বাঙালী মুসলমান রাম নাকি রাবণের সন্তান এই তর্ক থেকে যখন আত্মপরিচয়ে মিমাংসা হয়ে যাবার কথা সেখানে সে তৈমুর লংয়ের হানাদারী কাহিনীতে নিজেদের শৌর্য বীর্যের গৌরব দেখতে পায়।

-Susupto Pathok
মারাঠা জাতির পরাজয় আর আফগান বাদশাহ আহমদ শাহ আবদালীর জয়ে বাঙালী জাতির নি:সন্দেহে কোন উত্তরাধিকার খাটে না। তবু কবি কায়কোবাদ পানিপথের এই তৃতীয় যুদ্ধের কাহিনী নিয়ে মহাকাব্য লিখলেন ‘মহাশ্মশান’ নামে। এই কাব্যে কায়কোবাদ মুসলমানদের শৌর্য-বীর্যের গৌরবগাথা তুলে ধরে ‘মুসলমান জাতি’ হিসেবে নিজেদের নিয়ে গর্বিত হওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন।

মধ্যযুগ থেকে শুরু করে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত মহাকাব্যের যে যুগ- সে সময়কাল পর্যন্ত মহাকাব্যের বিষয়বস্তু হিসেবে ধর্মকথাকে বেছে নিতে কবিদের দেখা যায়। হিন্দুদের দেখাদেখি মুসলিম কবিরা নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্য অঙ্কন করতে গিয়ে আসলে বিদেশী শাসকদের শৌর্যবীর্যকে তুলে ধরেছেন নিজেদের শৌর্যবীর্যের গর্ব হিসেবে। যেমন ইসমাইল হোসেন সিরাজী স্পেনে মুসলমানদের বিজয়গাথা নিয়ে লিখেছিলেন ‘স্পেনবিজয় কাব্য’। মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখেছিলেন ‘মেঘনাদবদ কাব্য’। হিন্দু পুরাণের এই কাহিনীকে মাইকেল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে গড়িয়েছেন। মূল কাহিনীর ভিলেন রাবণকে তিনি তার কাব্যে নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। মাইকেল হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়েছিলেন পূর্বেই। বলাই বাহুল্য তাই মাইকেল এই কাব্যে হিন্দু পুরাণকে বেছে নিলেও এখানে কোন হিন্দু জাতীয়তাবাদ প্রচার বা নিজেদের শৌর্য বীর্য প্রচারের চেষ্টা করেননি। বরং রাবনকে মহান হিসেবে চিত্রিত করার সাহস দেখিয়েছেন। অপর পক্ষে মুসলিম কবিদের কারবালার কাহিনী নিয়ে রচনাকে এইরকম নির্দোষ কাব্যিক রসের আলোকে দেখার উপায় নেই। যেমন সে সময় রচিত ‘কাসেমবধ কাব্য’ ‘জয়নালোদ্ধার কাব্য’ ‘সোহরাববধ কাব্য’ ইত্যাদি রচনাগুলোতে বাংলা ভাষী মুসলমান কবিরা মুসলিম ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের সচেতন প্রচেষ্টা করে গেছেন।

মীর মোশাররফ হোসেন হচ্ছেন সেকালের সবচেয়ে সেক্যুলার অসাম্প্রদায়িক লেখক। মুসলিম সমাজে তার উত্থানকে আজকের যুগের লেখকরা বিস্ময়কর বলে অভিহত করেছেন। কিন্তু সেই তিনিও কারবালা কাহিনী নিয়ে মহাকাব্য বিষাদসিন্ধু লিখতে গিয়ে অতি নিন্মমানের ধর্মীয় সংস্কৃতিকে এড়াতে পারেননি। আহমদ ছফা বলেছেন, মীর মোশাররফ হোসেন আরবদেশে এক ব্রাহ্মণ পরিবারকে হোসেনের কাটা মস্তককে কলেমা পড়তে শুনে মুসলমান হয়ে যাবার পর আজগুবি পুঁথির কাহিনী তার কাব্যে অনুপ্রবেশ করিয়ে ছিলেন যা ছিলো নিজের ধর্মকে উন্নত শ্রেষ্ঠ হিসেবে তুলে ধরার হীন কৌশল। মাইকেল যখন বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ লিখে ফেলেছিলেন তখন এই রকম স্বধর্মীয় সস্তা সেন্টিমেন্ট চিন্তন জগতের সহস্র বছরের ব্যবধানই প্রকাশিত করে তোলে।

বাঙালী মুসলমান রাম নাকি রাবণের সন্তান এই তর্ক থেকে যখন আত্মপরিচয়ে মিমাংসা হয়ে যাবার কথা সেখানে সে তৈমুর লংয়ের হানাদারী কাহিনীতে নিজেদের শৌর্য বীর্যের গৌরব দেখতে পায়। … আজতক পর্যন্ত!