হারাম : ‘এপ্রিল ফুল’ ও মুসলিমদের পুড়িয়ে মারার বানোয়াট গল্প। আপনি যদি এপ্রিল মাসের এক তারিখ কাউকে ফান করে বোকা বানিয়ে মজা করেন তাহলে নির্ঘাৎ আপনাকে গম্ভীর আহত গলায় শুনতে হবে, এপ্রিল ফুল পালন করা মুসলমানদের জন্য লজ্জ্বাজনক!
এই দিন মুসলমানদের বোকা বানিয়ে ধোঁকা দিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছিলো… ইত্যাদি। এমনিতে মুসলমান হবার মত অভিশাপ আর কিছুতে নেই!
তাদের জন্য ভ্যালেন্টটাইন ডে হারাম, পহেলা বৈশাখ হারাম, চৈত্র সংক্রান্তি হারাম, শহীদ মিনার হারাম, মঙ্গল শোভাযাত্রা হারাম, জাতীয় সংগীত হারাম, রবীন্দ্রনাথ হারাম, ইংরেজি নববর্ষ হারাম, ক্রিসমাসের কেক হারাম, দুর্গাপুজার লাড্ডু হারাম… হারামে হারামে মুসলমানের জীবন জর্জরিত!
একাধিক স্ত্রী আর দাসী সহবত ছাড়া তাই মুসলমানের জীবনে কোন উৎসব নেই, আনন্দ নেই, ফান নেই। ভিন্ন জাতি সম্প্রদায়ের উৎসবের প্রতি তাই মুসলমানদের সহজাত আকর্ষণ তৈরি হয়।
আর এই আকর্ষণকে নানা রকম মিথ্যা গল্প তৈরি করে দমন করার সহি ইসলামী তড়িকার নাম হচ্ছে ‘তাকিয়া’। সহজ বাংলায় দ্বিনের স্বার্থে মিথ্যা বলা। যেমন খ্রিস্টানদের প্রতি ঘৃণা জাগ্রত করে মুসলিম জাতীয়তাবোধের আবেগ সৃষ্টির জন্য পহেলা এপ্রিল মুসলমানদের পুড়িয়ে মারার গল্প তৈরি করা হয়েছে।
মুসলমানরা দাবী করে স্পেনে মুসলিমদের পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিলো এপ্রিলের এক তারিখে। মুসলমানদের বলা হয়েছিলো তারা যদি আত্মসমর্পন করে মসজিদে গিয়ে আশ্রয় নেয় তাহলে তাদের কোন ক্ষতি করা হবে না।
এই শুনে সরল বিশ্বাসে মুসলমানরা মসজিদে গিয়ে প্রবেশ করলে খ্রিস্টানরা মসজিদের দরজা বাইরে থেকে আটকে দিয়ে মুসলমানদের জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করে। যেহেতু মুসলমানদের ধোঁকা দিয়ে বোকা বানিয়ে মারা হয়েছিলো তাই খ্রিস্টানটা এই দিনটাকে ‘এপ্রিল ফুল’ বা এপ্রিলের বোকা হিসেবে আনন্দ করে কাটায়…।
এপ্রিল ফুল
এই গল্পের মধ্যে মানুষকে পুড়িয়ে মেরে সেই দিনটিকে আনন্দ করে কাটানোর মধ্যে যে পরিমাণ ঘৃণা জাগ্রত হতে পারে একটি সম্প্রদায়ের প্রতি তার সবটাই রাখা হয়েছে।
মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে আপনার পাড়ার টাকনুর উপর প্যান্ট আর গলায় টাই বাধা ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তার বড় ভাইকে বলতে শুনবেন এই এপ্রিলের এক তারিখে স্পেনের রানী ইসাবেলা মুসলমানদের বোকা বানিয়ে পুড়িয়ে মেরেছিলো! আর তোমরা মুসলমানরা সেই দিনটাকে পালন করো এপ্রিল ফুল হিসেবে ছি:…।
আসল ঘটনা হচ্ছে স্পেন থেকে মুসলিম শাসনের অবসান মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই ঘটেছিলো। রানী ইসাবেলা (এই প্রখর বুদ্ধিমতী নারীই কলম্বাসকে আমেরিকা আবিস্কার অভিযানে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন) স্পেন থেকে মুসলিম শাসন হটাতে আস্তে আস্তে ছোট ছোট অংশ দখল করে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন।
