মহম্মদ আলীজিন্নার আহ্বানে মুসলিম লীগের “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” দাবিতে তৎকালীল বাংলার মুসলীম মুখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দী রচিত হিন্দু গনহত্যা ১৯৪৬ সালে ১৬ ই আগস্ট ডাইরেক্ট-এ্যাকশন-ডে ইতিহাস।
“গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং” (১৯৪৬)- এর ভেতর বাহির
জিন্নার পূর্বপুরুষরা ছিলো হিন্দু এবং তারা ছিলো গুজরাটের বাসিন্দা। ‘কোনো হিন্দুর মুসলমান হয়ে যাওয়ার মানে শুধু হিন্দু সমাজের একজন সদস্য কমে যাওয়া নয়, একজন শত্রু বৃদ্ধি পাওয়া”-স্বামী বিবেকানন্দের এই বাণী যে কতখানি সত্য, তা বুঝতে পারবেন এই লেখাটি পড়লে এবং জিন্না যে হিন্দুদের কী ধরণের শত্রু হয়ে উঠেছিলো এবং সে হিন্দুদের যে কী পরিমান ক্ষতি করেছে, সে সম্পর্কেও একটা মোটামুটি ধারণা পাবেন এই প্রবন্ধে।
ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত জিন্নার প্রিয় কাজ ছিলো জলের মতো মদ খাওয়া। জীবনে নামাজ-রোযা করেছেন কি না সন্দেহ। শুকরের মাংস ছিলো তার প্রিয় খাদ্য। ভারতের মুসলমানদের জিন্না যথেষ্টই ঘৃণা করতো। তবু তার জ্ঞান-বুদ্ধির কারণে, মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক আবাসভূমি- পাকিস্তান-এর স্বপ্ন দেখা রহমত আলী, ১৯৩৩ সালে, জিন্নাকে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের জন্য আন্দোলন করার প্রস্তাব দিলে, জিন্না তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলো, “এটি একটি অসম্ভব স্বপ্ন।” কিন্তু রহমত কোরান খুলে জিন্নাহকে দেখিয়ে বলেছিলো, এ অসম্ভব নয়, সম্ভব।
মুসলমানদের জাগিয়ে পাকিস্তান আদায়ের জন্য সব রকম উপাদান কোরানের মধ্যে রয়েছে।” জিন্না বিষয়টি নিয়ে ভাবতে লাগলো এবং কোরানের তত্ত্ব জিন্নাকে এমনই প্রভাবিত করলো যে, পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভোর জিন্না কয়েক বছর পরেই বলে ফেললো, “কয়েক শতক আগে যেদিন প্রথম হিন্দুটি ইসলামে ধর্মন্তরিত হয়েছিলো, সেদিনই পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে।” অর্থাৎ জিন্নার মতে পাকিস্তান রাষ্ট্র অলরেডি সৃষ্টি হয়েই আছে, এখন তা বাস্তবায়ন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪০ সালে ২৩ মার্চ, লাহোর প্রস্তাবে জিন্না বললো, “ভারতবর্ষের সমস্যা সম্প্রদায়গত নয়, বরং জাতিগত। এটা খুবই দুঃখের যে হিন্দুরা, ইসলাম ও হিন্দুত্বের প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে পারছেন না। ইসলাম এবং হিন্দুত্ব শুধুমাত্র আলাদা ধর্ম নয়, সম্পূর্ণ বিপরীত দুই জাতিসত্ত্বা। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, হিন্দু ও মুসলমানরা দুটি পৃথক ইতিহাস থেকে প্রেরণা পায়। এদের একজনের মহাপুরুষ, অন্যজনের শত্রু। মুসলমানরা সংখ্যালঘু নয়। মুসলমান একটা আলাদা জাতি। জাতি গঠনের সমস্ত প্রয়োজনীয় উপাদান তাদের আছে। তাই তাদের অবশ্যই নিজের বাসভূমির অধিকার আছে।” (ভিপি মেনন, ট্রান্সফার অব পাওয়ার, পৃষ্ঠা-৮২)
ঠিক এর ১০ দিন পর, ১৯৪০ সালের ৬ এপ্রিল, গান্ধী, মুসলিম লীগের দাবিকে সমর্থন করে হরিজন পত্রিকায় লিখলো, “দেশের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মতো মুসলমানদেরও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আছে। বর্তমানে আমরা একটা যৌথ পরিবারের মতোই বসবাস করছি। তাই এর কোনো এক শরিক ভিন্ন হতে চাইতেই পারে।”মূলত এই দুটি ঘটনাতে ১৯৪০ সালেই ভারত ভাগ হয়ে গিয়েছিলো; ১৯৪৭ সালে তা শুধু বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র।
মুসলমানরা যাতে পাকিস্তানের দাবীকে ভুলে না যায়, সেজন্যই হয়তো ১৯৪২ সালের ১৮ এপ্রিল, গান্ধী, হরিজন পত্রিকায় আবার লিখলো, “যদি ভারতের বেশির ভাগ মুসলমান এই মত পোষণ করে যে, মুসলমানরা একটা আলাদা জাতি, যাদের সঙ্গে হিন্দু ও অন্যান্য গোষ্ঠীর মিল নেই, তবে পৃথিবীর এমন কোনো শক্তি নেই যে সেই চিন্তা ভাবনা থেকে তাদের বিরত করতে পারে এবং সেই ভিত্তিতে তারা যদি বেশির ভাগ চায়, তবে অবশ্যই দেশভাগ করতে হবে। তবে ইচ্ছা করলে হিন্দুরা তার বিরোধিতা করতে পারে।”
জিন্না দেখলো, তার দাবীর তেমন কোনো বিরোধিতা হিন্দুদের মধ্যে নেই, বরং হিন্দুদের প্রধান নেতা গান্ধীর, তার দাবীর ব্যাপারে যথেষ্ট অনুমোদনও রয়েছে।
