বিশ্বকে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণা থেকে বের হতে হবে- মহামান্য রাষ্ট্রপতি
কেবল উপমহাদেশের কথাই যদি বলি, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্থান, শ্রীলংকা, ভূটান, মালদ্বীপ, নেপাল…। এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে চারটি রাষ্ট্র নিজেকে ‘মুসলিম’ বলে পরিচয় দেয়। বাংলাদেশ মালদ্বীপ পাকিস্তান আফগানিস্থান- এখানে আফগানিস্থান বাদে শরীয়া শাসন বা ইসলামী খেলাফত বলতে যা বুঝায় তা চালু না থাকলেও পুরোপুরি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র বললে অত্যুক্তি হবে না। আফগানিস্থানের শাসন ব্যবস্থার নাম ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’। শতভাগ মুসলমান দেশ আফগানিস্থানে পাথরের বুদ্ধ মূর্তিগুলো পর্যন্ত তালেবানদের আক্রশ থেকে রেহাই পায়নি। মালদ্বীপের কথাই যদি বলি, এই দেশটিও নিজেকে ‘ইসলামী দেশ’ বলে দাবী করে। মালদ্বীপে অন্য কোন ধর্ম চর্চা করা নিষিদ্ধ। কোন মুসলিম মালদ্বীপে থেকে ধর্মান্তরিত হতেও পারবে না। অপূর্ব সুন্দর এই দ্বীপ রাষ্ট্রটি কতখানি ধর্মীয় অসহিষ্ণু এ থেকে বুঝায় যায়। পাকিস্তান বাংলাদেশের ইতিহাস প্রায় একই রকম। পাকিস্তানে ৯৫ ভাগই মুসলমান। বাকী ধর্মীয় উল্লেখযোগ্য সম্প্রদায় ১.৫ খ্রিস্টান এবং এক পার্সেন্ট হিন্দু। খ্রিস্টান ও হিন্দু সম্পত্তি বেহাত করার জন্য পাকিস্তান রাষ্ট্র মুসলিমদের উশকানি দিয়ে রেখেছে তাদের ইসলামী আইনে। জেনারেল জিয়াউল হক ১৯৭৮ সালে পাকিস্তানের মুসলমানদের শরীয়া আইনের আওতায় নিয়ে আসে। এই শরীয়া আইন খ্রিস্টান এবং হিন্দুদের উপরও কথিত নবী অবমাননায় প্রয়োগ হয়। পাকিস্তান থেকে খ্রিস্টান হিন্দুদের সংখ্যা হ্রাস পেতে পেতে হারিয়ে যাচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশের সরকারী পরিচয় গণপ্রজাতন্ত্র হলেও এদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। সেই ৭২ সালেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে নিজেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ‘মুসলিম রাষ্ট্র’ বলে ঘোষণা করেছে। পাকিস্তান আমলে এখানে এনিমি পোপার্টি আইন চালু করে হিন্দু সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিলো। স্বাধীন বাংলাদেশের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ সরকার সেই আইনকে ‘অর্পিত সম্পত্তি’ নাম দিয়ে বহাল রেখে দিয়েছে যাতে পাকিস্তান আমলের মত একইভাবে হিন্দু সম্পত্তি বেহাত হতে পারে। এদেশের হিন্দুরা যাতে সম্পত্তি করতে ভয় পায়, নিজেদের ভিত্তি দুর্বল ও অনিশ্চিত মনে করতে পারে তার সব চেষ্টাই দেশ স্বাধীন হবার পর করা হয়েছে। বাংলাদেশে হিন্দুদের বলা হয় দ্রুত বিলুপ্ত প্রায় এক সম্প্রদায়। এখানে তাদের ধর্মীয় উপসনালে হামলা করা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। মূলত ‘বাঙালী মুসলমান’ জাতীয়তাবাদই এখানে চলে আসছে। এই জাতীয়তাদে এদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠিগুলোও নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে। এটাই কারণ যে বাংলাদেশে ৯০ ভাগ মুসলিম বসতি।