মুসলিম শাসন স্পেনে শুরু হয় ৭১১ খ্রিস্টাব্দে। ইসাবেলা ১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারী স্পেনের শেষ মুসলিম শাসনের খলিফা দ্বাদশ মোহাম্মদের হাত থেকে শান্তিপূর্ণভাবে নগরের চাবি গ্রহণ করেন।
দ্বাদশ মোহাম্মদকে আটক করেও ইসাবালা তাকে ছেড়ে দেন। ইতিহাস থেকে দেখা যাচ্ছে গ্রানাডা হস্তগত হয়েছিলো জানুয়ারির ২ তারিখে। স্পেনের ইতিহাসে কোথাও মসজিদে আটক করে পুড়িয়ে মারার ঘটনার উল্লেখ নেই। মুসলমানদের এই পুড়িয়ে মারার গল্পের কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই।
দ্বিতীয়ত রানী ইসাবেলাকে জড়িয়ে স্পেনের পতনের দিনে (২ জানুয়ারি) মুসলমানদের পুড়িয়ে মারার কথিত এপ্রিলের ১ তারিখের সঙ্গে মেলে না।
কারণ জানুয়ারির ২ তারিখ ইসবেলা দ্বাদশ মোহাম্মদের হাত থেকে ক্ষমতা নেন। ইতিহাসে স্পষ্ট করে লেখা আছে, ‘The end of Muslim rule at the heart of Spain came to an end on January 2, 1492 when Boabdil relinquished the keys to the Moorish capital to King Ferdinand and Queen Isabella. বিস্তারিত জানতে পড়ুন এখান থেকে– আর এখানে।
‘এপ্রিল ফুল’ আসলে বহু প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা একটা উৎসব যা বিবর্তিত হয়ে এসেছে। লন্ডনে একবার ‘এপ্রিল ফুল’ বানাতে টাওয়ার অব লন্ডনের শহরবাসীকে গুজব ছড়িয়ে একত্রে জড়া করা হয়েছিলো। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এপ্রিলের ১ তারিখকে বসন্তের প্রথম দিন ধরে আনন্দ করে কাটানোর রেওয়াজ আছে।
এই দিনটি কোন মতেই মুসলিম পুড়িয়ে হত্যা করার মত কোন ঘৃণ্য ঘটনার সাক্ষি নয়। শুধুমাত্র ধর্মীয় ঘৃণা বিদ্বেষ জাগ্রত করতেই মুসলিম বিশ্বে এই গল্প চালু করা হয়েছিলো। ছোটবেলা ঘুড়ি উড়ানোর সখ ছিলো। বাসায় যে হুজুর আমাকে আরবী পড়াতে আসত তিনি বলতেন, মুসলমানদের জন্য ঘুড়ি উড়ানো হারাম। কারণ কাফেররা মুসলমানদের পরাজিত করার পর আনন্দ করে ঘুড়ি উড়িয়েছিলো…।
বাসা থেকে একটু দূরে শত বছরের পুরোনো বৈশাখী মেলা হতো। এখনো হয় শুনেছি। এক মাসের সেই মেলায় ছোটবেলায় আমি রোজ যেতাম।
সেখানেও হুজুরের হানা! মেলায় যাওয়া হারাম। কাফেররা কাবাঘরের সামনে মেলা বসাতো… ইত্যাদি। তা ইসলামের বিনোদনের কি আছে তাহলে? বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, একাধিক স্ত্রী ও দাসি সহবত ছাড়া ইসলামে আলাদা কোন বিনোদনের অনুমোদন নেই। এমনকি অট্টহাসি দেয়াও ইসলামের অপছন্দ।
তীর-ধনুক আর ঘোড়া দৌড় ছাড়া অন্য কোন খেলাধুলা বিষয়েও ইসলাম ভীষণ রকমের রক্ষণশীল। এই দুটি খেলার অনুমোদন করা হয়েছে কারণ এগুলো জিহাদের ময়দানে দক্ষতা প্রদর্শনের উপর শত্রুদের পরাজিত করা নির্ভর করে।
কিন্তু মানুষ যেহেতু সহজাতভাবে আনন্দ উৎসবের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে তাই অন্যের ধর্মীয় বা জাতিগত উৎসবে যে যোগ দিবেই। যখন এটি বন্ধ করা যায় না তখনই এই রকম গল্প তৈরি করে মুসলমানদের মন বিষিয়ে তোলা হয়। সেই ধারা অব্যাহত থাকায় আজ মুসলিম মাত্রই অমুসলিমদের প্রতি ঘৃণা অবিশ্বাস সন্দেহ ছাড়া কল্পনাই করা যায় না!
Writer- Susupto Pathok
আর পড়ুন…