বাঙালির গৌরব মহারাজা প্রতাপাদিত্য
——————————————————-
।চতুর্থ পর্ব।
মহারাজা প্রতাপাদিত্য জানতে পারলেন যে, পার্শ্ববর্তী বিক্রমপুরের শাসনকর্তা চাঁদ রায় ও তাঁর ভাই কেদার রায়ও স্বাধীন রাজ্য স্থাপনে ব্রতী হয়েছেন এবং প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে রচিত মিত্রতাসূত্র ছিন্ন করার জন্য তাঁরা বদ্ধপরিকর।
স্বভাবতই প্রতাপ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সেনাপতিদের সঙ্গে গভীর মন্ত্রণার পর অতর্কিতে বিক্রমপুরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন প্রতাপাদিত্য। চারদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়লো বিক্রমপুর। এই ঝটিকা ধাক্কা সামলাতে পারলেন না চাঁদ রায়। পরাজয় নিশ্চিত জেনে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করলেন বিক্রমপুরাধিপতি চাঁদ রায়। সুচতুর প্রতাপাদিত্য সন্ধি করে ফেললেন চাঁদ রায়ের সঙ্গে। উজবেকিস্তান থেকে আসা দখলদার মুঘল সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য লড়াইয়ে আরো একজন সঙ্গী বাড়িয়ে নিলেন তিনি।
এবার প্রতাপাদিত্য আসল কাজে হাত দিলেন। ঘনিষ্ঠ মহলের সঙ্গে বহু আলাপ-আলোচনার পর প্রতাপ বুঝলেন, মুঘল সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে অসম লড়াইয়ে বিজয়ী হতে হলে, পূর্বভারতের সমস্ত মুঘল বিরোধী স্থানীয় শক্তির বৃহত্তর মৈত্রী স্থাপন করা প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যে বাল্যবন্ধু শঙ্কর চক্রবর্তীকে তিনি পাঠিয়ে দিলেন পার্শ্ববর্তী উড়িষ্যা ও বিহার প্রদেশে সমমনস্ক মুঘল বিরোধী শক্তিগুলির সঙ্গে কথাবার্তা চালানোর জন্য।
ধীরে ধীরে সুন্দর ভাবে কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন বুদ্ধিদীপ্ত শঙ্কর চক্রবর্তী। উড়িষ্যার তৎকালীন একজন প্রধান শাসনকর্তা রামচন্দ্রের সঙ্গে আলোচনা সফল হলো। বিহারের বিদ্রোহী পাঠান সেনানায়ক কতলু খাঁ ও ওসমান খাঁর সঙ্গে পরবর্তী রণপ্রস্তুতি নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা চলতে লাগলো। এরই মধ্যে শঙ্কর গিয়ে উপস্থিত হলেন মিথিলায়। এখানে গণ্ডক নদীর তীরে তিনি দেবী ভগবতীর প্রতিমা সংস্থাপন করেছিলেন। এরপর তিনি রাজমহল প্রদেশে একটি সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় উদ্ধত প্রকৃতির মুঘলশাসনকর্তা শের খাঁর সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। বস্তুত শের খাঁ আগে থেকেই গুপ্তচর মারফত শঙ্কর চক্রবর্তীর উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন এবং যেকোন ছুতোয় তাঁকে বন্দী করার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন। রাজদ্রোহের অপরাধে অভিযুক্ত এক ব্রাহ্মণকে শঙ্কর আশ্রয় দিয়েছেন – এই মিথ্যা অভিযোগ এনে, শের খাঁ কূটকৌশলে শঙ্কর চক্রবর্তীকে বন্দী করে ফেললেন। এই খবর পাওয়া মাত্র প্রতাপাদিত্য অত্যন্ত ধূর্ততার সাথে কারারক্ষীদের ঘুষ দিয়ে,বাল্যবন্ধু শঙ্কর চক্রবর্তীকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করলেন।
কারামুক্ত শঙ্কর চক্রবর্তী তীরের গতিতে যশোহরের দিকে এগিয়ে গেলেন। শের খাঁ শঙ্করের পালানোর খবর পেয়ে গেলেন যথাসময়েই। প্রচণ্ড ক্রোধে সৈন্যবাহিনী নিয়ে তিনি এগিয়ে চললেন যশোহরের দিকে শঙ্কর ও প্রতাপাদিত্যকে উচিৎ শিক্ষা দেবার জন্য। এরকম ঘটনা যে ঘটতে পারে – প্রতাপাদিত্য তা আগেই অনুমান করতে পেরেছিলেন। এজন্য প্রতাপাদিত্য আগেভাগেই তাঁর সৈন্যবাহিনীকে তিনভাগে বিভক্ত করে, শের খাঁর সম্মুখীন হবার জন্য এগিয়ে চললেন। অল্প কিছু সৈন্য নিয়ে শের খাঁর সামনে এলেন শঙ্কর এবং পূর্ব পরিকল্পিত রণকৌশল অনুযায়ী তিনি প্রথমে শের খাঁর কাছে হেরে গিয়ে পালাতে শুরু করলেন। শের খাঁ বিপুল উৎসাহ নিয়ে তাড়া করলেন শঙ্করকে এবং এখানেই সবচেয়ে বড় ভুল করে বসলেন। শঙ্কর চক্রবর্তীর লুকিয়ে রাখা মূল বাহিনী, ঠিক