এরপর ১৯৪৪ সালে জিন্নার সাথে গান্ধীর বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়। গান্ধী, জিন্নাহকে বলে, “আমি আপনার বা ইসলামের শত্রু নই। আমি আপনাদের দীন সেবক মাত্র। আমাকে দয়া করে ফিরিয়ে দেবেন না।” গান্ধীর এই অসহায় আত্মসমর্পনে উৎফুল্ল জিন্না পাকিস্তান আদায়ের প্ল্যান তৈরি করে ফেলে। কারণ, জিন্না বুঝেছিলো, শুধু মুখে বলে কিছু আদায় হবে না, এর জন্য এ্যাকশনে যেতে হবে। তাই ১৯৪৬ সালের ২৮ জুলাই বোম্বেতে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের জাতীয় সভায়, ১৬ আগস্টকে জিন্না, “ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে” বা “প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস” হিসেবে ঘোষণা করে। এই সভায় জিন্না বলে, “পাকিস্তান বাদ দিয়ে অন্য কিছুর সাথেই মুসলমান জাতি কোনো প্রকার আপোষ করবে না। এখন সময় হয়েছে, সেই দাবী আদায়ে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার। আমরা আজ একটা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত সব সময়ই আমরা নিয়মতান্ত্রিক পথেই দাবী জানিয়ে এসেছি। কিন্তু আজ সময় এসেছে সেই নিয়মতান্ত্রিক পথকে বিদায় জানাবার।…আজ আমাদের কাছে একটি পিস্তল আছে এবং আমরা তা ব্যবহার করতে সমর্থ।” ( পীরজাদা, ফাউন্ডেশন অব পাকিস্তান, পৃষ্ঠা-৫৬০)
শুরু হলো প্রস্তুতি:
১৯৪৬ সালে সমগ্র বাংলায় মুসলমান ছিলো ৫৫%, হিন্দু ৪৫%। তাই খুব সহজে কংগ্রেসকে হারিয়ে প্রাদেশিক নির্বাচনে জিতে বাংলার ক্ষমতা দখল করে মুসলিম লীগ। সোহরাওয়ার্দী বা সুরাবর্দী হয় মুসলিম সরকারের মূখ্যমন্ত্রী; স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও ছিলো তার হাতে। জিন্নার ডাইরেক্ট এ্যকশন ডে বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয় এই জল্লাদ। ২৮ জুলাই থেকে ১৬ আগস্ট, সময় খুব কম। তাই খুব দ্রুত পরিকল্পনামাফিক এগোতে থাকে সে। ১৯৪৬ সালের ৫ আগস্ট, স্টেটসম্যান পত্রিকার এক নিবন্ধে সুরাবর্দী লিখে, “হিংসা এবং রক্তপাত অন্যায় নয়, যদি তা মহৎ উদ্দেশ্যে করা হয়। মুসলমানদের কাছে আজ পাকিস্তান আদায় ছাড়া অন্য কোনো প্রিয় কাজ নেই।”
এই দিনই খাজা নাজিমুদ্দিন, যে পরে পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী হয়, সে মুসলিম ইনস্টিউটে, মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের এক সমাবেশে বলে, “মুসলিম লীগের এটা পরম সৌভাগ্য যে, এই রমজান মাসেই সংগ্রাম শুরু হবে। কারণ, এই রমজান মাসেই তো জিহাদের নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ।”
এর সাথে কলকাতার মুসলমান মেয়র, ওসমান খান, উর্দুতে একটি প্রচার পত্র বিলি করে। যাতে লিখা ছিলো, “আশা ছেড়ো না, তরোয়াল তুলে নাও, ওহে কাফের, তোমাদের ধ্বংসের দিন বেশি দূরে নয়।” এই লিফলেটে ছিলো তরোয়াল হাতে জিন্নার ছবি। এছাড়াও মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে, হিন্দুদের কিভাবে ধ্বংস করা যাবে, সেই রকম ২৩ টি নির্দেশনা সংক্রান্ত একটি লিফলেট বিলি করা হয়।
নির্দেশনাগুলো এরকম :
১. ভারতের সকল মুসলমান পাকিস্তানের দাবীতে প্রাণ দেবে।
২. পাকিস্তান জয়ের পর সারা ভারত জয় করতে হবে।
৩. ভারতের সব মানুষকেই ইসলামে ধর্মান্তরিত করতে হবে।
৪. সমস্ত মুসলিম রাষ্ট্রকেই বৃটিশ-আমেরিকার পৃথিবী শোষণের সাথে হাত মেলাতে হবে।
৫. একজন মুসলমানকে ৫ জন হিন্দুর অধিকার পেতে হবে, অর্থাৎ একজন মুসলমান সমান ৫ জন হিন্দু।
৬. যতদিন পর্যন্ত পাকিস্তান ও ভারত স্থাপিত না হয়, ততদিন পর্যন্ত নিম্নলিখিত কাজগুলি করে যেতে হবে:
ক) হিন্দুদের যত কারখানা ও দোকান আছে, তা ধ্বংস করতে হবে এবং লুঠ করতে হবে এবং লুঠের মাল মুসলিম লীগ অফিসে জমা দিতে হবে।
খ) মুসলিম লীগের সব সদস্যকে অস্ত্র বহন করতে হবে।
গ) সকল জাতীয়বাদী মুসলমান, যারা লীগের সাথে যুক্ত হবে না (অর্থাৎ কংগ্রেসী), তাদেরকে গুপ্তভাবে হত্যা করতে হবে।
ঘ) হিন্দুদেরকে ক্রমাগত খুন করে যেতে হবে এবং তাদের সংখ্যা কমাতে হবে।
ঙ) সমস্ত মন্দির ধ্বংস করতে হবে।
চ) কংগ্রেস নেতাদেরকে প্রতিমাসে ১ জন করে খুন করতে হবে।
ছ) কংগ্রেসের অফিসগুলি মুসলমানদের দিয়ে ধ্বংস করাতে হবে।
জ) করাচী, বোম্বাই, কলিকাতা, মাদ্রাজ, গোয়া বিশাখাপত্তনম ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই অচল করে দিতে হবে।
