প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা পাকিস্তানের আদালতের রায়কে উদাহরণ হিসেবে দেখানোতেই যদি তিনি ‘পাকিস্তান প্রেমী’ হয়ে যান তাহলে ৩০ লক্ষ প্রাণহানী আর ২ লক্ষ নারীর সম্ভ্রম হারানোর অন্যতম কুশিলব জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ‘বন্ধু’ বলে সম্ভোধনকারীকে কি বলবেন? ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের কাছে বলেছিলেন, ‘আমি ভুট্টোর আন্তরিকতায় মুগ্ধ। আমি তাঁকে সাহায্য করতে চাই। তিনি একজন পুরনো বন্ধু’। ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে পাকিস্তানে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ভুট্টোর গালে চুমু খাওয়াটা আজো আলোচনার বিষয় হয়ে আছে। তখনকার রাজনৈতিক অবস্থা, বিশ্ব রাজনীতিতে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের কৌশলগত কারণেই হোক বা অন্য যে কারণেই হোক, বঙ্গবন্ধু কুলদীপ নায়ারকে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের তিক্ততা, একাত্তরে তাদের গণহত্যা, নারী ধর্ষণ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি সে সব কিছু ভুলে যেতে চাই। আমি চাই আমার জনগণও সে সব কিছু ভুলে যাক। আমাদেরকে সব কিছু আবার নতুন করে শুরু করতে হবে’। (তথ্যসূত্র: Shaikh Mujib willing to help India and Pakistan resolve their differences and live as neighbours, Kuldip Nayar, Pg 10, The Times, Thursday, February 28, 1974.)।
একটা রায়কে কেন্দ্র করে প্রধান বিচারপতি পাকিস্তানের আদালতের উদাহরণ দেখানোতে যদি আপনার পাকিস্তান ঘৃণা এগজিমায় রূপ নেয় তো উপরের ঘটনাকে কি বলবেন? নরহত্যাকারী ও নারী শিশু নিপীড়ক ভুট্টোকে ৭৪ সালে লাল গালিচার সংবর্ধনার তাহলে কি হবে? পাকিস্তানের প্রতি আপনার ঘৃণার উৎসটা কি? মুক্তিযুদ্ধে তাদের গণহত্যা ধর্ষণ যুদ্ধাপরাধ শুধু? মনে করুন, একাত্তরে যদি পাকিস্তানের সঙ্গে আমরা রক্তপাতহীন শান্তিপূর্ণ উপায়ে ভাগ হতাম তাহলে কি পাকিস্তানের প্রতি আপনার এই ঘৃণা থাকত? মনে রাখতে হবে এদেশে পাকিস্তান প্রেমীরা, একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষের লোকেরা পাকিস্তানকে অখন্ড রাখতে চেয়েছিলো পাকিস্তানের যে আদর্শ, দ্বিজাতি তত্ত্ব, সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রচিন্তার কারণেই। তারা মনে করত পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের যে বৈষম্য তা একদিন আন্দোলন করে আদায় করতে সক্ষম হওয়া যাবে যদি পাকিস্তান অখন্ড থাকে। নইলে মুসলিম কওমের ঐক্য ভেঙ্গে যাবে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলে। এ কারণেই হয়ত পাকিস্তান ভেঙ্গে যাবার পর মুসলিম উম্মাহকে আশ্বস্ত করতে স্বাধীন বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধুর সরকার তাদের পরাষ্ট্রনীতি দিয়ে বুঝাতে চেয়েছেন বাংলাদেশ একটি মুসলিম রাষ্ট্র, অভিন্ন মুসলিম সৌভ্রাতৃত্বেরই অংশ। বঙ্গবন্ধু সরকার চেয়েছিলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া, গালফ অঞ্চলের মুসলিম দেশের সঙ্গে একই মুসলিম ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করতে। এসব কারণে তিনি পাকিস্তানের স্বীকৃতির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। ওআইসির সদস্যপদ লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়ের সহায়তার কারণে তাদের প্রভাব এবং কৃতজ্ঞতার জন্য যে চাপ সৃষ্টি হয়েছিলো, বাংলাদেশকে সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে পরিচিতির যে চাপ এই দেশগুলো কাছ থেকে মনস্তাত্বিকভাবে বাংলাদেশের প্রতি ছিলো- তাকে সামাল দিতেই মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, উত্তর আফ্রিকার লিবিয়া, আলজেরিয়া, মিসর ও সৌদি আরবের সঙ্গে ইসলামি সৌভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক গড়তে চেয়েছিলেন। ফলশ্রুতিতে বলা যায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতি এবং রাষ্ট্র হিসেবে তার যে ধর্মীয় পরিচয় তা থেকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ কোন দিক থেকেই পৃথক ছিলো না। তাহলে পাকিস্তানকে ঘৃণা করার আপনার কারণটি ঠিক কি?
