ভাবুনতো, সাহিত্যের কোন ছাত্রটিকে ভাল সাহিত্য
লিখতে দেখেছেন? হাতের আঙুলের কড়ে
গুনতে থাকুন! সংখ্যাটি খুব বেশি হবে না। যে
দেশে অন্যকোথাও চান্স না পেয়ে স্টুডেন্টরা
সাহিত্য নিয়ে পড়ে, সে দেশে সাহিত্যের
গ্র্যাজুয়েটদের কাছ থেকে সাহিত্য আশা করা যায়
না। সরস্বতী সবার উপর ভর করেন না, অসুরের
উপর তো নয়ই! সরস্বতীর কৃপা পেতে চাইলে
অসুরের জীবন থেকে বেরিয়ে আসুন। সাধনার
প্রথম ধাপই হচ্ছে বিনয়। খেয়াল করেছেন
নিশ্চয়ই, সাহিত্য নিয়ে অগাধ জ্ঞান থাকলেই সাহিত্য
লেখা যায় না। শব্দ তো আর কাঁঠালপাতা নয় যে,
চাইলেই চিবিয়ে খেয়ে হজম করে ফেলা যাবে!
শব্দগুলিকে জোর করে টেনে আনা যায় না,
সুন্দরসূক্ষ্ম অনুভূতিতে শব্দরা আপনিই ধরা দেয়। গান
তো অনেকেই শেখেন, কৌশিকীর মতো
করে গাইতে পারেন কজন? কেন পারেন না?
পৃথিবীর সবচাইতে বাজে অনুভূতির মানুষগুলি
অপরকে ঈর্ষা করে, অপরের গীবত করে,
অপরের ক্ষতি করে। অমন অনুভূতি নিয়ে আর যা-ই
হোক, এমনকিছু করা সম্ভব নয়, যেটা অন্য ১০টা
আলাদা করে চোখে পড়ে। আপনি যতবেশি
ওরকম অক্ষম বাজে মানুষকে নিজের জীবনের
আশেপাশে ঘেঁষতে দেবেন, আপনি ততবেশি
নিজের অবচেতনেই ওদের বেশ কিছু বাজে
জিনিস নিজের মধ্যে ধারণ করে ফেলবেন।
গ্রেট আর্টিস্টরা কাজ করেন মাথা নিয়ে নয়, অনুভব
দিয়ে, হৃদয় দিয়ে। আপনার ভাল দিকগুলির যত্ন নিন।
দেখবেন, ওরাই আপনাকে ভাল রাখবে। একটু
গভীরভাবে ভেবে দেখুন, আপনার কোন
দিকটির জন্য আপনি অনন্য। সেটির সর্বোচ্চ যত্ন
নিন। পড়াশোনা, চাকরি, ব্যবসা দিয়ে আমি এই পর্যন্ত
কাউকেই অনন্য হতে দেখিনি। যার মধ্যে ন্যূনতম
যোগ্যতা আছে, সেও ওসব করতে পারে।
স্রেফ আপনার রেজাল্ট, আপনার চাকরি কিংবা ব্যবসায়
উন্নতি দিয়ে আপনাকে আলাদা করে মনে রাখার কিছু
দেখি না। বুদ্ধদেব গুহ নমস্য চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট
হিসেবে নয়, লেখক হিসেবে। অন্নদাশঙ্কর রায়
ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন,
এই তথ্যটি মাথায়ই তো রাখতাম না যদি লেখক
অন্নদাশঙ্কর রায়কে না চিনতাম! আর্ট নিয়ে অশোক
মিত্রের অসামান্য লেখাগুলি পড়ার সময় কার মাথায়
থাকে, ভদ্রলোক একজন বিখ্যাত আইএএস অফিসার
ছিলেন? সমরেশ মজুমদার ইনকাম ট্যাক্স
ডিপার্টমেন্টের থার্ডক্লাস চাকুরে ছিলেন, অথচ
সেই ডিপার্টমেন্টের সকল অধিকর্তাকে এক
করলেও একজন সমরেশ মজুমদারের সমান তো
দূরে থাক, ধারেকাছেও কিছু হবে না। যদি বলি, ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের একজন শিক্ষকের
নাম বলুনতো, তবে বেশিরভাগ লোকই বলবে
হুমায়ূন আহমেদের নাম। অথচ, উনি বেশি পরিচিত
শিক্ষক হিসেবে নয়, লেখক হিসেবে,
ফিল্মমেকার হিসেবে; যিনি ‘আগুনের পরশমণি’
বানাতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরিটা
ছেড়ে দিয়েছিলেন সেইদিন যেইদিন তাঁর
সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পদে
প্রমোশন হওয়ার কথা ছিল। ব্যাপারটা মজার না? এর
মানে কী দাঁড়াল? লোকে আপনাকে মনে রাখে
আপনার যা পারার কথা নয়, কিন্তু পারেন এবং খুব
ভালোভাবে পারেন, তার জন্য। শুধুই পড়াশোনা
দিয়ে কিছু হয় না। সারাজীবনই স্রেফ পড়াশোনা
করে আর তাক লাগিয়েদেয়া রেজাল্ট করে অমর
হয়েছেন, এমন লোকের সংখ্যা হাতে গুনে
বলে দেয়া যায়। সবাইকে দিয়ে সবকিছু হয় না।
শ্রীকান্তের পরিবারের ইচ্ছে ছিল শ্রীকান্ত
ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে জয়েন করবে, নামকরা
