বাঙালির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবেঃ (পঞ্চম অংশ)
(চতুর্থ অংশের পর …)
অনেকে তর্ক করবেন, এ তো টাকপয়সা দেওয়া নয়। শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রেরণা দিলে কেউ নিঃস্ব হয় না, বরং তা বাড়ে। এ তর্কের উত্তর আমি দিতে পারব না। কিন্তু বিশ্ব ইতিহাসের দুটো উদাহরণ দিতে চাই। পৃথিবীর দুটি রিফিউজি জাতি হল। ইহুদি ও পার্সি। পার্সিরা আছে ভারতে আর ইহুদিরা আছে সারা বিশ্ব জুড়ে। পারস্য দেশবাসী পারসিদের’কে ভারতের সবাই ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে। আর দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধের সমাপ্তি পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে ইহুদিরা চরম ঘূণা ও অবজ্ঞার পাত্র ছিল এবং বিদ্বেষ ও হিংসার শিকার ছিল। এমনকি সেকসপিয়ারের মত মহান সাহিত্যিকও চরম ইহুদি বিদ্বেষী ছিলেন। উদাহরণ, “মার্চেন্ট অফ ভেনিস” গ্রন্থে ক্রুর নিষ্ঠুর সাইলক চরিত্র।
এই দুই জাতির মধ্যে কী তফাৎ ছিল? ইসলামের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পালিয়ে এসে পার্সিরা ভারতের গুজরাটের যে রাজ্যে প্রথম আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের নেতা সেই রাজ্যের রাজাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে দুধের মধ্যে মেশালে চিনি যে রকম ভাবে থাকে, ঠিক সেই রকম ভাবে পার্সিরা হিন্দু দেশে থাকবে ও সেই ভূমিকা পালন করবে। তাদের পরবতী প্রজন্ম সেই প্রতিশ্রুতির মর্যাদা রেখেছে। দাদাভাই নাওরোজি, জামসেদজী টাটা এবং আরও বহু পার্সি ভারতকে বহু দিক থেকে সমৃদ্ধ করেছেন কোনরকম সমস্যা সৃষ্টি না করেই। কিন্তু আজকে? আজকে পার্সি জাতি বিলুপ্ত প্রায়। সারা পৃথিবীতে তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যায় না। ভারতেও বিলোপের পথে। আর ইহুদিরা? প্রায় ১৮০০ বছর ধরে সারা পৃথিবীতে তারা ঘৃণা, অবজ্ঞা ও বিদ্বেষের পাত্র হয়েছিল, তা কি একেবারে বিনা কারণে? তা কি শুধু তারা দেশত্যাগী ভূমিহীন রিফিউজি ছিল বলে ? না, তা নয়। এক হাতে তালি বাজেনি। ইহুদিরা চরম স্বার্থপর ও গোঁড়া ধর্মান্ধ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতি দেখে ইহুদিদের আগের রূপ বোঝা কঠিন। অর্থাৎ ইহুদিরা নিজেদেরটা বেশি করে দেখত, নিজের ভাল বেশি বুঝত, – স্বার্থপর ছিল। তাই পৃথিবীতে তারা এরকম ঘৃণার পাত্র হয়েছিল। কিন্তু আজ ? পার্সি জাতির মতো আজ ইহুদিরা বিলুপ্তির পথে নয়, বরং নিজের ভূমিতে ফিরে গিয়ে সেখানে জাঁকিয়ে বসে সারা পৃথিবীতে তাদের দাপট ও প্রভাব ক্রমবর্ধমান। নিঃস্বার্থ পার্সি জাতি বিলীন হয়ে গেল, স্বার্থপর ইহুদি জাতি তাদের অস্তিত্বকে সুসংবদ্ধভাবে প্রতিষ্ঠিত করে বিশ্বনেতৃত্বের অংশীদার হয়ে গেল।
বাঙালি হিন্দু সারা ভারতকে আলোকিত করেছে, সমৃদ্ধ করেছে, সন্মানিত করেছে, মিষ্টতা দিয়েছে, (বঙ্কিম-রবীন্দ্ৰ-শরৎ-রবিশঙ্কর-হেমন্ত-মান্না-কিশোর-ভূপেন হাজারিকা)। কিন্তু মানা-গড়চিরোলি-রুদ্রপুর-আন্দামান-আসামের বাঙালিদের দিকে তাকানোর অবসর কারো নেই। এমনকি বাঙালি বোদ্ধাদেরও নেই। সমস্ত মহানতা, বৌদ্ধিক, সাংস্কৃতিক ও অন্তরের সম্পদ দিয়ে সারা ভারতকে সমৃদ্ধ করে বাঙালি আজ-নিঃস্ব হয়ে গিয়েছে। এই প্ৰজাতি টিকবে না। এদের মধ্যে একটা অংশ কোনরকমে বড়জোর হিন্দু হয়ে বেঁচে থাকতে পারবে। তারা রবীন্দ্ৰ-শরৎ-বঙ্কিম-শরদিন্দু অন্য কোন ভারতীয় ভাষার অনুবাদ পড়বে। বাংলা ও বাঙালির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
(পুনশ্চঃ তপন ঘোষেরও কোন বাঙালি আলাসিঙ্গা পেরুমল জোটেনি। জুটেছে- রবি রাঘবন, তামিল, হিউস্টন প্রবাসী)।
(সমাপ্ত)
সৌজন্যেঃ স্বদেশ সংহতি সংবাদ। পূজা সংখ্যা; ২০১৭, পৃষ্ঠা – ৬
লেখকঃ শ্রী তপন ঘোষ….