‘কাজী নজরুল ইসলামের লেখা পড়তে গিয়েই ভারতীয় পুরাণের সঙ্গে পরিচয়। বিশেষ করে “শিব” সবচেয়ে পছন্দের চরিত্র। একই সাথে অনেকটা বাস্তব মনে হয় শিবকে। ধর্মীয় বা অন্ধবিশ্বাসের কারণে না বরং অনেকটা যুক্তিগত কারণেই শিব পছন্দের আদর্শ। একই সঙ্গে ত্যাগী, দয়ালু আবার রুক্ষ! অন্যায়ের বিরুদ্ধে জারি আছে তার যুদ্ধ, একই সঙ্গে এ অঞ্চলের আদিম প্রানীদের অস্তিত্ব টিকে আছে তার কাল্পনিক চিত্রের মধ্যে, প্রায় ৮/১০ হাজার বছর ধরে। সব মিলে দুর্দান্ত চরিত্র! শিবের কথায়- সত্যের জয় হবেই, এটাই তো যে কোনো মহান বিপ্লবের প্রথম মন্ত্র!
অনেক আগে মহীবুল আজিজের একটা লেখা পড়েছিলাম। উনি সম্ভবত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক (নিশ্চিত তথ্য জানি না)। তার লেখা দুর্দান্ত মনে হয়েছিল, পরে তার দেয়া সকল তথ্যের যথাযথ প্রমাণ পেয়েছি ইতিহাস/পুরাণ/ধর্মে…তাই সেখান থেকেই কিছু বলা যায়…
“ভারতীয় সভ্যতা মাতৃকেন্দ্রিক। প্রাগার্যকালে ( বর্তমান ইতিহাস বিদরা বলছে আর্যরা ভারতবষেরী মানুষ ছিল। তারা বৈহিরাগত নয়) মহেঞ্জোদাড়ো-হরপ্পা তথা সিন্ধুসংস্কৃতিতে নারী-আরাধনার প্রভূত রূপকল্প বিদ্যমান ছিল বলে নৃ-বিজ্ঞানীদের ধারণা। সিন্ধুসংস্কৃতির জলিলপুর, সুমলা, সরাইখোলা অর্থাৎ কোট-দিজিয়ান অঞ্চলে প্রাপ্ত নারীমূর্তির বিশেষায়িত উপস্থাপনা তারই স্মারক। এখানে নারীর সূত্রে এসে যাবে পুরুষ দেবতার অনুষঙ্গ—তিনি শিব। শিবও প্রাগার্য দেবতা…
শিব নজরুলের সুপ্তিমগ্ন চেতন-অবচেতনায় ও শিল্পসূত্রযোজনায় বিচিত্র—যেমন: রুদ্র, ভৈরব, দিগম্বর, ধূর্জটি, ব্যোমকেশ, পিনাকী, ত্রিশূলী, শিব, মহেশ, শঙ্কর, নটরাজ প্রভৃতি।
শিব প্রাগার্য যুগে ছিলেন সৃষ্টিরই দেবতা, কেননা সৃষ্টির যাবতীয় অনুষঙ্গে তাঁর বর্তমানতা। সিন্ধুসভ্যতা সম্পূর্ণরূপে অশ্ববিহীন এবং ষাঁড়াশ্রিত। আবিষ্কৃত বিভিন্ন ষাঁড়-সিলমোহরে কৃষিজীবী সিন্ধুবাসীদের সেই পশুকেন্দ্রিকতা আজও শিবকে স্মরণ করায় তাঁর ষাঁড়-বাহনের প্রতিপাদ্যে। আর্যরা শিববিরোধী ছিল এমন একটা ধরণা ছিল কিছু ঐতিহাসিকদের। আর্যরচিত বেদ বা অন্য গ্রহন্থে কিন্তু অন্য কথা বলছে। ভারতবর্ষীয় প্রকৃত সৃষ্টির দেবতা শিব হয়ে গেলেন কালক্রমে প্রলয়ের দেবতা, হয়ে গেলেন অপ্রকৃতিস্থ, সিদ্ধিখোর দেবতা।
শিব প্রাগার্য যুগে ছিলেন সৃষ্টিরই দেবতা, কেননা সৃষ্টির যাবতীয় অনুষঙ্গে তাঁর বর্তমানতা। সিন্ধুসভ্যতা সম্পূর্ণরূপে অশ্ববিহীন এবং ষাঁড়াশ্রিত। আবিষ্কৃত বিভিন্ন ষাঁড়-সিলমোহরে কৃষিজীবী সিন্ধুবাসীদের সেই পশুকেন্দ্রিকতা আজও শিবকে স্মরণ করায় তাঁর ষাঁড়-বাহনের প্রতিপাদ্যে। আর্যরা শিববিরোধী ছিল এমন একটা ধরণা ছিল কিছু ঐতিহাসিকদের। আর্যরচিত বেদ বা অন্য গ্রহন্থে কিন্তু অন্য কথা বলছে। ভারতবর্ষীয় প্রকৃত সৃষ্টির দেবতা শিব হয়ে গেলেন কালক্রমে প্রলয়ের দেবতা, হয়ে গেলেন অপ্রকৃতিস্থ, সিদ্ধিখোর দেবতা।
আমরা যদি লক্ষ্য করি সমগ্র উত্তর ভারত তথা আর্যাবর্ত আর্যপ্রভাবের কারণেই দেবী বা মাতৃমূর্তিসমূহ। —আর তাদের কেন্দ্রভাগে থাকেন দশ-শক্তির উৎস মহিষাসুর। উত্তর ভারতেও হাজার হাজার বছরের প্রাচীন দেবতা শিব এবং শিবানীকে (কালী) জনমানস থেকে মুছে ফেলা সম্ভব হয় না বিভিন্ন বিদেশী শক্তির পক্ষে। সেই প্রাচীন শিব এবং সেই প্রাচীন ‘মা’কে নানা রূপে-ভাবে-প্রতীকে উপস্থিত হতে দেখা যায় নজরুলের কবিতায়। তাঁরা মূলত সৃষ্টির, আবার প্রলয়েরও। সৃষ্টি-প্রলয়ের নজরুলীয় শিব-শিবানী ভারতীয় প্রত্ন-মানস থেকে উদ্ধৃত হয়ে গ্রথিত হন সমকালীন মানসে—যুগের প্রয়োজনে।”
কবি নজরুল ঠিক যে কারণে বিদ্রোহী ছিলেন অর্থাৎ সমাজ শ্রেণী/জাত/ধর্মের ভাগ বাটোয়ারা/ব্যবসা/শোষণ/পরাধীনতা…
মাতৃ শক্তিকেন্দ্রিক চিন্তার কারণে কবি নজরুলের মায়ের শরণ কাজেই শক্তির শরণ। সে কঠিন অভিযাত্রায় শক্তির সঞ্চারক শিব। প্রবল আর্য-প্রভাব ও আর্য-প্রসারণের পরও যেমন প্রাগার্য যুগের শিব-দুর্গাকে হঠানো সম্ভব হয় না। ঠিক একই ভাবে সমাজের জন্য যারা আজও যারা সংগ্রাম করছেন তাদের জয়ও নিশ্চিত। সবই সময় বলে দেবে।
ছবিটা ২০১৫ সালে আঁকা। শিল্পী #জহুরের আঁকা শিবের অনুকরণে এঁকেছিলাম…