কাস্মিরের আদিল আহমেদ দার নামে যে যুবকটি বিস্ফরক ভর্তি গাড়ি নিয়ে সেনাবাহিনীর গাড়িতে ধাক্কা দিয়ে ৪০ জনকে হত্যা করেছিলো, তার উপর এখন গবেষণা শুরু হয়েছে। শান্ত-শিষ্ঠ আদিল কেন হঠাৎ জঙ্গিপন্থায় যোগ দিয়েছিলো? যে কোন জাতি সম্প্রদায়কে দমন পীড়ন করলে তার প্রতিরোধের অধিকার আছে। ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষে ভারতীয়রা সন্ত্রাসবাদকে বেছে নিয়েছিলো। বাংলাদেশের পাহাড়ে নিপীড়ন নির্যাতনের প্রতিরোধ প্রতিবাদ করতে শত শত পাহাড়ী আদিবাসী তরুণরা শান্তি বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলো। গোটা পৃথিবীতে এরকম জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র সংগ্রাম চলছে। কাস্মির, ফিলিস্তিন, বার্মাতে সেরকম জাতিগত সশস্ত্র সংগ্রাম হতেই পারে। ফিলিস্তিনি তরুণরা তাদের মাতৃভূমি রক্ষার জন্য জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র সংগ্রামের অধিকার রাখে। কাস্মিরী, রোহিঙ্গারা তাদের ভূমির অধিকার, নাগরিক অধিকার রক্ষার্থে জীবন বিপন্ন করতে পারে। আত্মঘাতি হামলা করে শত্রুদের ভীত করে তুলতেও পারে। বাংলাদেশের মানুষও মুক্তিযুদ্ধ করেছিলো। বুকে মাইন বেধে জাহাজ উড়িয়ে দিয়েছিলো নিজেকে শেষ করে দিয়ে। এইখানেই প্রশ্নটা টেনে ধরতে হবে, আদিল দার কি মুক্তিযোদ্ধা? বর্তমান ফিলিস্তিনি তরুণরা, রোহিঙ্গা, কাস্মিরি তরুণরা কি জাতীয়তাবাদী মুক্তি সংগ্রামী?
‘জইশ-ই মুহাম্মদ’ অর্থ হচ্ছে ‘মুহাম্মদের সৈন্য’। নামেই বলে দিচ্ছে দলটি কি চায় বা কি তাদের উদ্দেশ্য। তামিল টাইগার শ্রীলংকাতে তাদের অধিকার রক্ষায় সশস্ত্র বিপ্লব চালিয়ে গিয়েছিলো কয়েক দশক ধরে। তামিল জাতীয়তাবাদী একটা দলের নাম বলে দিচ্ছে তামিলরা সব একেকটা বাঘ! বাংলাদেশের পাহাড়ে সশস্ত্র লড়াইকারী দলগুলোও তাদের জাতীয়তাবাদকেই তাদের দলের মূলমন্ত্র করেছে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের মুক্তি সংগ্রাম হামাস যখন নেতৃত্ব দেয় তখন সেটা ফিলিস্তিনী জাতীয়তাবাদ থাকে না। হামাস তথা ফিলিস্তিনী অন্যান্য মুক্তি সংগ্রামীদের প্রাণপুরুষ, আল কায়দা, তালেবানের মত সংগঠনের আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা শায়খ আবদুল্লাহ আযমকে যখন এক যুবক তার দেশের সেনাবাহিনীর হয়ে মুক্তি সংগ্রামের ইচ্ছা জানায়, তখন তিনি সেই যুবককে যা বলেছিলেন হুবহু তুলে দিচ্ছি, ‘যুবকটি বলল, আমি আমার দেশে ফিরে যেতে চাই। বললাম, কেন? বলল, সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তির জন্য। বললাম, তুমি কি আল্লাহ’র সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত থেকে বাদ পড়ে তাগুতের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হতে চাও? ভাই তুমি এখানের সৈন্য তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত কর। আল্লাহ বলছেন- انفِرُوا خِفَافًا وَثِقَالًا “তোমরা হালকা ও ভারি অস্ত্র নিয়ে অভিযানে বেড়িয়ে পড়।”[তাওবাহঃ৪১]। এখানের সেনাবাহিনীতো আল্লাহ সেনাবাহিনী। তুমি ওখানে কয়েক বছর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে একটা সার্টিফিকেট পাবে। আর এখানে যে সার্টিফিকেট পাবে, তা হচ্ছে জান্নাতের সার্টিফিকেট। ঐ জান্নাতের প্রশস্ততা আসমান ও যমীনের প্রসস্ততার সমান। ওখানে তুমি বিশ বছর চাকুরী করে একটি ঘর তৈরী করবে এবং একটি সুন্দরী বিয়ে করবে আর কী। আর তুমি যদি এখানে আল্লাহর বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত থাক, তাহলে বাহাত্তরটি ডাগর চক্ষু বিশিষ্ট হূরকে বিয়ে করতে পারবে ও অনেক প্রাসাদ লাভ করবে। প্রত্যেক প্রাসাদ মনিমুক্তা দ্বারা কারুকাজকৃত দৈর্ঘ্যে সত্তর মাইল এবং এর দরজা সবুজ মরকত (মণি) দ্বারা তৈরি। তুমি এখানে হয়তো একজন সুন্দরী সৌদী বা জর্ডানী কিংবা ইয়েমেনী মেয়ে বিয়ে করবে। কিন্তু ওখানে যে মহিলা পাবে সে সত্তরটি পোশাকে সজ্জিত থাকবে। ঐ সত্তরটি কাপড় একটার উপর একটা পরবে। কিন্তু তারপরও তাঁদের পায়ের নলার মগজ দেখা যাবে। এ ব্যবসার চুক্তি সম্পাদনকারী ক্ষতিগ্রস্থ হয় না। কারণ, এ ব্যবসার ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহ ও তোমার মাঝে হচ্ছে।