অনিতার (ডান দিকে) সঙ্গে বিজ্ঞানী ডেভিড অ্যাভেলিন। নাসার ‘কোল্ড অ্যাটম ল্যাবরেটরি’তে।
সমীকরণের (‘রায়চৌধুরী ইকোয়েশান’, প্রয়াত পদার্থবিদ অমল কুমার রায়চৌধুরী)
হাত ধরে স্টিফেন হকিং আজ স্টিফেন হকিং হলেন, তিনি পথিকৃৎ বাঙালি বিজ্ঞানী
হলেও, মহাকাশের অনন্ত রহস্যের খোঁজে তো এখনও বাঙালির নামটা উজ্জ্বল ভাবে
খোদাই হল না! কে বলল, হল না?
নাম। এক বঙ্গনারীর নাম। যিনি এক জন দাপুটে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার। নাসার
‘কোল্ড
অ্যাটম ল্যাবরেটরি’র প্রজেক্ট ম্যানেজার। অনিতা সেনগুপ্ত। মাত্র ৬
বছর বয়সে বাড়িতে সিরিয়াল ‘ডক্টর হু’ দেখে, মহাকাশ সম্পর্কে যাঁর আগ্রহের
সূত্রপাত হয়। যাঁকে সামনে রেখে এ বার মহাকাশে শীতলতম জায়গা খোঁজার অভিযানে
নামছে নাসা। যে অভিযান শুরু হবে আগামী বছরের অগস্টে। যখন পৃথিবীর প্রায়
চারশো কিলোমিটার ওপরে থাকা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (আইএসএস) শুরু হয়ে
যাবে সেই অগ্নিপরীক্ষা। যেখানে পদার্থের পরমাণুগুলোর অবস্থাটা হবে ‘ধর্মেও
আছি, জিরাফেও’ গোছের! যাকে বলে, ‘কোয়ান্টাম অবস্থা’। যে অবস্থায় কণার
তরঙ্গ-ধর্ম দেখা যায়! তরঙ্গ বা ঢেউ যেমন ছড়িয়ে পড়ে এক সঙ্গে অনেকটা জায়গা
জুড়ে, একটা ‘কোয়ান্টাম কণা’ও তেমনই অনেক জায়গায় বা অবস্থায় থাকতে পারে, একই
সঙ্গে, একই সময়ে। তাকে ধরা-ছোঁয়ার জন্য বানাতে হবে ‘কোয়ান্টাম গ্যাস’।
মঙ্গলে ‘মিস কিউরিওসিটি’ নামার পর নাসায় ক্যামেরার সামনে অনিতা।
সেই অগ্নিপরীক্ষার যাবতীয় প্রস্তুতি-তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে
ইতিমধ্যেই, দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় ঝকঝকে রোদে ঝলসে যাওয়া স্যান
গ্যাব্রিয়েল পর্বতমালায়। শতাব্দীর সেরা অগ্নিপরীক্ষার প্রাথমিক প্রস্তুতিটা
চলছে ওই পাহাড়-চুড়োতেই। পদার্থের পরমাণুর ওই অদ্ভুতুড়ে অবস্থায় পৌঁছনোর
জন্য প্রয়োজন কল্পনাতীত ঠাণ্ডায় পা রাখা। যেটা তুলনামূলক ভাবে সহজ ও সম্ভব
হতে পারে একমাত্র মহাকাশেই। খুব, খুব কনকনে, কল্পনাতীত ঠাণ্ডায় গ্যাসের
পরমাণুগুলোর শক্তি-সামর্থে একেবারেই কোনও ফারাক থাকে না। সেই ‘হীরক রাজার
দেশে’ তখন ওই অসম্ভব ঠাণ্ডা গ্যাসের সবক’টি পরমাণুই হয়ে পড়ে ‘আমরা সবাই
রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’! আর সেটা পদার্থের যে অবস্থায় সম্ভব, তাকে
বলে ‘বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট’।
আর মহাকাশে কার্যত সেই অসম্ভব কাজটাকেই সম্ভব করে তোলার প্রধান
দায়িত্বটা বর্তেছে এ বার যাঁর কাঁধে, তিনি আর কেউ নন, এক জন বঙ্গনারী-
অনিতা সেনগুপ্ত। নাসার ‘কোল্ড অ্যাটম ল্যাবরেটরি’র প্রজেক্ট ম্যানেজার।
যিনি এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিটা নিয়েছেন সাউথ
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিটার্বি স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে।
পৃথিবীতে এই ‘বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট’ অবস্থা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা
করাটা খুব, খুব মুশকিল। কারণ, পৃথিবীর সেই অতি পরিচিত মাধ্যাকর্ষণ বল
(গ্র্যাভিটি)।
যা সব কিছুকেই পৃথিবীর
কেন্দ্রের দিকে টানে। ফলে, আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহে যে জায়গায় পদার্থের ওই
অবস্থা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে, সেখানে চোখের পলক পড়তে না পড়তেই
ওই অবস্থায় থাকা পরমাণুগুলো নীচে থিতিয়ে পড়বে। তার ফলে, বেশি সময় ধরে
পর্যবেক্ষণের ফুরসতই পাবেন না বিজ্ঞানীরা। কিন্তু মহাকাশে, যেখানে অভিকর্য
বল কার্যত শূন্যই (মাইক্রো-গ্র্যাভিটি), সেখানে পদার্থের ওই বিশেষ অবস্থা-
‘বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট’কে নিয়ে অনেক বেশি সময় ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা,
পর্যবেক্ষণ করতে আর তা চালিয়ে যেতে পারবেন বিজ্ঞানীরা।
নাসার ‘কোল্ড অ্যাটম ল্যাবরেটরি’।
এই সদ্য ফেলে আসা ফেব্রুয়ারিতে নাসার ‘কোল্ড অ্যাটম ল্যাবরেটরি’তে দু’টি
মৌলিক পদার্থ- পটাসিয়াম আর রুবিডিয়ামের গ্যসীয় অবস্থাকে সেই কল্পনাতীত
ঠাণ্ডায় ‘কোয়ান্টাম গ্যাস’ বানানোর পরীক্ষায় সফল হয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। ২০১৪
সালেই রুবিডিয়ামের ‘কোয়ান্টাম গ্যাস’ বানাতে পেরেছিলেন বিজ্ঞানীরা। এ বার
সেই রুবিডিয়াম দিয়েই পটাসিয়ামেরও ‘কোয়ান্টাম গ্যাস’ বানাতে পেরেছে নাসার
‘কোল্ড অ্যাটম ল্যাবরেটরি’। কিন্তু তা খুবই অল্প সময়ের জন্য। তার ফলে, যে
উদ্দেশ্যে পদার্থের ওই অবস্থায় পৌঁছনোর জন্য হন্যে হয়ে উঠেছেন বিজ্ঞানীরা,
তা পুরোদস্তুর সফল হয়নি।
আরও পড়ুন- বেতার-বার্তায় বিপ্লব: বাঙালির বিজ্ঞানী কৌশিক
কী বলছেন বঙ্গনারী অনিতা?
