কলকাতা_ও_শহরতলীর_আনাচে_কানাচে_ঝুলন_উৎসব।

#কলকাতা_ও_শহরতলীর_আনাচে_কানাচে_ঝুলন_উৎসব

তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে,
দিল চায়, মন চায়, প্রাণ চায় তারে।।

বসন্ত সময়ে কোকিল ডাকে কুহু সুরে,
যৌবন বসন্তে মন থাকতে চায়না ঘরে।।

আতর গোলাপ সোয়া-চন্দন আনো যতন করে,
সাজাও গো ফুলের বিছানা পবিত্র অন্তরে।।

নয়ন যদি ভুলে সইগো মন ভুলেনা তারে,
এগো প্রেমের আগুন হইয়া দ্বিগুণ দিনে-দিনে বাড়ে।।

ঝুলন উৎসব। আজ থেকে রাধা কৃষ্ণ ঝুলনের দোলনায়। রাধাকৃষ্ণের ঝুলন। বৃন্দাবন-মথুরার পাশাপাশি গোটা দেশ এই উত্সবে মেতে উঠেছে। গোটা বাংলা তথা কলকাতাও কিন্তু পিছিয়ে নেই। এখানকার বিভিন্ন অঞ্চলের মঠে মন্দিরে কিংবা বনেদি পরিবারে সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয় রাধাকৃষ্ণের ঝুলন উৎসব।

তবে তা বৃন্দাবন-মথুরার ঝুলনের অনুকরণ নয়। বাংলার নিজস্ব ঝুলন উৎসবের রয়েছে প্রাচীন ঐতিহ্য। এক এক অঞ্চলে দোল বা দুর্গোৎসবের মতো ঝুলন উৎসবের আকর্ষণ কিছু মাত্র কম নয়। ঝুলনেও দেখা যায় নানা আচার অনুষ্ঠান ও সাবেক প্রথা।

ঝুলন বাড়ি বলেই পরিচিত বউবাজারের রামকানাই অধিকারীর বাড়ি। প্রায় ২০০ বছর আগে এই পরিবারের আদিপুরুষ কৃষ্ণমোহন অধিকারী ঝুলন উৎসবের প্রচলন করেন। পরে তাঁর পৌত্র রামকানাই অধিকারী সাড়ম্বরে এই উৎসবের প্রচলন করেছিলেন।

এই বাড়ির রাধাবল্লভ জিউর ঝুলন উৎসব আজও বহু মানুষকে আকৃষ্ট করে। এ বাড়িতে এই ঝুলন উৎসব হয় পাঁচ দিন ধরে। আর তাই এই পাঁচ দিনে দেবতাকে বিভিন্ন বেশে সাজানো হয়। প্রথম দিন রাখাল বেশ, দ্বিতীয় দিন যোগী বেশ, তৃতীয় দিনে সুবল বেশ, চতুর্থ দিনে হয় কোটাল বেশ এবং শেষ দিনে রাজ বেশ।

ঝুলন উপলক্ষে এই পাঁচ দিন ধরে চলে বিশেষ পুজো। প্রথম দিনে হোম করে ঝুলন উৎসবের সূচনা করা হয়। এর পরে দেবতাকে এক এক দিন এক এক রকমের ভোগ নিবেদন করা হয়। পুরনো ইতিহ্য বজায় রেখে আজও পাঁচ দিনের এই উৎসবে আত্মীয় সমাগম হয়।

রামকানাই ভাল পাখোয়াজ বাজাতেন, এমনকী তিনি যদুভট্টের সঙ্গে সঙ্গত করতেন। এই পরিবারের ঝুলন উপলক্ষে অতীতের মতো আজও বসে ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর। ।

এক কালে যদুভট্ট ছাড়াও আসতেন অঘোরনাথ চক্রবর্তী, রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী প্রমুখ শিল্পীরা। পরবর্তী কালে আসতেন জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, ভিজি যোগ, মালবিকা কানন, এটি কানন, হীরু গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পীরা। সেই ঐতিহ্যের ধারা বহন করে আজও বর্তমান যুগের শিল্পীরা এখানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন।

চালতাবাগান অঞ্চলে বিনোদ সাহা লেনে বঙ্কুবিহারী সাহা প্রতিষ্ঠিত রাধাকৃষ্ণের ঝুলন মন্দিরে ঝুলনযাত্রা উপলক্ষে বিশেষ পুজো হয়ে থাকে। এই উপলক্ষে বিশেষ ভোগ নিবেদন করা হয়।

মন্দির চত্বরে ছোট ছোট ঘরগুলির মধ্যে কৃষ্ণলীলা ও মহাভারতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলি মাটির পুতুল দিয়ে সাজানো হয়।

ওই একই রাস্তায় মণ্ডল পরিবারের রাধাকৃষ্ণ জিউর মন্দিরে ঝুলন হয়। এই পরিবারের অমিত মণ্ডল বলছিলেন, একাদশী থেকে দ্বিতীয়া পর্যন্ত মোট সাত দিন ধরে চলে এই ঝুলন উৎসব।

প্রথম দিন রাধাকৃষ্ণের যুগল বেশ, দ্বিতীয় দিনে অনন্ত দর্শন, তৃতীয় দিনে রাসলীলা, চতুর্থ দিনে নৌকাবিলাস, পঞ্চম দিনে চন্দ্রাবলীকুঞ্জ, ষষ্ঠ দিনে রাইরাজা এবং সপ্তম দিনে মিলন বেশ। ঝুলন উপলক্ষে প্রতি দিন নিবেদন করা হয় লুচি, মালপোয়া, সুজি ইত্যাদি।

তবে ঝুলন উপলক্ষে ওই এলাকার আর এক আকর্ষণ জমজমাট মেলা। মেলা বসে বিনোদ সাহা লেনে এবং বিবেকানন্দ রোডের ফুটপাথের কিছুটা অংশ জুড়ে।

অন্য দিকে, কুমোরটুলি অঞ্চলে গোকূলচন্দ্র মিত্র প্রতিষ্ঠিত রাধামদনমোহন জিউর মন্দিরে সাড়ম্বরে পালিত হয় ঝুলন উৎসব। এই উপলক্ষে আজও বহু ভক্ত সমাগম হয়।

তেমনই দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জ রোডে বাওয়ালির মণ্ডল পরিবারের উদয়নারায়ণ মণ্ডল প্রতিষ্ঠিত মদনমোহন জিউর মন্দিরে যা বড় রাস বাড়ি বলে পরিচিত, আজও পালিত হয় ঝুলন উৎসব। এখানে ঝুলন হয় তিন দিন ব্যাপী।

এই সময় প্রতি দিন ভোরে দেবতাকে ডাবের জল দিয়ে স্নান করানো হয় এবং প্রতি দিন নতুন ভাবে সাজানো হয়। ঝুলন উপলক্ষে হয় নামসংকীর্ত্তন। এই সময় প্রতি দিন প্রায় ২৫-৩০ রকমের ফলের নৈবেদ্য, লুচি, সুজি নিবেদন করা হয়।

তবে, শুধু কলকাতাতেই নয় মফস্‌সলের বিভিন্ন মন্দিরেও চলে ঝুলন উৎসব। তার মধ্যে খড়দহের শ্যামসুন্দরের ঝুলন উৎসব উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া ইছাপুরের নবাবগঞ্জের ঝুলনের মেলায় দূর দূরান্ত থেকে আজও বহু মানুষ আসেন।

তথ্যঃ

পুরনো কলকাতার ইতিহাস