ঝ) কোনো মুসলমানকেই হিন্দুদের অধীনে সামরিক বাহিনী, নৌবাহিনী, সরকারী, বেসরকারী কোথাও কাজ করতে দেওয়া হবে না।
ঞ) মুসলমানদেরকে সমস্ত ভারত ও কংগ্রেসকে অন্তর্ঘাত করে যেতে হবে, মুসলমানদের দ্বারা শেষ ভারত আক্রমন পর্যন্ত।
ট) এসব ব্যাপারে অর্থ দেবে মুসলিম লীগ।
ঠ) সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র বোম্বাই, দিল্লী, কলিকাতা, মাদ্রাজ, ব্যাঙ্গালোর, লাহোর, এবং করাচির মুসলমানদের হাতে ভাগ করে দেওয়া হবে।
ড) মুসলিম লীগের সব সদস্য অস্ত্র ব্যবহার করবে, এমনকি দরকার হলে পকেটে রাখার মতো ছোড়া ব্যবহার করবে, যাতে ভারতবর্ষ থেকে সমস্ত হিন্দুদেরকে তাড়িয়ে দেওয়া যায়।
ঢ) সমস্ত বাহন হিন্দুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যবহার করা হবে।
ণ) সমস্ত হিন্দু নারী ও মেয়েদেরকে ধর্ষণ করবে, লুঠ করবে, ইসলামে ধর্মান্তরিত করবে ১৬ আগস্ট, ১৯৪৬ সাল থেকে।
ত) হিন্দু সংস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করতে হবে।
থ) লীগের সমস্ত সদস্যরা হিন্দুদের প্রতি সব সময় নিষ্ঠুর ব্যবহার করবে এবং তাদেরকে সামাজিক অর্থনৈতিক সব ব্যাপারে পরিত্যাগ করবে।
এসবের পাশাপাশি নোয়াখালি, ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, হুগলি, নদীয়া, ২৪ পরগনা প্রভৃতি জেলায় মুসলিম লীগের আহ্বানে অনুষ্ঠিত জনসভায় আকার ইঙ্গিতে মুসলমানদের বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে, দেশে মুসলিম লীগের সরকার আছে, সুতরাং পাকিস্তান আদায়ের জন্য ১৬ আগস্ট থেকে অগ্নি সংযোগ, লুঠ, নারী অপহরণ, ধর্ষণ, খুন এসবের জন্য কারো কোনো প্রকার শাস্তি হবে না।
এসব প্রচারের সাথে সাথে বাইরে থেকে প্রচুর সংখ্যক মুসলমানকে কলকাতায় এনে বিভিন্ন মুসলমান বস্তিতে রাখা হয়।
এছাড়াও এ্যাকশন শুরুর এক সপ্তাহ আগে থেকেই চোখে পড়ছিলো যেসব খণ্ডিত দৃশ্য :
বেলগাছিয়া, রাজাবাজার, কলাবাগান বস্তি, ক্যানাল ওয়েস্ট রোড, ধর্মতলা, পার্কসার্কাস, এন্টালি প্রভৃতি এলাকায় বেশ কিছুদিন ধরেই মুসলমানরা বিভিন্নরকম অস্ত্রশস্ত্রে ধার দিচ্ছিলো।
বেলগাছিয়া, বি.টি রোডে – লাঠি, ছোরা ও তরোয়াল ভর্তি লরি দেখা গিয়েছিলো।
মানিকতলায় ক্যানাল ওয়েস্ট রোডে অস্ত্র ভর্তি ঠেলাগাড়ি দেখা গিয়েছিলো।
এবং মুসলমানদের দোকানগুলোতে পাকিস্তান লিখে চিহ্নিত করা হয়েছিলো।
এ্যাকশনে ট্রাক / লরির ব্যবহার :
কলকাতার মেয়র ওসমান খান, কর্পোরেশনের সব লরি মুসলিম লীগের নেতাদের ব্যবহারের জন্য দিয়ে দিয়েছিলো, যাতে করে মুসলমানরা সে সব লরি ব্যবহার করে ইচ্ছেমতো লুঠপাট করতে পারে আর হিন্দুদেরকে মারার জন্য অস্ত্র শস্ত্র বহন করে বিভিন্ন এলাকার মুসলমানদের হাতে তা পৌঁছে দিতে পারে। আর এই লরিগুলো যাতে ঠিক মতো চলতে পারে, সেজন্য সুরাবর্দীর সরকার, সেই সময় পেট্রোলের যথেষ্ট অনটন থাকা সত্ত্বেও, ঢালাও ভাবে, লুঠপাট ও হিন্দু হত্যার কাজে নিয়োজিত লরিগুলোর জন্য পেট্রোলের কূপন ইস্যু করেছিলো। এছাড়াও বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যবসারত ইস্পাহানি মির্জাপুর চা কোম্পানির মালিক ইস্পাহানি ছিলো সেই সময় সুরাবর্দী সরকারের চাউল সরবরাহকারী। ইস্পাহানি নিজের সব লরি মুসলিম লীগের লোকজনদেরকে ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে এর সময় ব্যবহারের জন্য দিয়ে দিয়েছিলো। এসব লরিতে মুসলিম লীগের পতাকা টানিয়ে তা সন্ত্রাসের কাজে ব্যবহার করা হয়েছিলো। আর এসব লরি, যাদের পেট্রোলের কূপন ছিলো না, তারা জোর করে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে বিভিন্ন পেট্রোল পাম্প থেকে পেট্রোল আদায় করেছিলো।
এ্যাকশনের পূর্বরাত্রি :
