‘আমি একটি নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে চলেছি। আপানারা কি বলেন?’
বাদশাহ আকবরের এমন প্রশ্নের জবাবে উপস্থিত কেউ পাল্টা প্রশ্ন করার সাহস করেনি। নীরবতা উপলব্ধি করে আকবর নিজেই পুনরায় সহাস্যে বলে উঠলেন, ‘আমার সেই ধর্মমতের নাম হবে ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’। অর্থাৎ ‘ঈশ্বরের ধর্ম’।
‘তবে সে কিসের মাঝে অবস্থান করছে? তাকে বলে দাও, হয় ইসলাম নয় কুফরি। এর যেকোন একটিই গ্রহণযোগ্য। এর মাঝামাঝি কোনো অবস্থান থাকতে পারে না। আগে সে তার অবস্থান পরিষ্কার করুক। তারপর দেখা যাবে, সে কিভাবে ধর্মের প্রবর্তক সাজে।’
রাজদূতের মুখের উপরে সোজা বলে দিলেন সিরহিন্দের স্থানীয় সূফী হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানি। তার সেই বক্তব্য গিয়ে পৌছলো বাদশাহ আকবরের কানে। আকবর তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসার আদেশ দিলেন। আলফেসানিকে গ্রেফতার করা হলো।
হযরত মুজাদ্দেদ আলফেসানি সিরহিন্দের পরিণাম দেখে আর কেউ আকবরের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে সাহস করেনি। স্থানীয় আলেমরা ইতিমধ্যে আকবরের বশ্যতা স্বীকার করেছে। বিশেষ করে: আকবরের বেতনভুক্ত ধর্মীয় নেতারা এক প্রকার বিনাপ্রশ্নে ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’কে মেনে নেয়। তাদের দেখাদেখি দরবারের ব্রাহ্মণরাও একই কাজ করে। আকবর ঘোষনা করেন, একটি নতুন উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। যেখানে সবধর্মের ধর্মীয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী, পূণ্যার্থীর প্রবেশের সুযোগ থাকবে। কিন্তু কেমন হবে সেই নতুন ধর্মের রুপরেখা ? বাদশাহ জানালেন, সব ধর্মের ভাল কাজগুলিকে গ্রহণ এবং অপ্রয়োজনীয় কাজগুলিকে বর্জন করার পর যা থাকবে সেটাই হবে তার নতুন ধর্মের রুপরেখা। ১৫৭৫ সালে আকবর ফতেপুরে একটি উপসনালয় তৈরি করেন। নতুন প্রবর্তিত ধর্ম ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’তে দীক্ষিত হওয়ার ক্ষেত্রে আকবরের কিছু নিয়ম জারি ছিল। প্রথমে, আগ্রহী ব্যক্তিকে নতুন ধর্ম সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হতো। সমস্ত জিজ্ঞাসা শেষ হলে সপ্তাহের রবিবারে তাকে নতুন ধর্মে দীক্ষিত করা যেত। দীক্ষিত হওয়ার সময় তার পাগড়ি বাদশাহ আকবরের পায়ের সামনে নত করলে তিনি সেটা আবার দীক্ষিত ব্যক্তির মাথায় পড়িয়ে দিতেন। নতুন ধর্মে ‘বাদশাহই রাষ্ট্রের ধর্মীয় নেতা’ হিসেবে ছিলেন।
নব্য ধর্মের নিয়মনীতি ছিল বেশ কঠোর। মৃত মানুষকে সৎকারের ক্ষেত্রে নিয়ম ছিল, এমন জায়গায় তাকে পোড়াতে হবে যেখানে পানি নেই। আবার, কবরস্থ করার ক্ষেত্রে মৃতের মাথা থাকবে পূর্ব দিকে, পা থাকবে পশ্চিম দিকে। মুসলিমরা তখন অভিযোগ করে, পবিত্র কাবাকে অপমান করতেই বাদশাহের এই সিদ্ধান্ত। অবস্থা এমন হয়েছে যে, এই নিয়ম মানলে কাবার অপমান। আর তা করতে না চাইলে মৃতদেহ পুড়িয়েই সৎকার করতে হবে। আকবরের নতুন ধর্মমতে, জীবহত্যার একটা নিয়ন্ত্রণ রেখা দিয়ে দেওয়া হয়। প্রাণীদের মাঝে গরু হত্যা ছিল সম্পুর্ণরুপে নিষিদ্ধ। এই অপরাধের শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। তাছাড়া শিকারের উদ্দেশ্যে