ব্রহ্ম_সত্য_জগত_মিথ্যা
দৃশ্য — ১
বাবা, মুসলমানেরা মাকে তুলে নিয়ে গেছে!
ছিঃ! তোকে এই শিক্ষা দিয়েছি? অপরাধী, গুণ্ডার আবার ধর্ম হয় নাকি? সব ধর্মেই ভাল মন্দ মানুষ আছে। বলা উচিত, সমাজবিরোধীরা তুলে নিয়ে গেছে।
সরি বাবা, ভুল হয়ে গেছে। হ্যাঁ মাকে সমাজবিরোধীরাই তুলে নিয়ে গেছে। কিন্তু তুমি পালাচ্ছ কেন বাবা? মাকে বাঁচাবে না?
কেন পালাচ্ছি? শাস্ত্রে বলেছে য পলায়তি স জীবতি! ওরা দলে ভারি যে।
জানি বাবা। গুনেছি সাত আটজন। আরও বেশিও হতে পারে। কিন্তু তোমরাও তো সাত ভাই। জ্যাঠা, কাকা, পাড়া প্রতিবেশি মিলে কয়েক গুণ লোক। ওদেরকে সহজেই কুপোকাত করা যায়।
তাই তো খবর দিতে যাচ্ছি ওদের। চল পা চালা।
আচ্ছা বাবা, চল দৌড়াই। এই তো এসে গেছি। শুনেছ জ্যাঠা, মুসলমান থুরি সমাজবিরোধীরা মাকে তুলে নিয়ে গেছে। চল না সবাই মিলে মাকে বাঁচাই।
তাই নাকি? কোন দিকে?
নয়া পুকুরের ধারে। ওই যে মায়ের গলা। বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছে। চল না সবাই মিলে যাই।
বড় জ্যাঠা — চল সবাই। ওদের উচিত শিক্ষা দিই। আর সহ্য করা যাচ্ছে না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণও শিশুপালকে ছেড়ে দেন নি। শক্তি দিয়েই অন্যায়ের মোকাবিলা করতে হয় কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে সেটাই প্রমাণ করেছিলেন। চল সবাই।
মেজ জ্যাঠা — উঁহু, দ্বাপর, ত্রেতা যুগের পথ, পদ্ধতি কি কলি যুগে চলে? অস্ত্র বর্জন করে ভক্তির আশ্রয় নিয়ে হবে। কলি যুগে শুধু হরি নামেই মুক্তি, বুঝেছ হে। অহিংসা পরম ধর্ম।
সেজ জ্যাঠা — মন্দ বলনি ভাই। তাছাড়া ব্যাপারটা একটু ভাল করে বুঝতে হবে। খোকার মায়ের কোনো ইন্ধন ছিল কিনা। ইয়ে মানে আস্কারা না পেলে এমন সাহস পায় কি করে! আজকাল তো ঘরে ঘরে ফষ্টি নষ্টি! তবু চল, বুঝিয়ে সুঝিয়ে যদি কিছু করা যায়।
কিন্তু জ্যাঠা, ওদের হাতে তো অস্ত্র আছে। বোঝালে কি বুঝবে?
ছোট বাবু — অস্ত্র! তবে তো আইন হাতে তুলে নেওয়া উচিতই নয়। পুলিশে খবর দিতে হবে।
তাতে কি লাভ হবে? পিসির বেলায় তো পুলিশে খবর দিয়েছিলে। শুধু লাশটাই উদ্ধার করেছিল।
মেজ জ্যাঠা –ঠিক। তা বলে কি রক্তপাত করে মহাপাতক হতে হবে? হিংসা পশুর ধর্ম।
উফ! তোমরা কি তর্কই করে যাবে? মা যে মরে যাবে!
তাই তো! একটা বিহিত করা দরকার। চল, সবাই মিলে গুরুদেবের কাছে যাই। ওঁর আশ্রমে অনেক ভক্তের সমাগম। লোকবলেরও অভাব হবেনা।
সমস্বরে — বেশ, তাই হোক।
গুরুদেব গুরুদেব!
একি বৎস, তুমি এইরূপ বিচলিত কেন? তোমার সহিত যাহারা আসিয়াছে উহাদেরও একই অবস্থা দেখিতেছি? কি হইয়াছে, বিশদে নিবেদন কর!
গুরুদেব আমার মাকে বাঁচান, একদল গুণ্ডা আমার মাকে তুলে নিয়ে গেছে। ওই যে মা চেঁচাচ্ছে।
ওহ এই ব্যাপার! তুমি বালক মাত্র। তাই বৃথা কষ্ট ভোগ করিতেছ। হে মূঢ়, অচেতন মানব, তোমার যন্ত্রণা একমাত্র কারণ তুমি ভেদ জ্ঞান বর্জন করিতে পার নাই। স্থূল বোধ ছাড়িয়া সূক্ষ্মতাকে অনুভব করিতে শেখ। তুমি যাহাদের গুণ্ডা বলিতেছ, তাহাদের সহিত তোমার মায়ের কোনো ভেদ নাই। সকলেই পরমাত্মার অংশ। সেই পরম ব্রম্ম। সচ্চিদানন্দ। মিছে কষ্ট পেওনা বালক।
গুরুদেব, ওই যে দেখুন, ওরা আমার মাকে উলঙ্গ করে ফেলেছে। চার পাঁচ জন এক সাথে — ওই দেখুন উরু সন্ধি গড়িয়ে রক্তের স্রোত! মাকে ওরা ছিঁড়ে খুঁড়ে —
মূঢ় বালক! তুমি অদ্যাপি স্থূল, নশ্বর দেহটিকেই মাতা জ্ঞান করিতেছ? তুমি যাহা দেখিতেছ, সকলই মায়ার ছলনা মাত্র। শোনো হে মূর্খ, তোমার মাতা সেই পরমাত্মার অংশ, শস্ত্র যাহাকে কাটিতে পারেনা, অগ্নি যাহাকে পোড়াইতে পারেনা, জল যাহাকে ভেজাইতে পারেনা — বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়, নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরাণি — — পুরাতন বস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া আমরা যেমন নূতন পোশাক পরিধান করি, আত্মাও তেমন জীর্ণ দেহ বিসর্জন করিয়া নব দেহ গ্রহণ করে– শান্ত হও বালক।
***
একি বাবা! মাকে ঠিকমত পোড়ানোই হলনা। তোমরা সবাই বাক্স পেঁটরা গোছাচ্ছ?
আমরা এই বাড়ি, এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাব খোকা। জ্যাঠারাও যাচ্ছে।
সে কি? তবে তো ওরা আমাদের বাড়িঘর সব দখল করে নেবে।
আবার সেই কথা! আমরা ওরা কি রে? গুরুদেব কি বলল ভুলে গেলি? ওরা আমরা বলে কোনো ভেদাভেদ নেই। সব পরমাত্মার অংশ। সচ্চিদানন্দ ব্রক্ষ্মের অংশ। এ বাড়িতে আমরা থাকা যা, ওরা থাকাও তাই।
দৃশ্য –২
হুজুর, দুইডা মালাওনের পোলা আমার বোনেরে টোন কাটছে!
আর তুই দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দেখছস? ছ্যা ছ্যা ছ্যা! দুই খান মাত্র কাফের! ছাইড়া দিলি?
কি যে কন হুজুর! আধমরা কইরা গাছের সাথে বাঁইধা রাখছি। কল্লা খান খসাবো না রাখব, সেইডা আপনে ঠিক করেন।
✍️ দেবাশিস লাহা