১৮ দিন ধরে সমস্ত প্রস্তুতি নেওয়ার পর, ১৫ আগস্ট ১৯৪৬ তারিখে, মুসলিম লীগ ১৬ আগস্টে বাংলা বন্ধের ডাক দেয়, আর কোনো কারণ না থাকা সত্ত্বেও সুরাবর্দী ঐ দিন ঘোষণা করে সরকারী ছুটির। উদ্দেশ্য, যাতে নিরাপদে এবং নিশ্চিন্তে মুসলমানরা হিন্দুদের হত্যা করতে পারে ও তাদের ধন-সম্পত্তি লুঠ করতে পারে। এ্যাকশনে অংশগ্রহনে ইচ্ছুক মুসলমানদেরকে, কলকাতা শহরকে বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ করে, একেক এলাকার দায়িত্ব, একেক এলাকার মুসলমানদেরকে দেওয়া হয়। যেমন- বেলগাছিয়ার মুসলমানদের উপর দায়িত্ব পড়ে পুরো বেলগাছিয়া এলাকাকে বিধ্বস্ত করার। রাজাবাজার এলাকার মুসলমানদের উপর দায়িত্ব পড়ে মানিকতলা থেকে শিয়ালদহ এবং বৌ বাজার ও কলেজস্ট্রিট এলাকা। কলাবাগান বস্তির মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট হয় হ্যারিসন রোড, বড়বাজার, ঠনঠনিয়া, মার্কাস স্কয়ার, ফলপট্টি অঞ্চল। কলুটোলা, জ্যাকেরিয়া স্ট্রিট, নাখোদা মসজিদ, টেরিটি বাজার, ফিয়ার্স লেন এলাকার মুসলমানদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়- লালবাজার থেকে চিৎপুর এবং ক্যানিং ও এজরা স্ট্রিট অঞ্চল। এছাড়াও ধর্মতলা, তালতলা, ওয়েলেসলি, পার্কসার্কাস, বেলেঘাটা, বালিগঞ্জ, খিদিরপুর, ওয়াটগঞ্জ, মেটিয়াবুরুজের মুসলমানদের উপর ভার পড়ে স্ব স্ব এলাকার হিন্দুদেরকে হত্যা করার ও তাদের ধনসম্পত্তি লুঠপাট করার।
এছাড়াও এই হিন্দু হত্যার প্রত্যক্ষ পরিচালক জনৈক রহমান আলী ১৫ আগস্ট রাতেই তার লোক জন নিয়ে কোলকাতায় এসে পড়ে এবং মুসলমান গুণ্ডাদেরকে খিদিরপুর, কলুটোলা, রাজা বাজার, ধর্মতলা, পার্কসার্কাস, তালতলার বিভিন্ন মুসলমান বস্তিতে থাকার ব্যবস্থা করে। রহমান আলী সবাইকে বলে দিয়েছিলো, লুঠের মালের ভাগ কাউকে দিতে হবে না। আর খুন-ধর্ষণ-অপহরণে পুলিশ কোনো নাক গলাবে না, সরকার থেকে এসব দেখবে।
ভেতরে ভেতরে এসব প্রিপ্যারেশন নেওয়া হলো আর মুখে বলা হলো, ১৬ আগস্ট প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দিন মুসলিম লীগের নেতা কর্মীরা এখানে সেখানে মিছিল মিটিং করে পাকিস্তানের পক্ষে জনমত গঠন করবে, এককথায় প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস হবে শান্তিপূর্ণ!
পূর্বেই উল্লেখ করেছি, মুসলিম লীগ ১৬ আগস্ট, বাংলা জুড়ে হরতালের / বন্ধের ডাক দেয় এবং সূরাবর্দীর সরকার দেয় সরকারী ছুটির ঘোষণা । মুসলিম লীগের এই যৌথ কর্মসূচীতে কংগ্রেস কিছুটা হৈচৈ করে বটে; কিন্তু আইনসভার চার দেয়ালের মাঝেই তা আটকে থাকে, এর বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে এটাকে প্রতিরোধের কোনো চেষ্টাই কংগ্রেস করে নি। একমাত্র ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির হিন্দু মহাসভা জায়গায় জায়গায় প্রতিবাদ কর্মসূচী চালানোর চেষ্টা করে, কিন্তু কংগ্রেসের মতো ব্যাপক জনসমর্থন না থাকায় লোকজনের মাঝে তা বেশি প্রভাব ফেলতে পারে নি। প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস, শান্তিপূর্ণ ভাবে পালন করা হবে, জিন্না ও মুসলিম লীগের এই মিথ্যা আশ্বাসে ভুলে গান্ধী চুপ করে থাকে। আর নেহেরু বললো, যারা বন্ধ সমর্থন করে না, তারা যেন প্রতিদিনের মতোই হাট, বাজার, অফিস করে।
মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম নিয়ে সবচেয়ে অদ্ভুত স্ট্যান্ড নেয় কমিউনিস্ট পার্টি। ১৩ আগস্ট, ১৯৪৬ এ পার্টির নেতা জ্যোতিবসু এক প্রচার বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, “মূলত আমাদের পার্টির চেষ্টা হবে মুসলিম লীগের ডাকা বাংলা বন্ধের দিন রাজ্যের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা। তাই যেখানে প্রয়োজন আমরা বন্ধ সমর্থন করবো, আর যেখানে প্রয়োজন নয়, সেখানে বন্ধের বিরোধিতা করবো।” কমিউনিস্টদের চরিত্র আসলে মেয়ের, না পুরুষের, না অন্য কোনো কিছুর ? জ্যোতিবসুর এই মন্তব্য থেকে সেটা আপনারাই বিচার করে নিন। কেননা, কমিউনিস্টদের সিদ্ধান্ত ছিলো, যেখানে বন্ধের প্রয়োজন, অর্থাৎ মুসলিম এলাকায় ওরা বন্ধ সমর্থন করবে; আর যেখানে বন্ধের প্রয়োজন নেই, অর্থাৎ হিন্দু এলাকায় বন্ধ সমর্থন করবে না, বন্ধের প্রতিবাদ করবে। ১৪.৮.১৯৪৬ তারিখের অমৃতবাজার পত্রিকায় বেরিয়েছিলো কমিউনিস্ট পার্টির এই বেশ্যানীতির খবরটি।
কোলকাতার মেয়র ওসমান খান এবং তার সহযোগী সেরিফ খান, সক্রিয়ভাবে ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে এর এই হিন্দু হত্যাকে পরিচালনা করে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তর ছিলো মূখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দীর হাতে। এই এ্যাকশনে পুলিশ-প্রশাসনের কোনো সাহায্য যাতে হিন্দুরা না পায়, সেজন্য রাজ্যের ২৪টি পুলিশ হেড কোয়াটার্সের সব কয়টি থেকে হিন্দু পুলিশ অফিসার সরিয়ে ২২টিতে মুসলিম পুলিশ অফিসার এবং ২টিতে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পুলিশ অফিসার নিয়োগ করে সুরাবর্দী। শুধু তাই নয়, ১৬ আগস্ট সকাল থেকেই সুরাবর্দী এবং মেয়র ওসমান খান বসেছিলো লালবাজার পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সে এবং সেখান থেকেই তারা নজর রাখছিলো মুসলমানরা কোন এলাকায় কত হিন্দু মারতে পারলো। এমনকি একটি থানা আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও সুরাবর্দী ঐ থানায় লালবাজার থেকে কোনো পুলিশ ফোর্স পাঠায় নি।
