বাংলাদেশের হিন্দু নারীদের পিতার সম্পত্তিতে কোন অধিকার নেই। সরকার হিন্দু নারীদের জন্য আইন করতে চাইলে হিন্দু ধর্মীয় নেতারা এর তীব্র আপত্তি করেন। এমনকি হিন্দু সম্প্রদায়ের সব শ্রেণীর সাধারণ মানুষও এটাকে স্বাগত জানান না। আমি এটা নিয়ে বেশ কিছু লেখা লেখার পর আমার পরিচিত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ আমাকে বলেছেন, আমার মেয়ে আমার সম্পত্তি পাবে এতে তো আমার অখুশি হওয়ার কিছু নেই। কিংবা আমার বোন আমার বাপের সম্পত্তির ভাগ পাবে আমি কেন তাতে বাধা দিবো? বরং সম্পত্তির ভাগ দিলে হিন্দু বিয়ের যৌতুক প্রথাই উঠে যাবে। তাছাড়া ভারতের হিন্দু নারীদের আইন করে সম্পত্তির ভাগ দেয়া হয়েছে। ভারতের সবচেয়ে কট্ট হিন্দু মৌলবাদীও এই আইনের বিরোধীতা করে না। কাজেই এখানে হিন্দু ধর্মীয় কোন গোঁড়ামী নেই। আসলে বাংলাদেশের হিন্দুরা তাদের সম্পত্তি মুসলিমদের হাতে বেহাত হওয়ার ভয়েই এই আইনের বিরোধীতা করে…।
একটা ধর্মের কমিউনিটির লোক না হলে সেই সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরের গভীর গোপন কথাগুলো অনেক সময়ই আমরা জানতে পারি না। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিয়ে দীর্ঘদিন লেখালেখির পরও আমি হিন্দুদের এই ভয়ের কথা জানতাম না। হিন্দুরা এসব কথা প্রকাশ্যেও বলতে পারে না কারণ কথাটা শুনতে রেসিজম টাইপ লাগে। কিন্তু বাংলাদেশের হিন্দুদের আশংকা অমূলক নয়। তাদের চোখের সামনে পাকিস্তানের উদাহরণ আছে। পাকিস্তান সরকার হিন্দু নারীদের তাদের বাপের সম্পত্তিতে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যে আইন পাস করেছে তার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানী হিন্দু মেয়েদের কিডন্যাপের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে বাড়তে থাকে। পাকিস্তানী মেয়েদের উঠিয়ে নিয়ে জোর করে বিয়ে করে মুসলমান বানানো হয়। তারপর আদালতের মাধ্যমে স্ত্রীর সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে আদায় করা হয়। এভাবে পাকিস্তানী হিন্দুদের সম্পত্তি দখল হয়ে যাচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের হাতে। পরিসংখ্যান বলছে পাকিস্তানে প্রত্যেকদিন হিন্দু মেয়েদের জোর করে ধর্মান্তকরণ করে মুসলমান বানানো হয়। ৪৭ সালে দেশভাগের কালে পাকিস্তানে হিন্দু সম্প্রদায়ের হার ছিল ২৩ শতাংশ। এখন সেটা কমে ১ শতাংশেরও নিচে গিয়ে ঠেকেছে। হিন্দুরা তাদের সন্মান আর জীবন বাঁচাতে পাকিস্তানে তাদের জন্মস্থান ফেলে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। পাকিস্তান সরকার দেশটির ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা তো দূরের কথা বরং সংবিধানে আইন করে তাদের তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করে রেখেছে…।
পাকিস্তানের হিন্দুদের এই করুণ পরিণতি সংবাদ বাংলাদেশের কয়েকটা সংবাদ মাধ্যমে ঘুরতে দেখা যাচ্ছে। অথচ একই কাহিনী বাংলাদেশের হিন্দুদের ক্ষেত্রে ঘটার পরও এই মিডিয়াগুলোর উদাসিনতা চোখে পড়ার মত। আদিবাসী পাহাড়ীদের বিষয়ে তো মিডিয়াগুলো বিমাতার সুলভ আচরণ লক্ষণীয়। ধর্মের পরিচয়ে দেশভাগের পর পাকিস্তান বাংলাদেশ পুরোপুরিই মুসলমানদের দেশ। এই দেশগুলি থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগ আজ তাদের বিলুপ্ত করে ফেলেছে। পক্ষান্তরে ভারত থেকে কোন মুসলমান, খ্রিস্টান, শিখ বৌদ্ধসহ আরো শতাধিক জাতি ও ধর্মীয় গোষ্ঠির দেশত্যাগের নজির নেই। এই বিষয়টির এক যুগান্তকরী তত্ত্ব হাজির করেছিলেন গত বছর ব্যান্ড সংগীত শিল্পী মাকসুদুল হক সাহেব। তিনি বলেছিলেন ভারতের মুসলমানরা দেশপ্রেমিক বলেই তারা দেশত্যাগ করে না। বাংলাদেশের হিন্দুদের দেশপ্রেম নেই তাই তারা ভারত সরকারের কাছে নিজেদের নির্যাতনের বিচার চায়… ইত্যাদি। মজাটা হচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের কি তাহলে কোন দেশপ্রেম নেই? দেশত্যাগী ইরাকী সিরিয়ান মুসলমান, মিশরীয় কপ্টিক খ্রিস্টান, আফগানিস্থানের হাজার হাজার মানুষ দেশ ছেড়ে পাকিস্তানে শরণার্থী হয়েছিল কারণ তাদের কারোই দেশপ্রেম ছিল না? থাকলে তারা নিজের দেশেই পড়ে পড়ে মার খেয়ে মরত?… এখনেও সেই কমিউনিটি গ্যাপ। সংখ্যাগুরুর সঙ্গে সংখ্যালঘুর গ্যাপ…।
লেখক,
সু-পাঠক