আমি কেন নিজেকে সনাতনি বলে গর্ববোধ করি। হিন্দু পিতার ঔরসে এবং হিন্দু মায়ের গর্ভজাত বলেই কি আমি হিন্দু, আর সেই হিন্দু বলে নিজেকে ধন্য মনে করি আর তারস্বরে হিন্দু হিন্দু বলে ডাক পাড়তে থাকি??????
আমার ৩৫ বছরের বিদেশ প্রবাসে আমি আমার দুই খুব ঘনিষ্ট বন্ধু, যাদের সংগে আমি একসংগে কাজ করেছি, দেখেছি তারা কি কোরে এবং কি জন্য খ্রীষ্টান হয়ে গেলো। চেষ্টা করেও রুখতে পারলাম না।
একজন তেলেগু, আর একজন মালয়ালি। আর একজন নিজের ঘরে “সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের” মতো সোনার পাথর বাটির সন্ধানে জীবন কাটিয়ে দিলো। ঘরের দেওয়ালে রামকৃষ্ণ দেব, বিবেকানন্দ, মা সারদা থেকে শুরু করে যীশু র ছবি টানিয়ে রেখেছে এবং রোজ প্রনাম করে, আর দিন রাত পুজো পাঠ করা হিন্দুদের নামে গালি দেয়।
মজার ব্যাপার হলো দেওয়ালে টানানো একটি ছবির ফ্রেম আছে, কারো মুখ নেই। ওটা নাকি মুহাম্মদের ছবি। নবীর কোনো প্রামানিক ছবি তো নেই তাই ওই ব্যাবস্থা।
এদের সবার সংগেই আমার অতি ঘনিষ্টতা ছিলো, এখনো মাঝে মধ্যে কথা হয় ফোনে, গেলে দেখাও হয়। এদের সকলের ছেলে মেয়েরা আমেরিকায় কাজ কর্ম করে এবং ভালো আছে। নিজেদের বিশাল প্রাসাদোপম বাড়ী গাড়ি সুইমিং পুল ইত্যাদি।।
এক সময় আমারো ছিলো, এদের থেকেও বেশ একটু বেশীই ছিলো ,কারন আমার মতো এতো দীর্ঘ দিন এদের কেউ বিদেশে কাটায় নি, অর্থ্যাত আমার অনেক পরে এরা গেছে। এরা সবাই ডাক্তার, এদের তিনজন কেই আমি চাকুরী দিয়েছিলাম যখন আমার ওয়েষ্ট ইন্ডিজে প্রচুর প্রভাব প্রতিপত্তি ছিলো (আমার জীবনের করা সব চেয়ে বড়ো পাপা)।
ওয়েষ্ট ইন্ডিজের যে দেশ টিতে ( ছোট দ্বীপ দেশ) আমি বিদেশ প্রবাসের শেষ ২০ বছর ছিলাম, যেখানে এখনো আমার একটি বাড়ি আছে এবং প্রতি বছর ২ মাস করে গিয়ে থাকি সেই দেশ টি ৯৯.৯৯% খ্রীষ্টান মানুষে ভর্তি। বাকি মানুষ কিছু হিন্দু (৫ ঘর), কিছু মুসলিম (৭ ঘর), কিছু কিছুই নয়। এরা প্রতি রবিবারে চার্চে যায় সকালে, বিকেলে দল বেধে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বাছাই করা কিছু মানুষের বাড়িতে যায়, যারা বয়ষের ভারে বা অসুস্থতার কারনে চার্চে যেতে পারে না।
তাদের বাড়িতে গিয়ে বাইবেল পড়ে শুনিয়ে আসে। যাদের ঘর গুছাবার দরকার তাদের ঘর গুছিয়ে দেয়, ঘর পরিষ্কার করে দেয়। যারা খুব বয়ষ্ক, তাদের জন্য চার্চ থেকে রান্না খাবার রোজ একবার দিয়ে আসার ব্যবস্থা আছে। এদের বেশীর ভাগ মানুশের ছেলে মেয়ে কাজ উপলক্ষ্যে বিদেশে থাকে কিন্তু দেশের বৃদ্ধ বাবা মা না খেয়ে থাকে না অযত্নে থাকে না। এদের ধর্মীয় ভক্তি দেখলে মন জুড়িয়ে যায়।
এরা কারো ক্ষতি করে না, খারাপ কাজের সুচনাতেই বলে দেয় “আমি খ্রীষ্টান, এই কাজ করতে পারি না”। বিশ্বাস করুন একটুও বানিয়ে বলছি না। সোমবার থেকে শুরু করে শুক্রবার ৮ টা থেকে ৪ টে খাটে,কাজে ফাকি দেয় না, শনিবার ঘরের কাজ করে, রবিবার ঈশ্বরের কাজ করে।
আমার চোখের সামনেই দুজন খ্রীষ্টান হয়ে গেলো, আটকাতে পারলাম না, তারাও এদের নিত্য জীবনের উদাহরন দিলো। আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, আমরা শুধু মুখে হিন্দু হিন্দু করি কিন্তু আমরা আসলে জগাখুচুড়ি, সনাতনি দর্শন থেকে লক্ষ যোজন দূরে।। আমি কি তাহলে আমার পুর্ব পুরুষের ধর্ম পরিবর্তন করবো???