সেই সময়েই রনভূমিতে আবির্ভূত হয়ে সংহারমূর্তি ধারন করলো। শুরু হল মরণপণ যুদ্ধ। ঠিক তখনই ডানদিক থেকে প্রতাপাদিত্য এবং বাঁদিক থেকে সূর্যকান্ত গুহ – তাঁদের বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শের খাঁর মুঘল বাহিনীর উপর। তার মধ্যে যোগ হল, ফ্রান্সিসকো রডার গোলন্দাজ বাহিনীর ভয়ঙ্কর গোলাবর্ষণ। শের খাঁ বুঝলেন তিনি শত্রুর দ্বারা বেষ্টিত হয়ে পড়েছেন। কোনোক্রমে পালিয়ে গেলেন তিনি। এই খবর আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। ফলস্বরূপ সমগ্র পূর্ব ভারত জুড়ে মুঘল সাম্রাজ্যে দেখা গেল নিদারুণ বিশৃঙ্খলা। কর দেওয়া বন্ধ করা থেকে, মুঘল সেনাছাউনি আক্রমণ, রাজস্ব লুট, গেরিলা কায়দায় মুঘল সেনাবাহিনীর যাতায়াতের রাস্তা নষ্ট করে দেওয়া ইত্যাদি চলতে থাকল অবাধে। যশোহর অধিপতি প্রতাপাদিত্যের অবিসংবাদিত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল সমগ্র বঙ্গদেশে।
সম্রাট আকবর ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। সম্রাট আগেই, কচু রায় এবং তাঁর ভগ্নিপতি ও অবিভাবক রূপরাম বসু মারফত প্রতাপাদিত্য সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিয়েছেন। তিনি নিজেও প্রতাপাদিত্যকে দেখেছেন। অনেক চিন্তাভাবনার পর সম্রাট আকবর, সেনাপতি ইব্রাহিম খাঁকে পাঠালেন প্রতাপাদিত্যকে দমন করার জন্য। ইব্রাহিম খা় দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের প্রস্তুতি সরূপ, প্রচুর রসদ ও সৈন্যবাহিনী বাংলার দিকে যাত্রা করলেন।
কিন্তু না! ইব্রাহিম খা়ঁও পারলেন না প্রতাপাদিত্যকে হারাতে। জলপথে পর্তুগীজ ফ্রান্সিসকো রডা তাঁর দুর্ধর্ষ নৌসেনাবাহিনী ও কামান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মুঘল বাহিনীর উপর। সম্পূর্ণ অজানা দুর্গম পরিবেশে, চারদিক থেকে প্রতাপাদিত্যের সৈন্যবাহিনীর বিক্ষিপ্ত চোরাগোপ্তা আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে গেলেন ইব্রাহিম খাঁ। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পরাজয় মেনে নিয়ে তিনি সেনাবাহিনীকে পশ্চাদপসরণ করার নির্দেশ দিলেন। প্রতাপাদিত্যের বাহিনী কালান্তক যমের মত পিছু ধাওয়া করলো। অতিকষ্টে পালিয়ে বাঁচলেন ইব্রাহিম খাঁ। বিজয়ী প্রতাপ যশোহরে ফিরে এলেন।
প্রতাপাদিত্য বুঝেছিলেন, পরপর এত পরাজয় সম্রাট আকবর মেনে নেবেন না। সুতরাং ‘আক্রমণই আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়’ – এই আপ্তবাক্য স্মরণ করে তিনি নিজেই মুঘল সাম্রাজ্য আক্রমণের জন্য সচেষ্ট হলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে যাতে কোন বিশৃঙ্খলা না সৃষ্টি হয় তাই পুরো প্রশাসনিক দায়িত্ব তিনি ভবানীদাস এবং লক্ষীকান্ত নামক দু’জন বিশ্বস্ত কর্মচারীর হাতে অর্পণ করে গেলেন। এই লক্ষীকান্তই বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের আদি পুরুষ। সমস্ত প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হলে প্রতাপাদিত্য বেরিয়ে পড়লেন। তিনি অতর্কিত আক্রমণ চালালেন বন্দর নগরী সপ্তগ্রামের উপর। সপ্তগ্রামের মুঘল সেনাঘাঁটি ছিল অপেক্ষাকৃত দুর্বল, তদুপরি অপ্রস্তুত। ফলে খুব সহজেই সপ্তগ্রাম চলে এল প্রতাপের মুঠোয়। এরপর গঙ্গার বুক বেয়ে প্রতাপাদিত্য চললেন রাজমহলের দিকে– দুর্গ অবরোধ করলেন – দীর্ঘ প্রতিরোধ চালিয়েও রাজমহল দখলে রাখতে পারল না মুঘল সেনা–বাধ্য হল আত্মসমর্পণ করতে।
এরপর প্রতাপাদিত্য এগিয়ে চললেন পাটনার দিকে। পথে তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন বিদ্রোহী পাঠান সেনানায়করা। আগেই যোগ দিয়েছিলেন উড়িষ্যা থেকে আসা মিত্র রাজারা। পাটনায় মুঘল দুর্গ অবরোধ করলেন প্রতাপ। আবার ঘটল ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। পাটনা দুর্গের পতন ঘটল অচিরেই। সারা পূর্ব ভারতে যশোহর অধিপতি প্রতাপাদিত্য হয়ে উঠলেন কিংবদন্তী।
(ক্রমশ)