ভয়ঙ্কর ও বিভৎস , ভারতের ভুলে যাওয়া গণহত্যা ::::: ১৯৪৩-৪৪ সালে ভারতের দুর্ভিক্ষ বিশ শতকে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় দুর্যোগ। এই দুর্ভিক্ষে ৪০ লাখের উপর মানুষ মারা গিয়েছিলেন। এর কারণ ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক কৃত্তিমভাবে খাদ্য সংকট সৃষ্টি। খাবার ব্যবস্থাপনায় স্বেচ্ছায় তৈরি করা সংকটের কারণে এত বিশাল সংখ্যক লোকই মারা গিয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে এতবড় দুর্ভিক্ষ আর ঘটেনি।
এই বিপর্যয়ের মাত্রা ও সময়কালের সবচেয়ে লক্ষণীয় দিক হচ্ছে এর সময়কাল। তখন চলছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং হিটলারের জার্মানি পুরো ইউরোপকে তছনছ করে ফেলেছিল। ইহুদি, স্লাভ ও রোমাদেরকে নির্মূলের পথে এগোছিলেন হিটলার। খুব লক্ষণীয় হল, যেখানে হিটলারকে ১২ বছর নিতে হয়ছে ৬০ লাখ ইহুদিকে নিধন করার ফর্মূলা নিয়ে আসতে সেখানে তাদের সমগোত্রীয় ব্রিটিশরা মাত্র একবছরের মধ্যেই ৪০ লাখ ভারতীয়কে দুর্ভিক্ষে শেষ করে দিয়েছিল। সেই দুর্ভিক্ষে ভারতেদের মৃত্যুতে অপর পাশে উইনস্টন চার্চিল উল্লাস করছিলেন।
অস্ট্রেলিয়ান প্রাণী- রসায়নবিদ ড.গিদেনপলইয়া তৎকালীন বাংলার ঐ দুর্ভিক্ষকে ‘মানবসৃষ্ট গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন । কারণ চার্চিলের নীতিই ঐ দুর্যোগের জন্য দায়ী ছিল। ১৯৪২ সালেও বাংলায় আশাতীত ফলন হয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশরা বিশাল পরিমাণ খাদ্যশস্য ভারতের থেকে ব্রিটেনে নিয়ে যায়। যার ফলে এখানে ব্যাপক খাদ্যাভাব দেখা যায়। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা এবং বিহারে ঐ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল।
চার্চিল ঐ গোপন যুদ্ধ নিয়ে তিনি লিখেন: “মা বাবারা তাদের ক্ষুধার্ত ছেলেমেয়েদেরকে কূয়াতে ও নদীতে ফেলে দিতো। অনেকে ট্রেনের সামনে নিজেকে ফেলে দিয়ে আত্মহত্যা করতো। ক্ষুধার্ত মানুষ ভাতের মাড় চেয়ে ভিক্ষা করতো। শিশুরা পাতা, ফুল, ঘাস এবং বিভিন্ন তৃণ খেত। মানুষ এতই দুর্বল ছিল যে তারা তাদের প্রিয়জনদের সত্কার করতে পারত না।” শেষকৃত্য করার মত কারও গায়ে শক্তি ছিল না। বাংলার গ্রামগুলোতে মরদেহের স্তূপ থেকে কুকুর শিয়ালরা তাদের ভুরিভোজ করতো। মায়েরা খুনিতে পরিণত হয়েছিল, গ্রামগুলো পতিতাপল্লীতে আর বাবারা ছিল কন্যা সন্তান পাচারকারী।’ডাক্তার মনি ভৌমিক একজন বিখ্যাত চিকিৎসাবিদ, দুর্ভিক্ষ নিয়ে ওনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আছে। তিনি বলেন, তার ঠাকুমার খাবারের ভাগে তার পেট ভরত এবং খাদ্যাভাবে ওনার মৃত্যু ঘটে।
১৯৪৩ সালে ক্ষুধার্ত মানুষের দল কলকাতায় এসে ভিড় জমায় যাদের বেশিরভাগই রাস্তায় মারা যায়। চার্চিল খুব সহজেই এই দুর্ভিক্ষটি এড়াতে পারতেন। এমনকি কয়েক জাহাজ খাবার পাঠাইলেই অনেক উপকার হতো। কিন্তু একে একে দুজন ভাইসরয়ের আবেদনকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এমনকি তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির আবেদনের প্রতিও কর্ণপাত করেনি।
এরকম ধ্বংসযজ্ঞের মাঝে হৃষ্টপুষ্ট ব্রিটিশ সেনাদের উপস্থিতি ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে শেষ রায়’ হিসেবে দেখেন ইংরেজভক্ত জওয়াহারলাল নেহরু।নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু তখন এই দুর্ভিক্ষর বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন। তিনি মায়ানমার থেকে চাল পাঠানোর প্রস্তাব করেন। ব্রিটিশরা তো তার চাল আসতে দেয়নি এমনকি সুভাস বসুর প্রস্তাবের খবরটি পর্যন্ত চাপা দিয়ে রেখেছিল।