এ্যাকশন হলো শুরু :
মুসলিম শরীফের ৭৪৫ নং হাদিসে বলা আছে, “নবী যখন কোনো জনপদ আক্রমন করতো, তখন ভোর বেলায় করতো।” কোলকাতাতেও এই সূত্রও খাটিয়েছিলো হিন্দু হত্যার খলনায়ক সুরাবর্দী এবং তার অনুসারীরা। ১৫ আগস্ট রাতে টার্গেটেড এলাকার সমস্ত মসজিদে মুসলমানদের এনে জড়ো করা হয়েছিলো। যাদের অস্ত্র ছিলো না, মসজিদেই তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছিলো। তারপর ফজরের (ভোরের) নামাজ শেষে খোলা তরবারি হাতে মুসলমানাদের নামিয়ে দেওয়া হয়েছিলো রাস্তায়।
অন্যদিকে নির্বোধ হিন্দুরা, মুসলমানদের এই দুই সপ্তাহের প্রস্তুতি দেখেও তার বিরুদ্ধে কোনো রকম ব্যবস্থা না নিয়ে, নিশ্চিন্ত ঘুম ঘুমিয়ে ১৬ আগস্ট সকালে যেই না রাস্তায় বেরিয়েছে, অমনি মুসলমানরা আক্রমন করে তাদের খুন করতে শুরু করে ।
প্রথম ছুরিকাঘাত করা হয় ভোর ৪.৩০ মিনিটে, ভোরের হাওয়া খেতে বের হওয়া এক হিন্দুকে। এরপর সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে বিপুল সংখ্যক মুসলমান আক্রমন করে মানিকতলা বাজার, ভাংচুর ও লুঠ করতে থাকে হিন্দুদের দোকান-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এসময় দুজন হিন্দু মহিলা মুসলমানদের হাতে আক্রান্ত হয়, একজন হিন্দু পুরুষ ছুরিকাঘাতে নিহত হয়।
এরপর থেকে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে লালবাজার পুলিশ হেড কোয়াটার্স এ যে খুন-জখম লুঠপাট ও অগ্নি সংযোগের খবর আসতে থাকে সেগুলো হলো-
সকাল ৭ টা: মানিকতলায় মুসলমানরা আক্রমন করেছে।
সকাল ৭.৩০ : লালবাজার টেলিফোন অফিসের কর্মকর্তা, সার্জেন্ট ই উইয়লিয়াম, থানায় রিপোর্ট করে যে, সে যখন তার মহিলা সহকর্মীকে প্রহরা দিয়ে একটি পুলিশের গাড়িতে করে নিয়ে সেন্ট্রাল এভিনিউ দিয়ে যাচ্ছিলো, সেই সময় সেই গাড়িতেই মুসলমানরা হামলা করে এবং তাদেরকে আহত করে।
সকাল ৭.৩৫ : বউবাজার ও লোয়ার সার্কুলার রোডের সংযোগস্থল শিয়ালদহে বিরাট সংখ্যক মুসলমান, লাঠি, লোহার রড সহ বিভিন্ন অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে জমায়েত হয়েছে।
সকাল ৮.২৫ : টেরিটি বাজার মুসলমানরা আক্রমন করেছে।
সকাল ৮.৩০ : লোয়ার চিৎপুরে সিটি সিনেমা হল এলাকায় মুসলমানরা আক্রমন করেছে।
সকাল ৯টা : শিয়ালদহ এলাকার অবস্থা ভয়াবহ।
সকাল ৯.৫ : ওয়ার্ডস ইনস্টিউশন স্ট্রীটে মুসলমানরা আক্রমন করেছে।
সকাল ৯.১২ : রিপন স্ট্রিট, ওয়েলেসলি স্ট্রিট ও মল্লিকবাজার এলাকায় মুসলমানরা যাকে পাচ্ছে, তাকেই ছুরিকাঘাত করে হত্যা করছে।
সকাল ৯.৩০ : বড়তলা থানার পুলিশেরাই মুসলমানদের দ্বারা আক্রান্ত। থানা থেকেই সশস্ত্র পুলিশের সাহায্য চাওয়া হয়েছে লালবাজার পুলিশ হেডকোয়াটার্সে।
সকাল ৯.৫৫ : বড় তলা থানা থেকে আবারও সাহায্যের অনুরোধ।
সকাল ১০.১০ : দমদম রোডে কয়েকহাজার মুসলমান আক্রমন করেছে। হিন্দুরা বাধা দেবার চেষ্টা করলে, মুসলমানরা গুলি বর্ষণ করেছে।
সকাল ১০.১২ : গড়পার, যোগীপাড়া লেন অর্থাৎ ক্যানাল অঞ্চলে মুসলমানরা আক্রমন করেছে।
সকাল ১০.৩০ : হ্যারিসন রোডে গোলমাল। রিপন কলেজের সামনে দুপক্ষের লড়াই চলছে।
বেলা ১১.০৮ : ২১২, বিবেকানন্দ রোডের কমলা বস্ত্রালয়ে আগুন লাগানো হয়েছে।
বেলা ১১.১৫ : রিপন কলেজের সামনে সাংঘাতিক দাঙ্গা চলছে।
বেলা ১১.৫০ : মুসলমানদের একটি বিরাট দল শিয়ালদহের দিক থেকে দোকান পাট লুঠ করতে করতে বউ বাজারের দিকে আগুয়ান। আর একটি দল হিন্দু বিরোধী শ্লোগান দিতে দিতে এবং দোকান লুঠ করতে করতে আপার সার্কুলার রোড ধরে ময়দানের দিকে এগিয়ে চলেছে। লাঠি ও খোলা তরবারি হাতে মুসলমানদের আর একটি দল শ্যামবাজার থেকে হাতিবাগান পর্যন্ত এগিয়ে আসছে।
দুপুর ১.৩০ : ষষ্ঠীতলায় হিন্দুদের ঘরবাড়িতে অগ্নি সংযোগ। নারকেল ডাঙ্গা মেইনরোডের কাছে পড়ে আছে ৫ টি মৃতদেহ।
