বাঙালি বরাবরই বিপ্লবী। বাঙালির ধাতে আছে বামপন্থা, একথা বলাই যায়, যদিও পশ্চিমী দেশগুলো বামপন্থার আবিষ্কার করেছে নিতান্তই হালে, এই সেদিন ফরাসী বিপ্লবের সময়ে (ফরাসী পার্লামেন্টে স্পিকারের ডানদিকে রাজতন্ত্রের সমর্থক, এবং বাঁদিকে রাজতন্ত্রের বিরোধীরা বসতেন, সেই থেকে বামপন্থী দক্ষিণপন্থী এসেছে)।
কপিলের সাংখ্য ছিল প্রকৃতি প্রধান, তাই রাধার পা ধরেছেন কৃষ্ণ, বাঙালি কবি জয়দেবের অমর কাব্য গীতগোবিন্দে। তাই কালীর পায়ের তলায় শুয়ে থাকেন শিব, এবং বলা বাহুল্য, বৈদিক পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে তা ছিল এক বিপ্লব।
বাংলায় প্রথম যে সংগঠিত ধর্ম আত্মপ্রকাশ করেছিল, তা সেই সাংখ্য উদ্ভূত বৌদ্ধধর্ম। বিপ্লবী।
আমাদের গৌরবান্বিত পাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল সেই যুগে প্রকৃতিপুঞ্জ, অর্থাৎ প্রজাদের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে সিংহাসনে বসেছেন, মাৎসন্যায় শেষ করেছেন। বিপ্লব।
এরপরে আমাদের বজ্রযান, অর্থাৎ তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম, এবং আমাদের সহজযান, অর্থাৎ সহজিয়া বৌদ্ধধর্ম থেকে যথাক্রমে যে শাক্ত ও বৈষ্ণব উপাসনা এলো, তা ঈশ্বরকে করল মানবিক, মানুষকে ঈশ্বর, এবং মূলচক্রে থাকল ভালোবাসা। বিপ্লব।
বাঙালির রাজনীতিও তাই বিপ্লবী থেকেছে, উদাহরণ অগ্নিযুগ।
সমস্যা হল যখন এই বিপ্লবী রাজনীতির লাগাম চলে গেল এমন একদলের হাতে যারা বিদেশী ও বিজাতীয় শক্তির ক্রীড়নক, যারা বাঙালির স্বার্থ বারবার বলি দিয়েছেন। কমিউনিস্টরা একদা বয়কট আন্দোলনে অংশ নিতে অস্বীকার করেছেন, কারণ তাতে ম্যানচেস্টারের শ্রমিকদের প্রতি তাদের লড়াকু ভ্রাতৃত্ব বিপন্ন হবে। এরা সুভাষের বেঙ্গল ভলানটিয়ার্সের সহযোদ্ধাদের ব্রিটিশ পুলিসের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন, সেও ওই আন্তর্জাতিক সলিডারিটির কারণে, কারণ রুশ পিতৃভূমি তখন বিপন্ন। এরপরে চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যানও হলেন ক্রমে ক্রমে।
কিন্তু বাঙালি আর যা-ই করুক, সে ভুল করুক, সে ঠিক করুক, সে বিপ্লবীই থেকেছে। আমাদের রক্তে, আমাদের ধমনীতে, আমাদের মাথার ওপরে ঝরে পরা পূর্বপুরুষ-পূর্বনারীদের আশীর্বাদে রয়েছে বিপ্লব। এমনকি এই যে তৃণমূল নামের একটা উদ্ভট ব্যাপার চলছে এই মুহূর্তে, সে-ও তো সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম থেকেই উঠে আসা।
তাই আমাদের যতই তৃণমূলকে অসহ্য লাগুক, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিগুলির প্রতি আমাদের যতই অভিযোগ থাকুক, সমালোচনা থাকুক, এমন কি ঘৃণাও থাকতে পারে, কিন্তু তাই বলে বাঙালির চিরাচরিত বিপ্লবী, বামপন্থী, প্রগতিশীল রাজনীতির প্রতিই সেই দ্বেষটাকে যারা চালান করছেন, তারা অন্যায় করছেন, তারা যা করছেন তা হল থ্রোইং দ্য বেবি উইদ দ্য বাথওয়াটার। স্নানের নোংরা জল ফেলতে গিয়ে বাচ্চাটাকেই ফেলে দিচ্ছেন, এর ফলে তারা বাঙালির ক্ষতিই করছেন।
সাংখ্যের প্রকৃতি অত্যন্ত অ্যাবস্ট্রাক্ট একটা ব্যাপার। সাধারণ মানুষ ওরকম বিমূর্ত জিনিস ধরতে পারে না, জোর করে বিমূর্ত ধরাতে গেলে কি ভয়ানক কাণ্ড হয়, সেটা ওয়াহাবি থেকে তালিবান, আই এস থেকে ওলামা লিগ দেখেই বুঝতে পারবেন।
এজন্য বাঙালি ঐতিহ্যের মূর্ত প্রতীক দেবী দূর্গা, মা কালী।
বাঙালি দীর্ঘজীবী হোক। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।