১৯৭২ সালে কমনওয়েলথের সদস্যপদে বাংলাদেশের আবেদনের বিরোধীতা করেছিলো ভুট্টো। এতে ক্ষুব্ধ বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রাণ বাঁচানোর জন্য ভুট্টোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘ভুট্টো যদি বাংলাদেশের কমনওয়েলথ সদস্যপদ পেতে বাধা দেন বা চালাকি করেন, আমি পশ্চিম পাকিস্তানের দখল নেব এবং সেটিকেও বাংলাদেশের অংশ করব। আমিই পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। আর তিনি সেনাবাহিনীর কৃপায় সেই দেশটির প্রেসিডেন্ট। গণতান্ত্রিকভাবে আমি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং সেখানকার প্রদেশগুলোতে আমি আমার লোকজনকে নিয়োগ দেব…।’ (তথ্যসূত্র: প্রথম আলো, সোহরাব হাসান, ৯ আগস্ট, ২০১৫)।
৭২ সালেও বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা, তাই তিনি পাকিস্তানের দখল নিবেন বলতে পারলে এসকে সিনহা পাকিস্তানের একটা রায়কে উদাহরণ দিতে পারবেন না? এত ঘৃণা কেন পাকিস্তানের প্রতি? শুধুমাত্র পাকিস্তানের গণহত্যার জন্যই কি পাকিস্তান শব্দটি ঘৃণার পাত্র? দ্বিজাতি তত্ত্ব, সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র এসব যদি পাকিস্তানের প্রতি বিরূপতা তৈরি না করে তাহলে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলতে আলাদা করে কিছুর অস্তিত্ব থাকে না। মুক্তিযুদ্ধের রূপকারদের বেশির ভাগই পাকিস্তান আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। তরুণ শেখ মুজিব আর ফজলুল কাদের চৌধুরী জান দিয়ে পাকিস্তানের জন্য লড়েছিলেন। পরবর্তীকালে শেখ মুজিব হয়ে উঠেন ‘বঙ্গবন্ধু’, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রাণপুরুষ। আর ফজলুল কাদের চৌধুরী হোন পাকিস্তান রক্ষাকারী নরঘাতক। গঠন করেন রাজাকার বাহিনী, শান্তি কমিটি। এসব কমিটিতে একজন ধর্মীয় সংখ্যালঘুর অন্তর্ভুক্তি নেহাত প্রাণ বাঁচাতে। এটা বুঝতে খুব বেশি জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। লজিক্যালি একজন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টানের রাজাকার পাকিস্তান প্রেমী হবার কোন সুযোগ নেই। প্রধান বিচারপতিকে পাকিস্তান প্রেমী, রাজাকার বলার মত ঘৃণ্য আচরণ পাকিস্তান রাষ্ট্রের চাইতেও বাংলাদেশের হীন অবস্থাকে প্রকাশিত করে দিচ্ছে। আপনার ‘পাকিস্তান’ এলার্জি’র কারণটি আজি অনুসন্ধান করুন। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন- আপনারা আর পাকিস্তানীরা কিসের ভিত্তিতে তফাত?
sudhipto pathok