আইসিএস অফিসার হবে। আমাদের পরম সৌভাগ্য,
শ্রীকান্ত তা করেননি। বরং, উনি যা ভাল পারতেন,
সেটার যত্ন নিয়েছেন, সাধনা করে গেছেন।
একজন আর্টিস্ট শ্রীকান্ত একলক্ষ অফিসার
শ্রীকান্তের চাইতে অনেক বড়। একজন জিনিয়াস
দেশকে যা দিতে পারেন, একলক্ষ দক্ষ মানুষ তার
অর্ধেকও দিতে পারেন না। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে অনেকেই ইঞ্জিনিয়ার পাস করে
বেরিয়েছে। ওদের কাকে আমরা চিনি? ওদের
ডিগ্রিতে আমাদের কার কী এসে যায়? ইতিহাস কার
কথা লিখে রেখেছে? অথচ যে হেমন্ত
মুখোপাধ্যায় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের
পাঠ চুকানোর আগেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন,
সেই ব্যর্থ ননগ্র্যাজুয়েটটিই লক্ষ লক্ষ
গ্র্যাজুয়েটকে ম্লান করে দিয়ে আমাদের হৃদয়ে
বেঁচে আছেন, থাকবেন। পণ্ডিত জওহরলাল
নেহরুর Glimpses of World History পড়ে দেখুন।
অপরিণত বয়সের বালিকা ইন্দিরা পিতা নেহরুর কাছ
থেকে বিশ্ব ইতিহাসের যে পাঠ পেয়েছিলেন
সেই ছোটবেলাতেই, সে মেয়ে বড় হয়ে
গ্রেট হবে না তো আমাদের মতো সাধারণ
চিন্তাভাবনার মানুষ গ্রেট হবে? যারা গ্রেট, তাদের
অনেকগুলি গুণের একটি হল, উনারা অর্ডিনারি এবং
এক্সট্রাঅর্ডিনারির মধ্যে যে পার্থক্যগুলি আছে,
সেগুলি দীর্ঘদিনের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত চর্চার
মাধ্যমে বুঝতে পারেন। গ্রেটদের চিন্তাগুলি
অবশ্যই আমাদের চিন্তা থেকে ভিন্ন। ওগুলি নিয়ে না
ভাবলে, না জানলে, চর্চা না করলে নিজেকে
উন্নত করা সম্ভব নয়।
যে মানুষটা সারাজীবনই বাজে লোক হয়ে বাঁচে,
সে মানুষটা মৃত্যুর সময়ও বাজে লোক হয়েই
মরে। আপনিই ঠিক করুন, বাজে হয়ে বাঁচবেন কিনা,
বাজে হয়ে মরবেন কিনা। বাজে চিন্তার মানুষগুলি
নিজেরাও বাজে, অন্যদেরকেও বাজে করে
দেয়। ওদের হাত থেকে নিজেকে মুক্তি দিন।
এখুনিই! মানুষের সবচাইতে বড় দুর্বলতা, মানুষ
নিজের জায়গাটাই বুঝতে পারে না। অন্যদের কথা
শুনে নিজের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।
ঈশ্বর সবাইকে সবকিছু দেন না, ঈশ্বর যোগ্যতা
বুঝে সৌভাগ্যদান করেন। নিজেকে আগে যোগ্য
করে তুলুন, এরপর সৌভাগ্যের কথা ভাবুন। তুচ্ছ বিষয়
নিয়ে ব্যস্ত থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে যারা,
তাদেরকে ঈশ্বর সারাজীবনই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে
ব্যস্ত থাকার সুযোগ করে দেন। Small people
fight for small things. মজার ব্যাপার হল,
ছোটলোকরা বুঝতেই পারে না, কোনটা তুচ্ছ,
কোনটা তুচ্ছ নয়। যে মানুষ তুচ্ছকেই বড় করে
দেখে জীবন কাটিয়ে দেয়, সে মানুষ
কোনোদিনই বড় কিছুর স্বাদ পায় না। ছোটলোক
ছোটকাজে আনন্দলাভ করে। অসুস্থ
ব্যক্তিত্বের মানুষ অন্যকে ছোট করে
নিজেকে বড় ভাবতে পছন্দ করে। জানি, এতেও
আনন্দ আছে। জগতটাই তো আনন্দের জন্য।
তবুও, সবকিছুতেই আনন্দিত হয়ে ওঠা কোনো
কাজের কথা নয়। সবকিছু থেকেই আনন্দনেয়া
থেকে যে করেই হোক, নিজেকে সরিয়ে
রাখুন। রাস্তায় ছিন্ন পোশাকের ভিখারিনীর
গ্লানিতেও তো কেউ কেউ একধরণের সুখ
অনুভব করে। সুখানুভবের ধরণ দেখে মানুষ চেনা
যায়। নিজের রুচি, ভাবনা আর মানসিকতাকে সুন্দর করে
তুলতে পারলে আপনার কাজগুলি অন্য দশজনের
কাজ থেকে আলাদা করে চোখে পড়বে।
অন্যথায়, আপনিও স্রেফ জীবনটাকে
টেনেহিঁচড়ে-নিয়ে-যাওয়া একজন মানুষ ছাড়া আর
কিছুই নন।
Sushanta Paul