জীবহত্যা নিষিদ্ধ ছিল। অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে, গর্ভবতী বৃদ্ধা ও বন্ধা নারীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা যেত না। পূর্বে বিবাহিত বন্ধা স্ত্রীর বর্তমানে দ্বিতীয় বিয়ে করার উপরেও কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল। আকবর ব্যক্তিগতভাবে ধর্মীয় গুরুদের নামে নাম রাখাতে বিরক্তবোধ করতেন। নতুন ধর্মমতে, গৌতম কৃষ্ণ মুহম্মদ ঈসা মুসা দাউদ বা অন্যন্য কোনো ধর্মবেত্তার নামে কোনো শিশুর নাম রাখার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। তাছাড়া, নিকট আত্নীয়ের মৃত্যুতে মস্তক মুন্ডনের রীতিও ছিল এই ধর্মে। হামিদা বানুর মৃত্যুর পর আকবর তার মস্তক মুন্ডন করেন।
আকবরের পৈত্রিক ধর্মমতে, পুরুষদের সোনারুপা ও রেশমি কাপড় ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও আকবর সেই নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেন। বরং আকবরের নতুন ধর্মে রেশমি কাপড়ের ব্যবহার ছিল ব্যাপক। প্রার্থনার সময় রেশমি কাপড় পড়ে আসা বাধ্যতামূলক ছিল। দ্বীন-ই-ইলাহী অনুযায়ী, দিনে প্রার্থনা করতে হতো চারবার। প্রার্থনার সময় সূর্যের সহশ্র নাম জপতে হতো। সূর্যোদয় ও মধ্যরাত্রির প্রার্থনার গুরুত্ব ধরা হতো বেশি। আকবরের নতুন ধর্মের সবচেয়ে বিতর্কিত ব্যাপার ছিলো মুদ্রার মধ্যে ‘আল্লাহু আকবর’ খোদাই করা। এমনিতে মুসলিমরা আল্লাহু আকবর বলে থাকে কিন্তু এক্ষেত্রে সবাই ধরে নেয় আকবর নিজেকে আল্লাহু আকবর শব্দের সাথে মিশ্রিত করেছে। তার নিজের নাম আকবর বলেই সে আল্লাহর সাথে তার নিজের নাম জড়িয়েছে। তাছাড়া, দ্বীন-ই-ইলাহী তে দীক্ষিত অনুসারীরা একজন আরেকজনের সাথে দেখা হলে বলতো, ‘আল্লাহ আকবর’। প্রতিউত্তরে অন্যজন বলতো, ‘জল্লে জালালুহ’। অর্থাৎ তারই প্রশংসা। [এখানে তারই বলতে ‘আকবর’ কে বোঝানো হতো বাদশাহ আকবরকে]
ভাবুন তো, আকবরের দ্বীন-ই-ইলাহী যদি টিকে যেত তবে আমাদের, আপনাদের সর্বোপরি এই বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের ইতিহাস কেমন হতো ? ঐতিহাসিকেরা এখনো দ্বন্দ্বে ভুগেন আকবরের প্রকৃত ভাবাদর্শ নিয়ে। অনেকে বলেন, হীরা বাঈ, টোডরমল, বীরবল, মান সিংহদের সংস্পর্শে থেকে আকবর তার চিন্তা চেতনায় মারাত্নকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তবে এটাও ঠিক, তাদের বিরোধীতার মুখে এই আকবর-ই কিন্তু ১৫৮৫ সালে সতীদাহ নিষিদ্ধ করেন। কেউ কেউ তাঁকে ‘ইসলাম বিদ্বেষী’ বলেন। তবে এই অভিযোগটাও পুরোপুরি সত্য নয়। কারন, আকবর নতুন ধর্মমত প্রকাশ করলেও মসজিদ ধ্বংশের মিশনে নামেননি কিংবা নির্বিচারে মুসলিম হত্যা করেননি। বরং বাদশাহ আকবর হয়ত এমনকিছু করতে চেয়েছিলেন যা তাকে ইতিহাসে অমর করে রাখবে। যাতে ভবিষ্যত পৃথিবী তাকে মনে রাখে। আমি জানি না, তিনি কতটুকু সফল। ভবিষ্যতের জিজ্ঞাসু প্রজন্ম হয়ত তাকে নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করবে। ইতিহাসের এই মহানায়ক কি প্রকৃতই বিভ্রান্ত হয়েছিলেন ? নাকি এক পতাকার ছায়াতলে একটি বৃহৎ অঞ্চলকে ঐক্যবদ্ধ করতে চেয়েছিলেন, সেই প্রশ্নের উত্তরটা নাহয় ভবিষ্যতের জন্যই তোলা থাক।
আনসারি মুহম্মদ তৌফিক এর লেখাটা যথেষ্ট সময়োপযোগী তাতে কোন সন্দেহ নেই।