নিষ্ঠুর চার্চিল ভারতীয়দের মৃত্যুর মিছিলে রেখে খাদ্য শস্য ব্রিটিশ সেনা ও গ্রীক নাগরিকদের জন্য পাঠাচ্ছিলেন। তার কাছে ‘ক্ষুধার্ত বাঙালীর না খেয়ে থাকার চেয়ে সবল গ্রীকদের না খেয়ে থাকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।’ তার এই মতের সাথে একমত হয়েছিলেন ভারতীয় ও বার্মা বিষয়ক মন্ত্রী লিওপল্ড এমেরি।ঐ দুর্ভিক্ষটা ব্রিটিশ শাসিত অঞ্চলে মানুষের উপর নামা সবচেয়ে বড় দুর্যোগ।যখন হল্যান্ডে খাদ্যাভাব দেখা দেয়, তখন বলা হয় খাদ্য জাহাজ অবশ্যই সরবরাহ করা হবে কিন্তু ভারতে খাদ্য আমদানি বন্ধ রাখা হয়।
চার্চিল ওয়ার কেবিনেট মিটিং-এ, এই দুর্ভিক্ষের জন্য ভারতীয়দের দায়ী করেন। ‘এরা খরগোশের মত বাচ্চা জন্ম দেয় ’ এমন অশালীন মন্তব্য করেন। ভারতীয়দের প্রতি তার মনোভাব এমেরির কাছে তার বক্তব্যের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি বলেন: ‘আমি ভারতীয়দের ঘৃণা করি। তারা একটি জঘন্য ধর্মের জঘন্য মানুষ ( বিশ্রী ধর্মের বিশ্রী মানুষ’)’। আরেকবার তিনি জোর দিয়ে বলেন ‘তারা হচ্ছে জার্মানদের পর সবচেয়ে জঘন্যতম মানুষ।’
ভারতের প্রতি চার্চিলের মনোভাব ছিল একেবারে চরম এবং তিনি ভারতীয়দের তীব্রভাবে ঘৃণা করতেন। তারা যে আর ভারতীয়দের বেশিদিন নিজেদের করে রাখতে পারছেনা এই অভাব বোধ থেকেই তার এই তীব্র ঘৃণা জন্মাতে পারে।’ তিনি হাফিংটন পোস্টে লেখেন, ‘অ-শ্বেতাঙ্গ লোকদের পেছনে গম খরচ করা অনেক খরচের ব্যাপার আবার তার উপরে বিদ্রোহীদের পেছনে যারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কাছে স্বাধীনতা দাবি করে আসছে। তিনি তার সংরক্ষিত খাদ্যশস্য যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইউরোপীয়ানদেরকে খাওয়ানোকেই শ্রেয় মনে করলেন।’
১৯৪৩ সালের অক্টোবর মাস। তখন দুর্ভিক্ষ চরমসীমায়। ওয়াভেলকে নিয়োগ উপলক্ষে একটি বিশাল ভোজন উৎসবে চার্চিল বলেন, ‘আমরা যখন পেছনের বছরগুলোর দিকে তাকাই তখন দেখতে পাই একটি অঞ্চলে তিন প্রজন্ম পর্যন্ত কোন যুদ্ধ নেই, দুর্ভিক্ষ পালিয়ে গেছে। শুধু সাম্প্রতিক সময়ে সংগঠিত যুদ্ধ আমাদেরকে সেই পুরনো স্বাদ দিচ্ছে…মহামারি আর নেই..ইন্ডিয়ান ইতিহাসে এই সময়কালটা একটি সোনালী অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে। ব্রিটিশরা তাদেরকে শান্তি দিয়েছিল, শৃঙ্খলা দিয়েছিল এবং দিয়েছিল গরীবদের জন্য ন্যায়বিচার এবং বিদেশী আক্রমণের শঙ্কা থেকে মুক্তি।’ চার্চিল শুধু একজন বর্ণবাদীই ছিলেন না ছিলেন একজন মিথ্যুকও।
নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এই দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলায় চার্চিলের নীতি আসলে ভারতের প্রতি ব্রিটিশদের আগের নীতিরই অনুকরণ। ভিক্টোরিয়া শাসনকালের শেষের দিকে গণহত্যা বিশেষজ্ঞ মাইক ডেভিস দেখান যে ব্রিটিশদের ১২০ বছরের ইতিহাসে ৩১ টি ভয়ানক দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল সেখানে ব্রিটিশদের আগমনের আগের দুই হাজার বছরে ১৭টি দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। যেখানে ২৯ মিলিয়ান ইন্ডিয়ান (প্রায় তিন কোটি ইন্ডিয়ান) মারা গিয়েছিল। ঐ লোকগুলো আসলে ব্রিটিশ নীতির কারণে মারা গিয়েছিলেন। ১৮৭৬ সালে খরার কারণে যেখানে ডেকান মালভূমিতে কৃষকেরা সর্বশান্ত হচ্ছিলেন সে বছর ইন্ডিয়াতে ধান ও গমের মোট উত্পাদনে উদ্বৃত্ত হয়েছিল। কিন্তু ভাইসরয় রবার্ট বুলওয়ার লিটন জোর দেন যে ইংল্যান্ডে রপ্তানি করা থেকে কোন কিছুই তাকে বিরত রাখতে পারবে না ।
——— সংগৃহীত