খ্রীষ্টান ধর্মের সহিষ্ণুতা নিয়ে কিছু প্রাথমিক ধারণা–

খ্রীষ্টান ধর্মের সহিষ্ণুতা নিয়ে কিছু প্রাথমিক ধারণা–
________________

মহান কনস্টানটাইন খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণের দশ বছর আগে এডিক্ট অফ টলারেশন’এ বলা হয়েছিল যে, ধর্ম একটা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ব্যাপার এবং কোনো বিশেষ ধর্ম রক্ষা বা গ্রহণের ব্যাপারে কাউকে বাধ্য করা যাবেনা। কিন্তু যেদিন থেকে খ্রীষ্টধর্মের সাথে রাষ্ট্রীয় শক্তি যুক্ত হলো সেদিন থেকে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার নীতি বর্জিত হলো। যে ব্যক্তি খ্রীষ্টান নয় তার কোনো সদগুনকেই আর সদগুন বলে বিবেচনা করা হলোনা, এবং অখ্রীষ্টানরা সাধারণ অপরাধীর চেয়েও বেশি অপরাধী হিসাবে অভিযুক্ত হতে লাগল। এমনকি দীক্ষা গ্রহণের আগেই অকালমৃত শিশুদের ভবিষ্যৎ কল্পনা করা হলো যে, তারা নরকের মেঝেতে অনন্তকাল হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াবে ।

চার্চের যাজকদের মধ্যে সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় যাজক সন্ত অগাস্টাইন সবাইকে খ্রীষ্টধর্মের অধীনে আসতে বাধ্য করার নীতির প্রবক্তা। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষাশেষি তৃতীয় ইনসেন্ট প্রধান ধর্মযাজক হন এবং তারই আমলে শুরু হয় ইউরোপকে অখ্রীষ্টান মুক্ত করার সর্বাত্মক প্রয়াস। দক্ষিণ পশ্চিম ফ্রান্সের  ভূস্বামী ছিলেন কাউন্ট তুলোস এবং তাঁর প্রজারা আলবিজোয়া নামে অভিহিত হতো। কী করে শসস্ত্র অভিযানে অখ্রীষ্টান আলবিজোয়াদের বিধ্বস্ত করা হয় তার বিবরণ যে.বি.বিউরি দিয়েছেন “এ হিস্ট্রি অফ ফ্রিডম অফ থট ” গ্রন্থে.। এই অভিযানে নারী ও শিশুদেরও ধর্মীয় উল্লাসে হত্যা করা হয়।  ১২২৯ খ্রীষ্টাব্দে কাউন্ট অব তুলোসের শোচনীয় পরিণাম থেকে প্রমাণিত হয় যে, একজন রাজার রাজা হবার যোগ্যতা নির্ধারিত হবে রাজ্য থেকে অখ্রীষ্টানদের নির্মুল করার সম্মতি ও সামর্থ্যে। যে রাজা অখ্রীষ্টানদের আপন রাজ্য থেকে উৎখাত করবেনা তার রাজা হবার কোনো যোগ্যতা বা অধিকার নেই।

১২৩৩ খ্রীষ্টাব্দে প্রধান ধর্মযাজক নবম গ্রেগরির আইন মোতাবেক সমগ্র পশ্চিম ইউরোপ জুড়ে অখ্রীষ্টানদের খুঁজে বার করার অভিযান শুরু হয়। এই প্রথা ইনকুইজিশন নামে কুখ্যাত। লক্ষ লক্ষ অখ্রীষ্টান নরনারীকে ইনকুইজিশনের মাধ্যমে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।  স্বাধীন চিন্তাধারার পৃষ্ঠপোষক হিসাবে  সম্রাট ফ্রেডেরিক দ্বিতীয় পরিচিত কিন্তু তিনিও ১২২০-১২৩৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ইতালি ও জার্মানির জন্য কতকগুলি আইন প্রণয়ন করেন। আইনগুলিতে বলা হয় যে, যাজক সম্প্রদায়ের সঙ্গে যারা একমত নয় তারা আইন বহির্ভূত ব্যক্তি,তারা যদি খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ না করার জন্য অনুতপ্ত হয় তাহলে তাদের বন্দী করা হবে আর যারা অখ্রীষ্টান হওয়ার জন্য অনুতপ্ত হবেনা তাদের পুড়িয়ে মারা হবে। তৎকালীন যুগে অখ্রীষ্টানদের পুড়িয়ে না মেরে বন্দী করাই ছিল উদারতার পরাকাষ্ঠা।

১২৫২ খ্রীষ্টাব্দে চতুর্থ ইনোসেন্টের আজ্ঞা অনুসারে প্রত্যেক নগর ও রাষ্ট্রের সামাজিক ও পৌর সংগঠনের আবশ্যিক অঙ্গ হিসাবে অখ্রীষ্টানদের নির্যাতন ও হত্যা করার নীতি প্রবর্তিত হয়। জলভর্তি বিশাল কড়াইয়ে ফেলে সেই জল আস্তে আস্তে ফুটিয়ে অপরাধীকে হত্যা করা হতো, তবে সরাসরি আগুনে পুড়িয়ে মারাই ছিল বেশি প্রচলিত। রক্তপাত খ্রীষ্টান ধর্ম অনুমোদন করেনা এই বিবেচনায় হত্যার এরকম পৈশাচিক পদ্ধতি গ্রহণ করা হতো।

#রিফর্মেশন

__ অনেকের ধারণা রিফর্মেশন ধর্মীয় ব্যাপারে উদার চিন্তাধারার সপক্ষে কিন্তু এই ধারণা ভ্রান্ত। আগে চার্চের বিধানকে অকাট্য, অমোঘ, অবশ্যমান্য বলা হতো, রিফর্মেশন চার্চ ও যাজকদের জায়গায় শাস্ত্র বা বাইবেল বসাল, অর্থাৎ বাইবেলে যা আছে তা অমোঘ, অকাট্য ও অবশ্যমান্য ( ওয়াহাবি টাইপ?)

মার্টিন লুথার যতদিন দুর্বল ছিলেন ততদিন কিছু মানবিক কথাবার্তা বলেছেন, শক্তিশালী হয়ে ওঠার পর নিজের প্রকৃত মতামত প্রকাশ করে বলেছেন – প্রকৃত ধর্মমত গ্রহণে প্রজাদের বাধ্য করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।  প্রজাদের কর্তব্য রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য পালন করা । বাইবেলীয় ধর্মবিশ্বাসকে রক্ষা করাই রাষ্ট্রের লক্ষ্য।  ধর্ম ও রাষ্ট্রকে যারা পৃথক করার কথা বলেছেন লুথার তাদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছে। আর জন কেলভিন ধর্মরাষ্ট্রের তত্ত্ব খাড়া করেই ক্ষান্ত হননি, জেনেভাতে ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্টা করেন

( প্রথম পর্ব সমাপ্ত)

সৌজন্যেঃ শ্রী অমিত কুমার মিত্র….