বেশ কিছু পাদ্রী সেই চেষ্টা অনেক করেছেও। আমার রক্তে, ‘জীনে’ যে জীবন দর্শন ঢুকে আছে তাকে অতি সহজে পাল্টাই কি করে??? ১৯৮৬ সাল থেকে শুরু করলাম সনাতনী দর্শন নিয়ে পড়াশুনা। ডাক্তারী বই সব বাক্সে ঢুকিয়ে দিলাম। সময় পেলেই পড়ি,বই সব পাওয়া যায় সর্বত্র ,অন লাইনে, আমাজনে। দিনরাত এক করে, সনাতনি দর্শন, আর ভারতীয় হিন্দু দের পরাধীনতার ইতিহাস কি তাই জানার চেষ্টা করলাম।
যা বুঝলাম সেটা হলো, সনাতনী দর্শনের জঠর ভুমি থেকে, ভারত মাতার দুধ পান করে বড়ো হয়ে ওঠা মানুষগুলো, যারা একটু লেখা পড়া শিখেছে,তারাই নিজের ধর্ম কে জানেনা, মানে না, নিজের জীবনে প্রতিফলিত করে না। দেশে এসে ১৯৮৬ সালে দীক্ষা নিলাম গুরুদেব স্বর্গীয় মহানাম ব্রত ব্রহ্মচারীজীর কাছ থেকে।
প্রতি সন্ধ্যায়, মিসেস দেবনাথ ঘরে ভজন কীর্তন করতেন। বাচ্চারা তখন ৬ আর ৪ বছরের। ওদের নিয়ে বসতে শুরু করলাম। ওরা একটু বড়ো হলে শুরু করলাম গীতা পাঠ করা, যা পারি তাই। সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ৮ টা প্রতিদিন। বাড়িতে একটি ঘরে মন্দির বানালাম। সেই শুরু আমার হিন্দু হওয়া। তার আগে আমি কি ছিলাম??????? কিছুই না।
একটি অর্থ উপার্জনের মেশিন মাত্র, জীবনে কোনো আনন্দ ছিলো না। ‘ঊদ্বাস্তু’ তকমাটা সারা জীবন বহন করে নিয়ে বেড়ানোর জন্য গ্লানি ছিলো। ধীরে ধীরে, মন শান্ত হলো, মনে শান্তি আসতে শুরু করলো। ভুলে গেলাম জীবনের সব কষ্ট,দুঃখ। আমাকে উদ্বাস্তু যারা বানিয়েছিলো, সেই মুসলমানদের প্রতিও আর রইলো না কোন অনুযোগ।
১৯৯২ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল তিন বছর মিসেস দেবনাথ ছেলে মেয়ে নিয়ে ভারতে রইলেন আমাদের ঘর বাড়ি বানাতে,(বাগুইয়াটিতে ,যা আজ আর নেই। আমার দাদা তা নিয়ে নিয়েছেন— ভালো নেই তিনি)। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার আমার বাড়ি চলে গেছে (আমার কাছে সব দলিল আছে) কিন্তু মনে আক্ষেপ নেই কেনো? আজ বুঝি আমি “হিন্দু তাই মনে আক্ষেপ নেই”।
১৯৯২ থেকে ১৯৯৫, তখন আমি প্রায় যুবকই, বিদেশে একা, রান্না করে খেয়েছি, হাসপাতাল চালিয়েছি, প্রাক্টিস করেছি, মেডীকেল কলেজে পড়িয়েছি, ছেলে মেয়েকে মিস করেছি। কিন্তু একদিনের জন্যেও কষ্ট পাইনি। আমার সনাতনি জীবন দর্শন আমাকে সব কষ্ট থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। বিশাল বাড়িতে রাত ৭ টা থেকে সকাল ৮ টা একা। চারিদিক শুন শান। মদের ঠেকে যাই নি, তাই বন্ধু বান্ধব ছিলো না।