বিকেল ৩টা : গড়পার এলাকায় ভয়ানক হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে। খালের পশ্চিমপাড়ে হিন্দুদেরকে পাইকারিভাবে হত্যা করা হচ্ছে। হিন্দুদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এই একই সময় ময়দানে মনুমেন্টের নিচে মুসলমানদের সমাবেশ চলছিলো। সেখান থেকে হিন্দু বিরোধী বক্তৃতা দেওয়া হচ্ছিলো, সমাবেশ শেষ হতে না হতেই মুসলমানরা হিন্দুদের দোকানে ভাঙচুর ও লুঠপাট করতে শুরু করে।
বিকেল ৪.৫ : লাইট হাউস সিনেমার পাশের সমস্ত হিন্দু মালিকানাধীন দোকান ভাঙা ও লুঠপাট চলছে।
বিকেল ৪.২০ : মুসলমানরা বেঙ্গল ক্লাব আক্রমন করেছে।
বিকেল ৪.৩০ : মেট্রো সিনেমার পাশের কে.সি বিশ্বাসে বন্দুকের দোকান ভেঙ্গে সমস্ত অস্ত্র লুঠ করে নিয়ে গেছে মুসলমানরা। ঐ অঞ্চলে আরো লুঠপাট চলছে।
বিকেল ৪.৪২ : ধর্মতলা রোডের বিখ্যাত কমলালয় স্টোর্স সম্পূর্ণ লুঠ হয়ে গেছে।
বিকেল ৫.১০ : কলকাতার সব বড় বড় রাস্তায় নৃশংস হত্যা ও লুণ্ঠন চলছে। ধর্মতলা স্ট্রিটে চাঁদনি চক বাজার মুসলমানদের দ্বারা লুণ্ঠিত। ইন্দ্র রায় রোডে সশস্ত্র মুসলমানরা বেরিয়ে আসছে।
মির্জাপুর স্ট্রীট ও আপার সার্কুলার রোডের সংযোগস্থল সশস্ত্র ও উত্তেজিত মুসলমানদের দ্বারা পরিপূর্ণ।
ওয়েলেসলি স্ট্রিটে বাটা সু কোম্পানি ও সেন এন্ড ল’র দোকান লুঠ করা হয়েছে।
৮ নং তারা চাঁদ দত্ত স্ট্রীটে গমের কলের হিন্দুদেরকে খুন করা হয়েছে।
১৫২ নং লোয়ার সার্কুলার রোডে লক্ষীকান্ত দাসের সাইকেল দোকান লুঠ করা হয়েছে এবং তাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রীটের প্রায় সমস্ত হিন্দু বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও ৫৫ ক্যানিং স্ট্রিটের এ্যালুমিনিয়ামের একটি দোকান লুঠ করা হয়। কয়েক শত মুসলমান ঐ দোকান লুঠ করে বিভিন্ন মালামাল নিয়ে যায় এবং যাওয়ার সময় ৬ জন নিহত এবং ৭ জন আহত হিন্দুকে তারা উঠিয়ে নিয়ে যায়।
মারকুইস স্ট্রিট, এলিয়ট রোড, কর্পোরেশন স্ট্রিট, ওয়েলেসলি স্ট্রিটে হিন্দুদেরকে পাইকারিভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং তাদের বাড়িঘর লুঠ করা হয়েছে।
ডি.সি নর্থ, খান সাহেব খলিলুর রহমান, তার এক রিপোর্টে ১৬ আগস্ট সম্পর্কে লিখে, “বিশৃঙ্খলা এবং অরাজকতা চলেছে ধর্মতলা স্ট্রিট, ওয়েলেসলি স্ট্রিট, মার্কেট স্ট্রিট, কর্পোরেশন স্ট্রিট, এবং ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। দোকান লুঠ হয়েছে, খুন হয়েছে এবং হামলা এখনও চলছে। মিলিটারী মোতায়েন করা না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করা খুবই কঠিন।”
উপরের এই বর্ণনা শুধু মাত্র ১৬ আগস্টের। এরপর ১৭ তারিখ পুরো দিন এবং ১৮ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত মুসলমানরা একইভাবে হিন্দুদের হত্যা, মেয়েদের ধর্ষণ, প্রাণের ভয় দেখিয়ে ধর্মান্তরের চেষ্টা, বাড়ি-ঘরে অগ্নি সংযোগ এবং লুঠপাট করতে থাকে।
এভাবে গৃহহীন হয় হাজার হাজার হিন্দু। ধর্ষিতা এবং অপহৃতা মহিলাদের কোনো হিসেব ছিলো না। কোলকাতার রাস্তায়, এখানে সেখানে জমে উঠেছিলো লাশের পাহাড়। এই খুন-হত্যার বিভৎসতা দেখে স্টেটসম্যান পত্রিকার বৃটিশ সাংবাদিক কিম ক্রিস্টেন লিখেছিলেন, “দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫) অভিজ্ঞতায় আমার স্নায়ু যথেষ্ট শক্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু যুদ্ধও এত পৈশাচিক নয়। এ এক মধ্যযুগীয় বর্বর উন্মাদনা এবং এটাকে পৈশাচিক রূপ দেওয়া হয়েছিলো।”
জ্যোতিবসু, পরে তার লেখা এক বইয়ে কলকাতার এই ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে এর কথা লিখতে গিয়ে লিখেছে, “প্রথম তিন দিনে প্রায় ২০ হাজার লোক নিহত হয়।” এছাড়াও অন্যান্য সূত্রে যে তথ্যগুলো পাওয়া যায়, তা হলো, শহরের সমস্ত ড্রেন হিন্দুদের লাশে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলো। আর গঙ্গায় এত লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিলো যে, দুর্গন্ধে মাঝিদের নৌকা চালানো দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিলো। বাঁশের লগি দিয়ে লাশ সরিয়ে সরিয়ে রাস্তা তৈরি করে মাঝিদেরকে নৌকা এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিলো। এই দৃশ্যগুলো কল্পনা করুন আর ভাবুন, ১৯৪৬ সালে কোলকাতায় মুসলমানরা হিন্দুদের কত রক্ত ঝরিয়েছিলো ?
