বালিকার ক্রন্দনধ্বনি…

বালিকার ক্রন্দনধ্বনি…

পর্ব একঃ
এমনই এক দোলপূর্ণিমার নিশি।

বালক মুর্শিদাবাদের ইতিহাস পাঠ করছিলো। মুর্শিদকুলি খান থেকে যে ইতিহাসের শুরু, নিজাম-উদ-দৌল্লায় শেষ।

অনতিদূরে কীরিটেশ্বরী মন্দির।

ভগ্ন, জরাজীর্ণ মন্দিরের পাঁজর থেকে খসে পড়া শেষ ইঁটটির গায়ে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন রাজা দর্পনারায়ণ ।

হয়তো ভাবছিলেন কালচক্র কি আবার উল্টোদিকে ঘুরবে? মহারাজা নন্দকুমার কি আবার কোনোদিন বার্তা বয়ে আনবেন, যে নবাব মীরজাফর জানিয়েছেন,  অন্তিম সময়ে দেবীর চরণামৃত পান করে ধরাধাম ত্যাগ করতে ইচ্ছুক।

বালক ঘুমিয়ে পড়ে।

তারও একটু দূরে , দেবীনগর যাওয়ার পথ।

খবর এসেছে, গোলাম মহম্মদ পরাস্ত এবং মৃত। মুর্শিদকুলি খানের সৈন্যবাহিনী ক্রমেই এগিয়ে আসছে; তার একমাত্র লক্ষ্য, স্বীয় পুত্র সহ
রাজা উদয়নারায়ণকে বন্দী করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা।

প্রাণ তুচ্ছ, কিন্তু ধর্মত্যাগ আক্ষরিক অর্থে হোল বিনাশ যা কোনোভাবেই করা যায় না।

উপাস্য শ্রী শ্রী মদনগোপালকে শেষবারের প্রণাম জানিয়ে বিষপূর্ণ পাত্রের তলানিটুকুও তাই গলায় ঢেলে দেন রাজা উদয়নারায়ণ।

হতভাগ্য জাতির ভাগ্যাকাশে ছায়া ঘনিয়ে আসে।

*********************

পর্ব দুইঃ
বালক ঘুমিয়ে পড়ে। দমকা হাওয়ায় বইয়ের পাতাগুলি আপনা থেকেই উল্টাতে থাকে।

…..” ম্যায় নেহি যাউঙ্গি , ছোড় দো মুঝে………..।”

মহাতপ রায়ের একাদশ বর্ষীয়া বালিকা বধূর করুণ আর্তনাদ আছড়ে পড়ছিলো প্রাসাদের কোণায় কোণায়। বৃদ্ধ ফতেচাঁদ তখনও হয়তো বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে কী ঘটে চলেছে।

নারী অপহরণ?! সেতো অনেকদিন ধরেই চলছে। সরফরাজ খান কাউকে বাঁচতে দিচ্ছিলেন না। সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পরে সিংহাসনে বসার দিন থেকে যে মহিলা নবাবের কুনজরে পড়েছেন, সবার একই পরিণতি..

তবু ফতেচাঁদের বিশ্বাস ছিল, জগৎশেঠের পরিবারের সম্মান নিয়ে ছেলেখেলা করার সাহস নবাব দেখাবেন না।

কম সময় ধরে তো তারা নবাবের বংশের সেবা করেননি। সেইবার দিল্লির বাদশাহ মহম্মদ শাহ যখন ক্রুদ্ধ হয়ে মুর্শিদকুলি খাঁ কে পদচ্যূত করতে মনস্থির করলেন, ফতেচাঁদই বাদশাহের রোষবহ্নির হাত থেকে নবাবকে রক্ষা করেন। সেই প্রয়াত মুর্শিদকুলি খানের দৌহিত্র সরফরাজ খানই আজ সিংহাসনে। কৃতজ্ঞতার জন্যই , ফতেচাঁদ, ভেবেছিলেন হয়তো ………

তাই প্রথম যেদিন নবাব জানালেন, ফতেচাঁদ এর পুত্রবধূর সৌন্দর্যের গল্প তাঁর কানে এসেছে, নবাব তাঁকে দেখতে ইচ্ছুক; সেদিন নিজের কানকেই হয়তো বিশ্বাস  করে উঠতে পারেননি ফতেচাঁদ ।

