বাংলা:দাঙ্গায় নাঙ্গা-(১)
————————————–
এই রথযাত্রায় ধর্মীয় হামলার আশংকায় বিখ্যাত ধামরাই রথযাত্রা নিশিদ্ধ করে বাংলাদেশের প্রশাসন অনেকের নজর কেড়েছে, কেউ বা বিক্ষোভে ফেঁটে পরেছে! তাদের জ্ঞাতার্থে এই লেখা বাংলায় চলে আসা ভয়াল সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে |
এই রথযাত্রা বন্ধ আজকের নতুন ইতিহাস নয়! ১৯৪৮ সালে বিখ্যাত ধামরাই রথযাত্রা এবং জন্মাষ্টমী শোভাযাত্রা নিশিদ্ধ করা হয়। ১৯৪৯ সালে সমগ্র ঢাকা অঞ্চলে বাঙ্গালী হিন্দুদের সব চেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার বিরুদ্ধে পোস্টার লাগানো হয়।আর সেজন্য দুর্গাপূজার আয়তন এবং সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে হ্রাস পায়।বিজয়া দশমীর দিনে শত শত হিন্দুদের বাড়ি ঘরে অগ্নি সংযোগ করেন মুসলিমরা।ফলে কমপক্ষে ৭৫০ টি হিন্দু পরিবারকে খোলা আকাশের নিচে নেমে আসতে হয়।প্রেস ট্রাস্ট অব ইণ্ডিয়া বা পিটিআই (PTI) এর প্রতিনিধি সন্তোষ চট্টোপাধ্যায়কে কোন রকম অভিযোগপত্র ছাড়াই ১৯৪৯ সালের ২৫শে নভেম্বরে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং একমাস জেলে বন্দী করে রাখে।
১৯৪৯-১৯৫০:
——————
১৯৪৯ সালের আগস্ট মাস থেকে সমগ্র পূর্ব বাংলা জুড়ে হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপর নৃশংস বর্বরতা শুরু করে মুসলিম সম্প্রদায় যা প্রায় তিন মাস জুড়ে চলতে থাকে। আগস্ট মাসে সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার এবং বড়লেখা পুলিশ স্টেশন এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর স্থানীয় মুসলিমরা ,পুলিশ এবং আনসার বাহিনীর সহযোগিতায় আক্রমণ শুরু করে।হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘর লুটপাট করা হয়,ভেঙ্গে দেওয়া হয় এবং আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। হিন্দু গ্রামবাসীদের অনেককে হত্যা করা হয়। হিন্দু মেয়েদের পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা ধর্ষণ করে। তার কিছুদিন পরেই বরিশাল জেলার ভাণ্ডারিয়া গ্রামের হিন্দুরা আক্রান্ত হয়।রাজশাহী বিভাগের পাদ্রী ফাদার থমাস ক্যাটানিও রিপোর্ট করেন যে সেখানকার সাঁওতাল গ্রামের অধিবাসীরা আক্রান্ত হয়েছে ও তাদেরকে আটক করা হয়েছে এবং সাঁওতাল নারীদেরকে ধর্ষণ করা হয়েছে।
কালশিরা:
————
১৯৪৯ সালের ২০শে ডিসেম্বরে খুলনা জেলার বাগেরহাট উপজেলার মোল্লাহাটে জয়দেব বর্মের বাড়ীতে কম্যুনিস্ট সদস্য লুকিয়ে আছে এই অভিযোগে শেষরাতে চারজন পুলিশ কনস্টেবল অভিযান চালায়। কিন্তু জয়দেবের বাড়ীতে কোন কম্যুনিস্ট সদস্যকে খুঁজে না পেয়ে পুলিশ সদস্যরা তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করতে চেষ্টা করে। তার স্ত্রী চিৎকার শুরু করলে জয়দেব বর্ম এবং তার আত্মীয়রা ক্ষিপ্ত হয়ে দুইজন পুলিশ কনস্টেবলের উপর চড়াও হয় এবং ঘটনাক্রমে একজন পুলিশ কনস্টেবল সেখানেই মারা যায়! বাকি দুজন পুলিশ বিপদ ঘণ্টা বাজিয়ে দিলে পাশের প্রতিবেশীরা এসে তাদের উদ্ধার করে। পরের দিন জেলা পুলিশ সুপারিনটেনড সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী এবং আনসার বাহিনী সাথে নিয়ে কালশিরা এবং এর আশেপাশের হিন্দু গ্রামগুলোতে নির্মম আক্রমণ শুরু করে। তারা আশেপাশের গ্রামগুলোর মুসলিম অধিবাসীদেরকে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর এবং সম্পত্তি লুটপাটে উৎসাহ দেয়।তারা নির্দয় ভাবে হত্যা শুরু করে এবং হিন্দু পুরুষ মহিলাদেরকে জোর করে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে।মন্দিরগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়। গ্রামগুলোর ৩৫০টা বাড়ির সব গুলোকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। মাত্র তিনটে ঘর অবশিষ্ট ছিল! মাত্র এক মাসের নৃশংস গনহত্যায় খুলনার ৩০,০০০ হিন্দু প্রাণের ভয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল !
নাচোল:
———-
১৯৪৯ সালে আন্দোলনের মাধ্যমে তেভাগা প্রতিষ্ঠিত হয়। ৫ই জানুয়ারি, ১৯৫০ সালে নাচোল পুলিশ স্টেশনের চণ্ডীপুর গ্রামের সাঁওতাল অধিবাসীরা পুলিস স্টেশনের সামনে বিক্ষোভ শুরু বিনা কারণে একজন সাঁওতাল আদিবাসীকে আটক করার জন্য। পুলিশ ওই জনসমাবেশের ওপর গুলি চালালে সাঁওতাল আদিবাসীরা খেপে ওঠে এবং পুলিশের সাথে তাদের খন্ডযুদ্ধ শুরু হয়। ঘটনাস্থলে পাঁচ জন পুলিশ বাহিনীর সদস্য মারা যায়। ৭ই জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার ২,০০০ সদস্যের একটি সেনাবাহিনীর কন্টিনজেন্ট পাঠায় এবং তার সাথে সশস্ত্র পুলিশ ও আনসার বাহিনী। সেই সশস্ত্র বাহিনী বারটি গ্রাম সম্পূর্ণ পুড়িয়ে ভস্ম করে দিয়েছিল,চণ্ডীপুরগামী গ্রামবাসীদেরকে ধরে ধরে হত্যা করেছিল।চণ্ডীপুরের পুরুষ সদস্যদেরকে তারা হত্যা করে আর মহিলাদেরকে ধর্ষণ করে।শতশত সাঁওতাল এবং হিন্দুদেরকে এভাবে হত্যা করা হয়। রোহানপুরের তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ইলা মিত্র সহ আরও শতাধিক দরিদ্র কৃষককে গ্রেফতার করা হয়।নাচোল পুলিশ স্টেশনে নিয়ে তাদের উপর নৃশংস অত্যাচার চালানো হয় বাকি নেতাদের নাম জানার জন্য।পুলিশের এই বর্বর অত্যাচারে সেখানেই প্রায় ৭০থেকে১০০ জন কৃষক মারা যায়। ইলা মিত্রকে নওয়াবগঞ্জ পুলিশ স্টেশনে হস্তান্তরের আগে টানা চার দিন ধরে পাশবিক শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা।
(চলবে………….)