হজের সময় যে কালো ঘরকে ঘিরে সাতবার পাঁক দেয় হাজি সাহেবরা, সেভাবেই, হয়ত ঈর্ষৎ একটু অন্যভাবে আবু জাহেল, আবু সুফিয়ান, আবু তালিবরা হজ করতেন। হজের ব্যবস্থাপনা এই কুরাইশদের হাতেই ছিলো যুগ যুগ ধরে। কিন্তু দুনিয়ার কোন ধর্মীয় সূত্রেই দাবী করেনি মুসা বা যীশু মক্কায় গিয়ে হজ করে এসেছেন। অথচ তাদের তো আল্লার এই সর্বশেষ ঠিকানায় একবার হলেও আসা উচিত ছিল। ইসলাম দাবী করে হযরত আদম থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মদ পর্যন্ত সবাই মুসলমান ছিলেন এবং তারা সবাই ইসলামই প্রচার করেছেন। তাহলে কাবাঘরের কথা ইহুদী, খ্রিস্টান ধর্মে বার বার উচ্চারিত হওয়ার কথা। এই ঘর যে ইব্রাহিম তৈরি করেছিলেন সেকথা উল্লেখ থাকার কথা। যেমনটা বাইতুল মোক্কাদেসের বেলায় হয়েছে। বাইতুল মোকাদ্দেসকে পবিত্র হিসেবে ইসলাম, ইহুদী, খ্রিস্টান তিন ধর্মই মানে। কিন্তু কাবাঘরকে এক ইসলাম ছাড়া বাকী দুই ধর্মে কোন উল্লেখই নেই!
ইহুদী-খ্রিস্টানরা তাদের কিতাব বিকৃত করে ফেলেছে- এই দাবী এখানে ধোপে টেকবে না। কারণটা কাবাঘর অথনৈতিকভাবে খুবই উপদেয় একটা মাধ্যম ছিল সেই প্রাচীনকাল থেকেই। কুরাইশদের আয়-রোজগারের অন্যতম একটা উপায় ছিল হজ এই কাবাঘরকে কেন্দ্র করে। ইহুদীরা তাদের কিতাবের আর সব বিকৃত করে ফেলতে পারে নিজ স্বার্থে কিন্তু নিজের ভাগ কি ছেড়ে দিবে? যদি কাবাঘর ইব্রাহিমের হাতে তৈরি হতো তাহলে এটা ইহুদীদের জেরুজালেমের পর দ্বিতীয় পবিত্র তীর্থ হতো। ইব্রাহিম ইহুদীদের অন্যতম সম্মানিত নবী। কাজেই মক্কার কাবা ইহুদীদের অন্যতম তীর্থ ক্ষেত্র হওয়ার কথা। হলো না কেন?
হযরত মুহাম্মদের দাদাজান আবদুল মোতালিবের ধর্ম কি ছিল? এই প্রশ্ন অনেক ইসলামী স্কলারের কাছে করে ভিত্তিহীন উত্তর পেয়েছি। আবদুল মোতালিবের ধর্ম ছিল ইব্রাহিমি একেশ্বরবাদ। এটি পরিস্কার মিথ্যাচার। আবদুল মোতালিব যদি ইব্রাহিমি তথা সেমিটিক ধর্মের অনুসারী হবেন তো তিনি মক্কার কাবাঘরের রক্ষাকর্তা বা এর দেখভালের যোগ্য হন কিভাবে? যে কাবাঘরে বহু ঈশ্বরবাদের আরাধনা চলত সেখানে আবদুল মোতালেবই বা যাবেন কেন? বহু ঈশ্বরবাদের পুজারী কুরাইশরা কেন আবদুল মোতালিবকে তাদের নেতা মান্য করতে যাবে? নিশ্চিত করেই তাই বলা যায় আবদুল মোতালেব ছিলেন একজন আরব পৌত্তলিক বহু ঈশ্বরবাদের পুজারী। এর প্রমাণ আছে ইসলামের দলিলে। কাবাঘর ভাঙ্গতে আসা রাজা আবরাহারের ঘটনাটা আসুন একটু দেখে আসি…।