মিনতি করেছিলেন বৃদ্ধ, পূর্ব কৃতজ্ঞতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে, বলেছিলেন অসূর্যম্পর্শ্যা শেঠ পরিবারের পুত্রবধূর এরকম মানহানি ঘটলে তাঁর বংশে কলঙ্ক ঘটবে, জাতিচ্যূত হতে হবে গোটা পরিবারকে।

উত্তরে নবাব শুধুই অট্টহাসি হেসেছিলেন। হাসির অর্থ সম্যক বুঝতে পারেননি ফতেচাঁদ কিংবা হয়তো বুঝতে চাননি।

সব পরিষ্কার হয়ে গেলো যখন নবাবের ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর দল জগৎশেঠের প্রাসাদ ঘিরে ফেললো। একাদশ বর্ষীয়া ক্রন্দনরতা বালিকাকে তুলে নিয়ে গেলো তারই স্বামী এবং শ্বশুরের সামনে দিয়ে।

অসহায় ভাবে তাকিয়েছিলেন ফতেচাঁদ , তারই মাতাজি মানিকদেবীর প্রতিষ্ঠা করা জৈন মন্দিরে বসে। অদূরে মহাতপ রায় বসে মাথা চাপড়াচ্ছিলেন।

এগারো বছর বয়সী নারীমাংসের সম্ভোগপর্ব শেষ হয়ে গেলে শেষ প্রহরে যখন রক্তাক্ত মৃতপ্রায় বালিকাকে নবাবের বাহিনী যখন পৌঁছে দিয়ে গেলো, তখনও ফতেচাঁদ একইভাবে বসে আছেন।

অর্ধচেতন বালিকার মুখটি একটু তুলে বিড়বিড় করে কী যেন বললেন বৃদ্ধ। বালিকা শুনে পরম শান্তিতে চোখ বুজলো।

পরের দিন, শেঠ পরিবারের পুত্রবধূর মৃতদেহ নিয়ে একটি ছোট্ট দল বেরোলো জগৎশেঠের প্রাসাদ থেকে। মুর্শিদাবাদের আবাল বৃদ্ধ বনিতা, সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলো, সবার আগে রয়েছেন এক অশীতিপর বৃদ্ধ , থেকে থেকেই বিড়বিড় করে কি যেন বলে চলেছেন ….

তারও কিছুদিন পরে….

উড়িষ্যায় অবস্থানরত হাজী মহম্মদ আর আলীবর্দী খানের কাছে দুইখানি পত্র পৌঁছে গেলো। দুটি পত্রেরই ভাষ্য মোটামুটি এক। এক বৃদ্ধ লিখছেন, এক বালিকার ক্রন্দনধ্বনি তাকে তাড়া করে বেড়ায়। তাই, প্রতিশোধ চাই। কোষাগারে সঞ্চিত শেষ তঙ্খাটি অব্দি তিনি খরচ করতে প্রস্তুত।

প্রতিশোধ চাই, নির্মম প্রতিশোধ…

পরিণামস্বরূপ গিরিয়ার যুদ্ধে আলিবর্দীর কাছে পরাজিত হয়ে মাটিতে আছড়ে পড়লো ধূলিধুসরিত নবাবের দেহ। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে সরফরাজের  কি মনে পড়ছিলো এক একাদশ বর্ষীয়া বালিকার আকুল কান্না, এক বৃদ্ধের বিড়বিড় করে কিছু বলে যাওয়া…..।

নারীর সম্মানে আঘাত করলে নৈতিকতার মূল সূত্র ও ইতিহাস কোনটিই দুষ্টকে ক্ষমা করে না, জীবন দিয়ে তাকে প্রাপ্য চোকাতে হয়। তাই হল সর্বোত্তম প্রায়শ্চিত্ত। জীবনের একটি অর্থ যদি হয় সংগ্রাম, অপরটি হল সম্মান।

লেখকঃ শ্রী চয়ন মুখার্জী…।

অঙ্কন শিল্পী: শ্রীমতি পৌলমী গঙ্গোপাধ্যায়

সৌজন্যেঃবঙ্গদেশ পত্রিকা…

লিঙ্কঃ https://www.bangodesh.com/2018/08/cry-of-a-girl/