মেয়ে বন্ধুর কথা ভাবিনি তাই সেই অসুবিধা ছিলো না। ৩ বছর টেলিভিশন দেখিনি, কারো বাড়ি যাই নি। রোজ সকাল সন্ধ্যায় ৫ হাজার বার মালা জপেছি (গুরুদেবের দেওয়া মন্ত্র)। আর মেডিটেশান। অনেক কিছু পেয়েছি যা বললে আপনারা ভাববেন “আমার মাথা খারাপ” তাই কাউওকে বলি না।
ছেলে মেয়েকে প্রকৃত শিক্ষা দিয়েছি, আজ ওরা জীবনে সু প্রতিষ্ঠিত। ২০০৮ সালে , চাকুরী ছেড়েছি যখন আমার আরো ৭ বছর চাকুরী ছিলো। যেদিন পেনশান পাবার অধকারী হলাম, সব লোভ এবং বিদেশ জীবনের আরাম আয়েশ ত্যাগ করে, নিজের বাড়ি ফেলে রেখে, গাড়ি ৩ টা বেচে দিয়ে চলে এসেছি। রাজার হাটে মাত্র ২ কামরার ৮০০ স্কোয়ার ফুটের ফ্লাটে থেকেছি সেই ২০০৯ থেকে, বাগুইয়াটিতে ভি আই পির পাশে ৪ তলা বাড়ি থাকা স্বত্তেও।
আজ আমার আবার সব হয়েছে। হাবড়ায় বাড়ি, নিউ টাউনে ২০০০ স্কোয়ার ফুটের ফ্লাট ৫ তলায়, সুইমিং পুল আছে ছাদের ওপরে। হাবড়ার বাড়িতে আবার সুইমিং পুল বানিয়েছি। কৃচ্ছ সাধনের ভন্ডামি করি না। আমি এবং মিসেস দেবনাথের কোনো অশান্তি দুঃখ কষ্ট নেই। কেনো????
কারন আমরা দুজনেই প্রকৃত হিন্দু হবার চেষ্টা করেছি, কিছুটা হয়েও ছি। সনাতনি জীবন আমাদের আজো নীরোগ করে রেখেছে। যা অর্থ আছে চলে যাবে। ছেলে মেয়ে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত, নাতনীরা দুদিন হলো এসেছে—(সাড়ে তিন বছর আর ৪ বছরের।)
তাহলে কি দাড়ালো???? ১৯৮৬ সাল থেকে প্রথমে সনাতনী দর্শন পড়া, ১৯৮৬ সালে দীক্ষা, ১৯৯২ থে ১৯৯৫ তিন বছর একাগ্র সাধনা, নিদিধ্যান, স্মরন, মনন করার পর আজ ৬৭ বছরে একটু শান্তির সন্ধান পেয়েছি। কতো বছর হলো? প্রায় ৩১ বছরের কষ্ট শেষে কিছুটা শান্তি।।
অন্য ধর্ম বা দর্শন ভালো হতে পারে। তা নিজের ধর্মেই যদি সব পাই তাহলে অন্যের দিকে তাকানোর কি দরকার??? ঘরের খাবারেই আমার পেট ভরে, রেষ্টুরেন্টে গিয়ে কি লাভ?????
এই জন্যই আমি আজ সুখী গর্বিত হিন্দু। যার শেষ ভালো তার সব ভালো। তাই বলি “স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় পর ধর্ম ভয়াবহ”। আমার ওই তিন বন্ধু আজ বড়ো মনোকষ্টে আছে। যখন যাই দেখি শুনি,খারাপ লাগে।
লেখক- ডাঃ মৃনাল কান্তি দেবনাথ
আরো পড়ুন…