পরিস্থিতি কিছুটা শাস্ত হলে একই রকমের ছোরা বিভিন্ন এলাকায় পাওয়া গিয়েছিলো, বেলগাছিয়া ও খিদিরপুর এলাকা থেকে বিপুল পরিমান অব্যবহৃত তরোয়াল, লাঠি ও ছোরা উদ্ধার করা হয়েছিলো। এগুলো পুরোপুরি ব্যবহার হলে আরও কত হিন্দুর রক্ত ঝরতো সেই বিষয়টিও একবার কল্পনা করুন। আর একই জায়গা থেকে এরকম বিপুল পরিমান অব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার নিঃসন্দেহে এটাই প্রমাণ করে যে, হিন্দু হত্যার এই পরিকল্পনা ছিলো সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত এবং অস্ত্রগুলোও মুসলিম লীগ সরকারের পক্ষ থেকেই সরবরাহ করা হয়েছিলো। আরও একটা উল্লেখ যোগ্য লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো, হত্যাকাণ্ডে কসাইখানার কসাইদের সক্রিয় ভূমিকায় লাগানো হয়েছিলো, যাতে কসাইদের জবাই করার দক্ষতাকে হিন্দুদের গলা কাটার জন্য ব্যবহার করা যায় এবং যত বেশি সম্ভব হিন্দুদেরকে যেন হত্যা করা যায়।
ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে এর প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশের প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল শ্রী গোলক বিহারী মজুমদার আই.পি.এস, “ছেচল্লিশের আতঙ্কের দিনগুলো ভুলি নি”- শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। সেই প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন, “রাত ১১ / ১২টা নাগাদ ( ১৬ আগস্ট, ১৯৪৬) পাড়ায় ওরা আবার আক্রমন করলো। দেখলাম একদল লোক – তাদের হাতে ছোরা, তরোয়াল ইত্যাদি নানা অস্ত্রশস্ত্র। তারা চিৎকার করে বলছে, ‘আজ তো এক এক হিন্দুকো কোরবানী করেগা।’ মা, বাবা, দিদি, আমি, ভাগ্নে সবাই সন্ত্রস্ত। যেকোনো মূহুর্তে আমরা আক্রান্ত হতে পারি। সবচেয়ে বেশি ভয় দিদিকে নিয়ে। দিদি দেখতে খুব সুন্দরী। ভাবলাম দিদিই হবে ওদের প্রথম টার্গেট। হিন্দু মেয়েদের ওপর ওদের বরবারই লোভ। চার পাঁচদিন পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলেও আতঙ্ক কাটে নি। ইউনিভার্সিটি খোলা ছিলো। রাজা বাজারের উপর দিয়ে আমাকে যেতে হতো। একদিন দেখলাম, গরু কেটে যেমন হুকের সাথে ঝুলিয়ে রাখে, তেমনিভাবে দেখলাম, হাত পা কাটা হিন্দু মেয়েদের চুল বেঁধে সব ঝুলিয়ে রেখেছে। বিভৎস আর নৃশংস সেই দৃশ্য।”
দেবকুমার বসু, “১৯৪৬ এর দাঙ্গার কয়েকটা দিন” নামে একটি লেখা লিখেছেন ২০০৬ সালে; সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, “রাজা বাজারের সামনের ভিক্টোরিয়া কলেজ ও স্কুল। মেয়েদের কলেজ ও হোস্টেল একদম ফাঁকা, সব পালিয়েছে। কেবলমাত্র রাস্তার দোতলার জানালায় চারটি মেয়েকে খুন করে রাস্তার দিকে ঝুলিয়ে রেখেছে, কে বা কারা । এই নৃশংসতা ও বিভৎসতা যারাই দেখেছেন, তারাই অনুভব করতে পারেন যে, আমাদের মতো, যুবকেরা কেনো উত্তেজিত হয়ে ক্ষিপ্ত হবে। কেউ এই হোস্টেলের দিকে তাকালে রাস্তার দিকের জানালাগুলি ইট গেঁথে বন্ধ করে দেওয়া আছে, দেখবেন। আজ ষাট বছর পরেও বন্ধ আছে। কাদের ভয়ে ? “
তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়াভেল তার ডায়েরিতে ৩.১১.১৯৪৬ তারিখে লিখেন, “পলাশীর যুদ্ধে যত লোক নিহত হয়েছে, তার চেয়ে বেশি লোক নিহত হয়েছে, গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং এ।”
গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং সম্পর্কে লিওনার্ড মোসলে তার বই “দ্য লাস্ট ডেজ অব ব্রিটিশ রাজ” এ লিখেছেন, “ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাওড়া পোল পার হয়ে হাওড়া থেকে দলে দলে আসতে শুরু করলো মারাত্মক অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত অবাঙ্গালি মুসলমান গুণ্ডারা এবং তারা মিশে গেলো চৌরঙ্গী, চিৎপুরে অপেক্ষমান মুসলমানদের সঙ্গে, শুরু হলো প্রলয়কাণ্ড- কোলকাতার মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলের হিন্দু এলাকাগুলিতে। ইসলামের বিশ্বপ্রেম গ্রাস করে নিলো অরক্ষিত মুসলমান পরিবেষ্টিত হিন্দু পরিবারগুলোকে। আর্ত আহতদের আর্তনাদ, লাঞ্ছিত নারীর ভয়ার্ত ক্রন্দন চাপা পড়লো- লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান এবং আল্লাহো আকবার- এর উন্মত্ত কোলাহলে। আগুনে জ্বলতে থাকলো হিন্দুদের স্থাবর অস্থাবর সব কিছু, আকাশে উঠলো কুণ্ডলায়িত কালো ধোঁয়া।”