তাঁর কথায়, ‘‘এটা সত্যি সত্যিই একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কারণ,
মহাকাশে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করার আগে আমরা দেখে নিতে চেয়েছিলাম, আমাদের
এই বাসযোগ্য গ্রহেও কৃত্রিম ভাবে ওই বিশেষ দু’টি মৌলিক গ্যাসের (পটাসিয়াম ও
রুবিডিয়াম) ‘কোয়ান্টাম অবস্থা’য় পৌঁছনো যায় কি না। বোঝা গিয়েছে, এটা
সম্ভব। আর সেটা পৃথিবীতেই সম্ভব হয়েছে, জোরালো মাধ্যাকর্ষণ বল থাকা
সত্ত্বেও। তা হলে মহাকাশে, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে কেন আমরা পৌঁছতে
পারব না ওই দু’টি বা আরও অন্য কোনও পদার্থের ‘কোয়ান্টাম অবস্থা’য়?’’
কোয়ান্টাম অবস্থার ‘ব্যান্ড ম্যাপিং’।
সেই ‘কোয়ান্টাম অবস্থা’য় পৌঁছতে এই পৃথিবীতে বসেই তাপমাত্রার পারদ কতটা নীচে নামাতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা?
নাসার ‘কোল্ড অ্যাটম ল্যাবরেটরি’র ডেপুটি প্রজেক্ট ম্যানেজার কমল
আউদরিহিরি বলেছেন, ‘‘আমরা পরম শূন্য তাপমাত্রার (অ্যাবসোলিউট জিরো বা
ডিগ্রি কেলভিন) দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ তাপমাত্রাতেও নামতে পেরেছি। হ্যাঁ,
খুব সামান্য সময়ের জন্য হলেও- এই পৃথিবীতেই।’’
এ বার মহাকাশে সেই ‘রূপকথা’র ‘কাহিনি’ লেখার মূল দায়িত্বটাই রয়েছে
বঙ্গনারী অনিতার হাতে। এমনও নয় যে, এই প্রথম মহাকাশে ‘রূপকথা’ লিখতে চলেছেন
অনিতা! মঙ্গলের মাটিতে মার্কিন ‘রোভার’ মহাকাশযান- ‘কুমারী কৌতুহল’- ‘মিস
কিউরিওসিটি’কে নামানোর জন্য যে ‘সুপারসোনিক প্যারাশ্যুট সিস্টেম’ ব্যবহার
করা হয়েছিল, তার সিস্টেম্স ইঞ্জিনিয়ারিং-এর নেত্রী ছিলেন অনিতাই।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন। যেখানে হবে সেই অগ্নিপরীক্ষা।
মহাকাশে আরও কত নীচে নামতে পারি আমরা? মহাকাশের মাইক্রো-গ্র্যাভিটিতে, হাড়-জমানো ঠাণ্ডায় আরও কতটা নীচে নামানো যায় তাপমাত্রার পারদ?
আত্মবিশ্বাসী অনিতার কথায়, ‘‘অন্তত এক পিকো-কেলভিন। আর সেই অবস্থাটা
মহাকাশের মাইক্রো-গ্র্যাভিটিতে ধরে রাখা যাবে অন্তত ২০ সেকেন্ড পর্যন্ত।’’
‘জীবনের মধুমাসের কুসুম ছিঁড়ে গাঁথা মালা’ হাতে নিয়েই আর চার মাস পরে সেপ্টেম্বরে এ দেশে আসছেন অনিতা।
অনিতার আসার বার্তা, ই মেলে। সঙ্গে আশ্বাসও।
যার ১১ মাস পর তাঁর স্বপ্নের প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে যাবে মহাকাশে।
ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এই প্রতিবেদককে পাঠানো ই মেলে অনিতা নিজেই
জানিয়েছেন তাঁর কলকাতায় আসার কথা। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘‘তখন একটা লম্বা
সাক্ষাৎকার দিতে পারব মনে হয়।’’