রাজা আবরাহার মক্কা আক্রমণ করতে আসছেন জেনে কুরাইশদের নেতা আবদুল মোতালিব রাজা আরবাগের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। আবদুল মোতালিব জানালেন, রাজার বাহিনী তার দুশো উট ধরে নিয়ে এসেছে তিনি সেটা ফেরত চান। রাজা আবরাহা ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, তোমার বাপ-দাদার ধর্মের কেন্দ্রে যে কাবাঘর আমি সেটাকে ভাঙ্গতে এসেছি আর তুমি বলছ দুশো উটের কথা বলছ!… আবদুল মোতালিব বললেন, আমি শুধু দুশো উটের মালিক, কাবাঘরের যে মালিক তিনিই তার ঘর রক্ষা করবেন…।(সূত্র: ইবনে হিশাম, কা’বা ধ্বংস করতে আবরাহার অভিযান, পৃষ্ঠা- ৭৫)
আবদুল মোতালিব এতটাই নির্ভার ছিলেন তার “আল্লাহ” উপর। গোটা ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায় ইসলামের শত্রু কাফের আরব কুরাইশরা আল্লাহর কসম কাটছে, আল্লাহর সাহায্য চাইছে, আল্লার গজব চাচ্ছে, মাঝে মাঝে ধন্ধে পড়ে যেতে হয় মুহাম্মদের সঙ্গে তাদের বিরোধটা তাহলে কি নিয়ে? গোটা ইসলামের ইতিহাসটা যাচাই করলে দেখা যায়- মুহাম্মদ স্রেফ একটা ধর্ম প্রচার করলে তার স্বজাতি আরবরা মোটেই সেটাকে বড় করে দেখতেন না। মক্কায় ইসলাম ঘোষণার ১৩ বছরে মাত্র শতাধিক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করলে এই ধর্মের ভবিষ্যত নিয়ে খোদ মুহাম্মদেরই চরম হতাশা জেগে উঠে। আরব পৌত্তলিকদের কাছে ছিল ইসলাম এক হাস্যরসের বিষয়। মদিনায় হিযরত করার পর হযরত মুহাম্মদ মূলত একটি সশস্ত্র চরমপন্থা আন্দোলর শুরু করেন। এই রাজনৈতিক মুভমেন্ড এক পর্যায়ে গোটা আরবে যুদ্ধের দাবামা বাজিয়ে তোলে। কাজেই হযরত মুহাম্মদ আর তার স্বজাতিদের মধ্যে যে বিবাদ তা রাজনৈতিক।
আবদুল মোতালিবের যুগে আরব পৌত্তলিকদের কাবাঘরে ৩৬০টি মূর্তি নিয়ে ‘আল্লাহ’ প্রধান দেবতা। স্বয়ং আবদুল মোতালিব তৎকালিন পৌত্তলিক ধর্মীয় বিশ্বাস মতে যে কোন ফয়সালার জন্য কাবায় রক্ষিত হুবাল দেবতার কাছে রক্ষিত সাতটি তীর ছুড়ে সিদ্ধান্ত ঠিক করতেন। নিজ পুত্র আবদুল্লাহকে তিনি কাবার পাশে কোরবানী দিতে চাইলে প্রতিবেশীরা বাধা দেন। আবদুল মোতালিবের যমযম কূপ খননের সময় আল্লাহ’র কাছে শপথ করেছিলেন যে তার যদি দশটি ছেলে জন্ম নেয় তাহলে একটিকে তিনি আল্লাহ’র নামে জবাই করে উৎসর্গ করবেন। তার দশম সন্তান জন্মালে তিনি তার শপথ রক্ষা করতে তীর ছুড়ে সন্তান নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। আবদুল্লাহ নাম লেখা তীর উঠে আসলে আবদুল্লাকেই বলি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু কারইশদের বাধার মুখে এর বিকল্প কি হতে পারে জানতে হুবাল দেবতার কাছে রক্ষিত তীর ছুড়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যবস্থা হয়। আবদুল মোতালিবের ধর্ম কি ছিল এই ঘটনাটাও একটা প্রমাণ। (সূত্র: ইবনে হিশাম, আবদুল মোত্তালিব কর্তৃক নিজ সন্তানকে কুরবানী করার মানতের বিবরণ, পৃষ্ঠা- ১৪৯)। তো এই কাবাঘরের চাবিই আবদুল মোতালিবের জিম্মায়। তিনিই কাবার প্রধান খাদেম। প্রধান পুজারী। বছরান্তে যে মেলা হয় (হজ) সে