমাদের বাড়ীর সব ঘর কাঁচাই দেখেছি। আমি যখন একটু বড় হই বাবা ঘর দিবে। বিল্ডিং ঘর। সবার আপত্তি তাতে দেশের অবস্থা ভালো না। কখন কি হয়? আমাদের বাড়ীর সব ঘর এখন আধা পাকা। দেশের অবস্থা ভালো না। কখন কি হয়?

এই তো কিছুদিন আগে বেশ কয়েকবার বাবাকে নিয়ে কোলকাতা যেতে হলো ডাক্তার দেখাতে। বাড়ী ফিরে এলাকার লোকদের প্রশ্ন শুনলাম “কি রে তোরা নাকি ইন্ডিয়া যাইতোস গা”? কত লোক এলো বাড়ীতে “আপনারা ইন্ডিয়া গেলে গা আমগোরে ৪ শতাংশ জমি দিয়া যাইয়েন”।

আজ ১১ নভেম্বর ২০১৭। আমি বসে বসে এইসব লিখছি কারণ গতকাল রংপুরে হিন্দুদের বাড়ীঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে, লুটপাট হয়েছে। ওরা বাংলাদেশেরই হিন্দু ঠিক আমার মতোই। হয়তো ওদেরও ঠাকুরদাদাও কোলকাতায় যাই যাই করেছিলো। আমার ঠাকুরদাদার বড় ভাইয়ের মতো হয়তো অনেকে চলেও গেছে। অনেকে এখনও যাচ্ছে। বাংলাদেশের হিন্দুদের অবস্থা বনের চঞ্চল হরিণের মতো। হরিণের মাংস যেমন হরিণের শত্রু ঠিক তেমনি হিন্দু সম্পত্তি হিন্দুদের শত্রু। হরিণকে যেমন শিকারীরা বনে ঢুকে শিকার করে তেমনি হিন্দুদেরও হিন্দুদের বাড়ীতে ঢুকেই অত্যাচার করে।

আমি বাংলাদেশের হিন্দু, বাংলাদেশেই থাকি, বাংলাদেশেই থাকবো। তোমরা বরং বাংলাদেশেই আমায় শিকার করো। বনের হরিণের মতো!