তিনি ক্রয়কারী আর তুমি বিক্রয়কারী আর চুক্তি সম্পাদনকারী হচ্ছেন আমানতদার নবী সাল্লাল্লাহি আলাইহি ওয়াসাল্লাম’।
যদি উপরের শায়খ আবদুল্লাহ আযমের বক্তব্যটি পুরোটা পড়ে থাকেন তাহলে বুঝতে পারবেন ফিলিস্তিনী তরুণরা এখন কোন মন্ত্রে ইজরাইলের বিরুদ্ধে লড়তে চায়। হামাস তাদেরকে জান্নাতে ৭২ হূর পাবার কথা বলছে। আল্লার সঙ্গে মুমিনের জানমাল দিয়ে ব্যবসায়িক চুক্তি কথা মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে। কাস্মিরি তরুণ আদিল দার ঠিক এরকম বিশ্বাস থেকেই জইশ-ই মুহাম্মদের যোগ দিয়েছিলো। রোহিঙ্গাদের জঙ্গি দলটিও আরাকানকে একটি ইসলামিক স্টেট বানাতে জিহাদের ঘোষণা দিয়েছে। অথচ কাস্মির কিংবা ফিলিস্তিনীদের লড়াই করার কথা ছিলো তাদের জাতীয় পরিচয়কে ধারণ করে একটি রাষ্ট্রীয় সত্ত্বার স্বীকৃতির সংগ্রাম। বস্তুত তার বদলে এসব অঞ্চলে আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদকে পুজি করে ইসলামিক জিহাদ চলছে। এইখানেই আমাদের হিসাবে বড় ভুল হয়ে যাচ্ছে। আমরা কি জাতীয়তাবাদ বা কোন জাতির মুক্তি সংগ্রাম ভেবে একটি ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করে যাচ্ছি না? এমন একটি ধর্মীয় সমস্ত্রাসবাদ যারা কিনা চায় মুসলিম ব্যাতিত বাকীরা দাস হিসেবে মুসলমানদের অধিনে থাকবে! এমন একটি সন্ত্রসবাদ যারা কিনা নারীদের গবাদি পশুর চেয়ে অধিক কিছু মনে করে না। এমন একটা সন্ত্রাসবাদ যারা পৃথিবীতে আবার দাস প্রথাকে ফিরিয়ে আনবে। জিজিয়া কর আর অবিশ্বাসীদের হত্যার যুগ ফিরিয়ে আনতে চায়। মূল প্রশ্নটা করতে হবে, আদিল দারদের মত তরুণদের মনে ভারতের প্রতি ক্ষোভ থেকে তাদের জাতীয়তাবাদী সন্ত্রাসবাদে টেনে আনতেই পারে। হতে পারে সে আত্মঘাতি হামলাকারী। তামিল টাইগারও আত্মঘাতি হামলা চালাতো। কিন্তু আদিল দারদের দলের নাম কেন ‘মুহাম্মদের সৈন্য’ (জইশ-ই মুহাম্মদ) হবে?
সম্প্রতি বিবিসি বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছে কেন আদিল দারদের মত শান্ত বিনয়ী ছেলেরা কট্টর জঙ্গিবাদে নাম লেখাচ্ছে। তারা বিশ্লেষণ করেছে দিনের পর দিন কাস্মিরে সেনা শাসন, কারফিউ, নির্যাতন, সৈন্যদের তল্লাসী তাদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছিলো যার পরিণামে তাদেরকে সশস্ত্র হয়ে উঠতে উশকে দিয়েছিলো। কিন্তু কেউ এই প্রশ্নটা তুলছে না, এই সশস্ত্র হয়ে উঠার পিছনে জিহাদের মন্ত্র কেন তাদের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠে? জাপানে দু-দুটো আনবিক বোমা ফেলার পর যদি সেখানে কোন জঙ্গি সংগঠনের জন্ম নিতো অবশ্যই সেটা জাপানী জাতীয়তাবাদ কেন্দ্রিক মার্কিন বিরোধী তত্ত্বের উপর গড়ে উঠত। যদি সেটা বৌদ্ধ ধর্মীয় উগ্র সশস্ত্র জঙ্গিবাদে রূপ নিতো তাহলে কি সেটা অস্বাভাবিক হতো না? এবার এই পথে ফিলিস্তিন, কাস্মির রোহিঙ্গাদের জঙ্গিবাদ কেন আল্লার দল নবীর দল নামে গড়ে উঠে সেই প্রশ্নটা করুন। যদি না পারেন তাহলে এইসব দলগুলিকে ইহুদীদের ষড়যন্ত্র, ইহুদীরা ক্যাপ্টাগন পিল খাইয়ে মুসলমান ছেলেদের জঙ্গি বানাচ্ছে জাতীয় গালগল্প ছড়িয়ে নিজেদের রক্ষা করুন…!