সময় যে বিপুল অর্থ অর্জন হয় মূলত তা থেকেই কুরাইশদের হাশিমি গোত্রের প্রধান উপার্জন। রাজা আবরাহা আবদুল মোতালিবের উট ফিরিয়ে দিলেন। কিন্তু তিনি মক্কার কাবাঘর অভিযান করবেনই। মূর্তি পূজারী কুরাইশরা এবার তাদের প্রধান দেবতা আল্লাহ’র কাছে সমবেত হলো কাবাঘরকে রক্ষা করতে। আবদুল মোতালেব কাবার দরজার চৌকাঠ আকড়ে ধরে বললেন, হে আল্লাহ! একজন দাসও তার দলবলকে রক্ষা করে। অতএব তুমি তোমার ঘর ও লোকজনকে রক্ষা করো।(সূত্র: ইবনে হিশাম, কা’বা ধ্বংস করতে আবরাহার অভিযান, পৃষ্ঠা- ৭৫)
এ কাহিনীর বাকীটুকু বলার আগে আসুন স্মরণ করি আবদুল মোতালিবের পুত্র আবু তালিবের কথা। হযরত মুহাম্মদ তার মৃত্যু শয্যায় গিয়ে বার বার বলছিলেন কলেমা পাঠ করতে তাহলে তিনি বেহেস্তে যেতে পারবেন নতুবা নবীর প্রিয় চাচা হবার পরও তাকে অনন্তকাল দোযগের আগুনে পুড়তে হবে মুশরিক হওয়ার কারণে… (সূত্র:সহি বুখারী, বই – ২৩, হাদিস নং-৪৪২)। আবু তালিব মুশরিক হলে তার বাপ আবদুল মোতালিব মুমিন বান্দা হন কিভাবে? যে আল্লাহর ঘরের চৌকাঠ ধরে আবদুল মোতালিব সাহায্য চেয়েছিলেন সেই আল্লাহকে তো আবু তালিব মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন। এতটাই করেন যে স্নেহের ভাতিজা মুহাম্মদের নতুন ধর্মকে তিনি গ্রহণ করতে পারেননি। আবু তালিব মুশরিক ছিলেন। তিনি তাই দোযগে যাবেন। একই ভাবে নবীর বাবা মা হওয়ার পরও আমিনা আর আবদুল্লাহও দোযগের আগুনে পুড়বেন! মুশরিক হওয়ার কারণে মুহাম্মদ তার পিতা-মাতা কবর জিয়ারতও করতেন না! কারণ তিনিই ঘোষণা করেছিলেন মুশরিকদের জন্য দোয়া করা যাবে না। আবদুল মোতালিবও তাই অনন্ত আগুনে পুড়তে থাকবে দোযগে।… কিন্তু একি দেখছি এখানে? কাবাঘরে ৩৬০টি মূর্তি রেখে পূজা করে যদি কুরাইশরা ইব্রাহিমের ধর্মকে আর তার আল্লাহর সঙ্গে শিরক করেই থাকে তাহলে হাজার হাজার বছর ধরে চলতে থাকা শিরককে আল্লাহ মুক্ত করতে পারলেন না কেন? ওদিকে রাজা আবরাহা যখন কাবাঘর ভাঙ্গতে আসলো তখন তো ঠিকই আসমান থেকে তিনি তার বাহিনী পাঠিয়ে দিলেন! উল্লেখ্য আবদুল মোতালিব কাবাকে কুরাইশদের কিবলা বলে উল্লেখ করেছিলেন। ইহুদী-খ্রিস্টান ধর্মে কিবলা বা নিশানা বলতে কিছু নেই। এসব পৌত্তলিক ধর্মের অনুসঙ্গ। নিরাকার ঈশ্বরের কোন নিশানার প্রয়োজন হয় না। ইসলাম ধর্মে কিবলা প্রথমে ছিল বাইতুল মোকাদ্দেস ও পরে আরবদের প্রধান মন্দির কাবা। এ প্রসঙ্গে আরো বলা দরকার আবদুল মোতালিবের ভাতিজা ইকরামা আল্লাহ কাছে প্রার্থনা করার সময় বলেছিল, রাজা আবরাহা কুরবানীর চিহৃ দেওয়া উট ধরে নিয়ে গিয়ে যে অপরাধ করেছে তার জন্য যেন তাকে লাঞ্ছিত করা হয়…। এতে বুঝা যায় কুরবানী প্রথা কুরাইশ পৌত্তলিকদের মধ্যে আগেই প্রচলিত ছিল যা পরে ইব্রাহিমের কাহিনী