মুসলমানদের এই আক্রমন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ দত্ত তার “দ্বিখণ্ডিতা মাতা ধর্ষিতা ভগিনী” পুস্তিকায় লিখেছেন, “১৬ আগস্টের ২/৩ দিন আগে থেকেই কলিকাতার নিকটবর্তী জেলাগুলো থেকে নৌকাযোগে হায়নার দল গঙ্গার ঘাটে ক্রমে বাসা বেঁধেছিলো। শ্রাবণের জমাট বাঁধা কালো মেঘের আড়াল ভেঙ্গে সেদিন সূর্য উঠেছিলো কলিকাতার আকাশে; আর রাতের আঁধারেই তৈরি হয়েছিলো শত শত ইসলামের বিশ্বস্ত সৈনিক সম্পূর্ণ অপ্রস্তত নিরীহ হিন্দুদের প্রাণ সংহার করতে।”
১৯৪৬ সালে কলকাতার হিন্দুদেরকে রক্ষা করেন শ্রী গোপাল মুখার্জি :
সূরাবর্দীর সরকারের পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় মুসলমানদের হাতে হিন্দুরা যখন একের পর এক মার খাচ্ছিলো, মরছিলো আর ধর্ষিতা হচ্ছিলো এবং এটা যখন লাগাতার তিন দিন ধরে চললো, তখন কিছু হিন্দু বুঝতে পারলো যে, হিন্দুদের বাঁচাতে সরকার পুলিশ কিছু করবে না। অতএব যা করার নিজেদেরকেই করতে হবে। এই ভাবনা নিয়ে একজন কসাই, নাম গোপাল, পাঁঠার মাংস বিক্রি করতো বলে যার নাম হয়েছিলো গোপাল পাঁঠা, সেই গোপাল পাঁঠা ১ দিনের মধ্যে ৮০০ হিন্দু ও শিখ যুবককে সাথে নিয়ে গড়ে তোলে এক বাহিনী এবং পাল্টা মুসলমানদের হত্যা করতে শুরু করে। এর পরই, খুব দ্রুত, পরিস্থিতি মুসলমানদের বিরুদ্ধে যেতে থাকে এবং সূরাবর্দী তার বিপদ বুঝতে পারে। তাই মুসলমানরা মার খেতে শুরু করলে সূরাবর্দী দ্রুত পুলিশ-প্রশাসনকে সক্রিয় করে এবং দাঙ্গা থামাতে বাধ্য হয়। এভাবে গোপাল পাঁঠা নামক এক বীরের নেতৃত্বে ১৯৪৬ এ রক্ষা পায় কোলকাতার হিন্দুরা ।
হিন্দুরা নিজের জাতির লোকের প্রতি কেমন অকৃতজ্ঞ আর বেঈমান, গোপাল পাঁঠার প্রতি হিন্দুদের এই দৃষ্টিঙ্গীতে তার কিছু প্রমান পাওয়া যায়। যার কারণে কোলকাতার হিন্দুরা রক্ষা পেলো, সেই তাকেও পরবর্তীতে কোনো হিন্দু তার মূল্যায়ন করা দূরে থাক, তার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করে নি। গোপাল পাঁঠার জীবদ্দশায় সম্ভবত একজন সাংবাদিক তার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলো। অথচ প্রতিবছরই ১৬ আগস্ট আসে, যায়; কিন্তু তাকে নিয়ে আধ মরা নামের বুড়োগুলোর কারো কোনো মাথাব্যথা নেই! হিন্দুদের এই অকৃতজ্ঞতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলো বাংলাদেশ মাইনোরিটি ওয়াচের শ্রদ্ধেয় রবীন্দ্র ঘোষও, তিনি আমাকে বলেছিলেন, অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে যখন কোনো মেয়েকে মুসলমানদের হাত থেকে উদ্ধার করে তাদের পরিবারে পৌঁছে দিই, তখন অনেকেই ধন্যবাদ পর্যন্ত দেয় না। এই ক্ষোভ এবং লজ্জা আমারও, কিন্ত কাকে দোষ দেবো ? আমি নিজেই তো হিন্দু সমাজের একজন সদস্য। হিন্দুদের জন্য কাজ করতে হলে এদেরকে নিয়েই কাজ করতে হবে আর অল্প অল্প করে সিস্টেমটাকে পাল্টাতে হবে। আজ আমি বুঝেছি, কাল আপনি বুঝবেন, পরশু আরেকজন বুঝবে এভাবেই হিন্দু সমাজের দুর্বলতাগুলো কেটে যাবে এবং সমাজ আস্তে আস্তে পরিবর্তনের পথে চলবে। হতাশ হওয়ার কিছু নেই, পরিবর্তন এক দিনে হয় না, আর এক দিনে বড় কিছু অর্জনও করা যায় না। হিন্দু সমাজের যে ক্ষত ও দুর্বলতা, সেই লজ্জা আমাদের পূর্ব পুরুষদের; কিন্তু এখন আমরা যদি সেই দুর্বলতাগুলোকে কাটানোর চেষ্টা না করি, তাহলে আমরা যেমন এখন পূর্বসূরীদের দায়।