এবার আসেন উপমহাদেশর অমুসলিম অধ্যষিত দেশগুলোর কথা। নেপালের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়। এরপরই আছে বৌদ্ধরা প্রায় ১৫ শতাংশ। ৭ শতাংশ মুসলিমও নেপালে বসবাস করে। তবু নেপালের সংবিধান ‘ধর্মনিরপেক্ষ’! নেপালে কোন হিন্দু আইনে রাষ্ট্র শাসিত হয় না। নেপাল থেকে সংখ্যালঘু মুসলমান বা বৌদ্ধদের দেশান্তরিত হবার কোন রেকর্ড নেই। শ্রীলংকা সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের দেশ। তবু শ্রীলংকা নিজে ‘বৌদ্ধ দেশ’ বলে নিজেকে পরিচয় দেয় না। শ্রীলংকা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় পরিচালিত হয়। ধর্মীয় পরিচয়ে এখান থেকেও কোন নাগরিকের পার্শ্ববর্তী দেশে পালানোর কোন ইতিহাস নেই। নেই কোন রাষ্ট্রধর্ম। একইভাবে ভূটানের কোন রাষ্ট্রধর্ম নেই। এখানে ৯০ ভাগই বৌদ্ধদের বাস। ভূটান থেকে সাম্প্রদায়িক হামলা মামলায় কোন অবৌদ্ধ দেশে ছেড়ে গেছে এমন কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনাও নেই। সর্বশেষ ভারত হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম বসবাসকারী দেশ। ভারতে হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ট। পৃথিবীর প্রায় সব ধর্মের মানুষই এখানে পাওয়া যায়। প্যালেস্টাই থেকে মুসলমানদের তাড়ানো ইহুদীদেরও ঠাই এখানে হয়েছিলো। ভারতের স্বাধীনতার এতগুলো বছরেও কোন সংখ্যালঘুর নিপীড়নের শিকার হয়ে দেশ ছাড়ার কোন নজির নেই। আশেপাশে ‘ইসলামী দেশ’ থাকার পরও ভারতীয় মুসলমানদের সেসব ইসলামী দেশে অভিবাসী হবার নজির নেই। ভারতের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ। ভারত কোন হিন্দু আইনেও পরিচালিত হয় না। ভারতের শাসনব্যবস্থান গণতান্ত্রিক। উপমহাদেশের মুসলিম দেশগুলো যেমন বাংলাদেশ পাকিস্তান বরাবর ভারতে মুসলিম নির্যাতনের দাবী করে আসলেও ভারত থেকে এইসব দেশে কোন মাইগ্রেসনের ইতিহাস নেই। কিন্তু উক্ত দুই ধর্মীয় দেশ থেকে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের দেশছাড়ার গ্রাফটা লজ্জাজনক।
শুধুমাত্র উপমহাদেশের উদাহরণ দিয়েই “ধর্মীয় রাষ্ট্র’ কারা চালায় তা প্রমাণ করা যায়। সারা বিশ্বের তুলনা দিলেও একই চিত্র মিলবে। মাধ্যপাচ্যের ইসলামী দেশগুলোর মাঝে একমাত্র ‘ইহুদী রাষ্ট্র’ ইজরাইল। এই দেশে মুসলিমদের বসবাস নিশ্চিত হয়েছে। মুসলমানরা সেখানে মসজিদ থেকে মাইকে আজান দেয়। যে ৭ শতাংশ মুসলিম ইজরাইলে বসবাস করে তারা রাতদিন ইহুদীদের ধ্বংস কামনা করলেও একজনকেও দেশ ছাড়তে হয় না। অন্যদিকে সৌদি আরবে অমুসলিমদের কোন নাগরিত্বই নেই। সেখানে ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মের চর্চা নিষিদ্ধ। মসজিদ ছাড়া আর কোন ধর্মালয় সৌদি আরবে বানানোর অনুমতি নেই। শিয়া মুসলমানদের দেশ ইরান একদা জরথ্রুস্ত ধর্মালম্বী পার্সিদের দেশ হলেও ইসলাম গ্রহণ করার পর তারা ইরান থেকে সমস্ত ইহুদী-খ্রিস্টান জরথ্রুস্তদের নিঃশেষ করে দিয়েছে। ইরান ইসলামীপ্রজাতন্ত্র অনুযায়ী পরিচালিত হয়। ইসলামী বিশ্বের আরেক আলোচিত রাষ্ট্র মিশরে আহলে কিতাবী অর্থ্যাৎ ইহুদী-খ্রিস্টান ধর্ম ছাড়া বৌদ্ধ হিন্দু এদের নাগরিত্ব দেয়া হয় না। ৯০ ভাগ মুসলিম বসবাসকারী মিশর মাত্র ১০ ভাগ খ্রিস্টানকে পারে না ঘাড় ধাক্কা দিয়ে দেশ থেকে বের করে দেয়। ইসলামী শাসনের কারণে খ্রিস্টানদের সংবিধানিক ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছে। তাদের গির্জা নির্মাণের আছে নানা রকম শর্ত। রোজার মাসে হোটেলে দুপুরের খাবার সময় মিশরীয় খ্রিস্টানদের ধরে নাজেহাল করা মিশরের মুসলিমদের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট।
জাপান, কোরিয়া, চীন এদেরকে ‘বৌদ্ধ রাষ্ট্র’ বলে ডাকা মুসলিমদের অভ্যাস। একইভাবে ইংলেন্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানি ইত্যাদি পশ্চিমা বিশ্বকে ‘খ্রিস্টান রাষ্ট্র’ বলা মুসলিম বিশ্বের একান্তই নিজস্ব বিভাজন। বস্তুত এই দেশগুলোর কোনটিই ধর্মীয় শাসনে চলে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ ধর্মালম্বী হলেও এই দেশগুলোর সবাই সেক্যুলার গণতান্ত্রিক শাসনে চলে। আফগানিস্থানে বৌদ্ধ মূর্তি যখন কামান দাগিয়ে ধ্বংস করা হয়েছিলো তখন জাপান কোরিয়া চীনে কোন মুসলিমকে এ জন্য নাজেহাল হতে হয়নি। পাকিস্তানে গির্জা পোড়ালে আমেরিকা জার্মানিতে কোন মসজিদ পোড়ানো হয় না। কিন্তু মুহাম্মদকে নিয়ে একটা কার্টুন আঁকা হলে এক-দুইজন মুসলমানের বাস এমন জায়গাতেও গাড়ি পোড়ানো হয়। রাষ্ট্রের ধর্মীয় পরিচয় ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হযরত মুহাম্মদ মুসলমানদের একটি জাতি বলে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তিনি জীবিত থাকাকালেই কুরাইশ এবং মদিনার পৌত্তলিকদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী লড়াই ছিলো। মুহাম্মদের মৃত্যুর পর এই জাতীয়তাবাদী লড়াই অনেকদূর গড়ায়। ‘মুসলিম জাতি’ এটি কেবলমাত্র অশিক্ষিত লোকজনকেই বুঝানো সম্ভব। মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষাদীক্ষা কম বলে এরা এই ভ্রান্ত তত্ত্ব আজো আকড়ে রেখেছে। তাই বিশ্ববাসীকে ‘ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের’ দাবী ছাড়ার কিছু নেই। কারণ তারা ধর্মীয় রাষ্ট্র গড়েনি। বড়জোর তারা জাতিরাষ্ট্র গড়েছে। এই দাবী ছাড়তে হবে মুসলিমদের। কিন্তু ইসলাম ধর্মের উপর হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে এটা কিভাবে সম্ভব হবে?