জুড়ে দিয়েছিল মুহাম্মদ। যদিও ইহুদীদের মধ্যে ঈমুল আযহা প্রচলিত ছিল। মুহাম্মদ সেটাকে আর আবদুল মোতালিবদের কুরবানীকে এক করে একটা ককটেল বানিয়েছেন মাত্র। আরো একটি বিষয় বলা দরকার, “কাফির” বলে ইসলাম অমুসলিমদের প্রতি যে ঘৃণা প্রকাশ করে সেটা আরব কুরাইশরা অনারবদের অনুরূপ “কাফির” বলে ঘৃণা প্রকাশ করতো। মুহাম্মদ পরবর্তীকালে সেই শব্দই তার নতুন ধর্মকে অবিশ্বাসকারী সকলকেই কাফির বলে ঘৃণা প্রকাশে ব্যবহার করতো। এ জন্যই কাফির, মুশরিক এ ধরণের আরব ঘৃণার প্রকাশ খ্রিস্টানদের মধ্যে ইহুদীদের প্রতি নেই। আবার ইহুদীদের মধ্যে ফেরাউনদের প্রতি নেই। এই শব্দগুলো একান্তই আরব পৌত্তলিকদের নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস বা জাতীয়ততার বহির্প্রকাশ।
রাজা আবরাহা মক্কার কাবাঘরে আক্রমন করলেন। মুহাম্মদের জন্মের বহু আগের ঘটনা এসব। সমুদ্রের ওপার থেকে এক ধরণের ছোট ছোট পাখি ঠোটে আর দুপায়ে ছোট মটর দানার মত পাথর নিয়ে এসে উপড় থেকে আবরাহের সৈন্যদের উপর ফেলতে লাগলো। পাথর যার মাথায় পড়তে লাগল সে-ই মারা যেতে থাকল। রাজা আরবাহা পরাজিত হয়ে ফিরে গেলেন। আবদুল মোতালিবরা যার যার ঘরে ফিরে আসলেন বিজয়ী বেসে। এ ঘটনায় নিশ্চয় তাদের ধর্ম ও তাদের ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস ও অনুরাগ আরো বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। সে বছর কাবাঘরের বার্ষরিক মেলা (হজ) নিশ্চয় অনেক বেশি জাঁকজমকভাবে হয়েছিল। আল্লাহ ও তার তিন কন্যা নিশ্চয় অনেক বেশি করে পূজিত হয়েছিল। কারণ আল্লাহ ভয়ংকর রাজা আবরাহার হাত থেকে কাবা ও কুরাইশদের রক্ষা করেছিলেন।…
বুঝাই যাচ্ছে কাবায় কোন এক রাজা আক্রমন করেছিল এক সময়। সে হয়ত পরাজিত হয়েছিল বা ধ্বংস না করেই চলে গিয়েছিল। বা ধ্বংস খানিকটা করেছিল। পরবর্তীকালে আরব পৌত্তলিকদের ধর্মে কিংবদন্তি হিসেবে কাবাঘরে আক্রমণ ও দেবাদিদেবা আল্লাহ পাখির ঠোটে পাথর দিয়ে কাবাঘরেক রক্ষা করেছিলেন বলে গল্প প্রচলিত হয়। নূহের প্লাণ এরকমই এক প্রাচীন জলোচ্ছাস যা বহু জাতির জীবনে প্রভাব ফেলেছিল। এরপর তাকে ঘিরে বিভিন্ন জাতির মধ্যে মিথ, কিংবদন্তি গড়ে উঠে যা তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতিতে মিশে যায়।…
যে আল্লাহ মুহাম্মদের হাত থেকে তার ৩৬০টি মূর্তিকে রক্ষা করতে পারেননি তিনিই আবাবিল পাখি দিয়ে নিজের ঘর রক্ষা করেছিলেন! যিনি মুহাম্মদের কাছে নিজে নামটি পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেননি! ভবিষ্যতের আরো কোন ক্ষমতাবাণ “আল্লাহ” কাছে তিনি যদি তার কাবাঘরকে মিসাইলের আঘাত থেকে রক্ষা করতে না পারেন তো অবাক হবো না…।
(তথ্য সূত্র: সিরাতুন নবী, ইবনে হিশাম, প্রথম খন্ড)