হিন্দুদের তাড়িয়ে দিয়ে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসিত করা হোক’

‘হিন্দুদের তাড়িয়ে দিয়ে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসিত করা হোক’
শিতাংশু গুহ ||
তখন এরশাদ ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন। দেশে সীমিত রাজনীতি চালু হয়েছে। বায়তুল মোকাররমে সম্ভবত ১৫ দলের এক জনসভায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলছিলেন- ‘দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হলো। প্রতিদ্ব›িদ্বতা করলেন ড. কামাল এবং বিচারপতি সাত্তার। জনগণ ভোট দিল ড. কামালকে; জিতলেন বিচারপতি সাত্তার। আর ক্ষমতায় বসলেন জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ’। এতদিন পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনায় দাদার এ কথাটি আবার মনে পড়ল এবং তার বক্তব্যের সঙ্গে তাল মিলিয়েই একজন বললেন, ‘কাবার ওপরে শিবের ছবি বসাল জাহাঙ্গীর, জেলে গেল রসরাজ, আর বাড়ি পুড়ল, মন্দির ভাঙল মালাউনের’। নাসিরনগর নিয়ে লেখার ইচ্ছে নেই, তবে বেচারা রসরাজ, বিনা দোষে জেল খাটছে, এই যা! ফেসবুকে একজন লিখেছেন, ‘সাংস্কৃতিক রাজাকার বলায় যদি সাগর সাহেবের ১০০ কোটি টাকার মান যায়, তবে বিনা দোষে রসরাজ বা উত্তমের রাষ্ট্রের কাছে কত হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ পাওয়া উচিত’? উত্তর জানা নেই। তবে বাঘের গলায় আটকে যাওয়া হাড্ডি বের করে আনার পর বকের পুরস্কার চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাঘের কথা সবার মনে আছে নিশ্চয়?
পত্রিকায় দেখলাম নূরে আলম সিদ্দিকী রোহিঙ্গাদের দেশে ঢুকতে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের জন্য সমবেদনা থাকা ভালো, কিন্তু ভিনদেশি রোহিঙ্গাদের জন্য যাদের এত দরদ দেশের সংখ্যালঘুরা যখন অত্যাচারিত তারা তখন নীরব থাকেন কেন? রোহিঙ্গাদের ওপর যা ঘটছে সেটা প্রত্যক্ষ জেনোসাইড; কিন্তু বাংলদেশে হিন্দুদের ওপর বিরামহীনভাবে যা ঘটছে সেটা পরোক্ষ জেনোসাইড। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ১৯৪৭ থেকে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ড থেকে প্রায় ৫ কোটি হিন্দু হারিয়ে গেছে। আবার ভারত বিভাগের পর থেকে পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশে হিন্দুর সম্পত্তি দখলের যে একটি বদভ্যাস অনেকের মধ্যে গড়ে উঠেছে, সেটা আজো চলছে তো চলছেই। হিন্দুদের বাধ্য হয়ে দেশত্যাগের কাফেলা বন্ধ হবে কবে? এভাবে একটু একটু করে হিন্দু বিতাড়ন না করে একবারে খেদিয়ে দিলে কেমন হয়? নূরে আলম সিদ্দিকীর পরামর্শে অবাক হবার কিছু নেই, বরং হিন্দুর বাপের ভাগ্য যে কেউ এখনো এমত পরামর্শ দেননি যে, ‘হিন্দুদের তাড়িয়ে দিয়ে তাদের জায়গায় মুসলমান রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসিত করা হোক’।
সরকার দেখলাম হিন্দুদের রক্ষায় আইন প্রণয়ন করছেন। সরকারকে সাধুবাদ জানাতে হয়। তবে দেশ থেকে আমার এক প্রগতিশীল বন্ধু লিখেছেন, কোনো আইনই বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের রক্ষা করতে পারবে না। তার মতে, দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা মৌলবাদী চিন্তাধারায় পুরোপুরি কলুষিত। বন্ধু ভালোভাবেই জানেন আমি সংখ্যালঘু আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাই তিনি লিখেছেন, শুধু সংখ্যালঘু নয়, তোমাদের আন্দোলনের সঙ্গে আমাদেরও নাও, কারণ দেশে এখন সেক্যুলার মুসলমানরা সংখ্যালঘুর চেয়েও সংখ্যালঘু। তা ছাড়া তোমরা তো ভারত যেতে পারবে, আমরা যাব কোথায়? বন্ধুর মতে, উগ্রবাদীদের ঠেকাতে সেক্যুলার মুসলমানদের হাতকে শক্তিশালী করাটা জরুরি। বাংলাদেশ নিয়ে যারা ভাবেন এবং যারা দেশকে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দেখতে চান, তারা বন্ধুর কথার সঙ্গে একমত না হয়ে পারবেন না। দেশকে মধ্যপন্থী, গণতান্ত্রিক রাখতে হলে সংখ্যালঘু ও প্রগতিশীল মুসলমানদের রক্ষা করতে হবে এবং উভয় গোষ্ঠী একে অপরের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে হবে বা একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। এ প্রসঙ্গে এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়, মৌলবাদকে উৎসাহিত করে উগ্রবাদ ঠেকানো যায় না।
অতি সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একটি কথা বলেছেন, যা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রধর্ম থেকে সরে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা আওয়ামী লীগের নেই। রাষ্ট্রধর্ম তো আছেই, তবু কেন তাকে নুতন করে এ কথা বলতে হলো? এর কারণ সম্ভবত তাকেও মৌলবাদের সঙ্গে ব্যালান্স করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রযন্ত্রটি এখন অনেকটা সাম্প্রদায়িক, জননেত্রী শেখ হাসিনা বা সেক্যুলার ওবায়দুল কাদের চাইলেও সব কিছু করতে পারেন না। তাদের ব্যালান্স করতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রধর্মের অবদান অনেক। আওয়ামী লীগ ইচ্ছে করলেও রাষ্ট্রধর্ম বাদ দিতে পারবে না, এটাই বাস্তবতা। জিয়া-এরশাদ রাষ্ট্রযন্ত্রে যে সাম্প্রদায়িকতা ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন, তা থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা আওয়ামী লীগের নেই। আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষ চেহারাটা তাই প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। এ সময়ে সংখ্যালঘুর ওপর যতগুলো ঘটনা ঘটেছে এর সব ক’টিতে দলীয় নেতারা জড়িত। অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত সদ্য বলেছেন, বিশ বছর পর দেশে কোনো হিন্দু থাকবে না। তাকে আশ্বাস দিয়ে বলা যায়, দেশে তখন আওয়ামী লীগও থাকবে না; বরং আওয়ামী লীগ পুনর্মূষিকোভব, অর্থাৎ ‘মুসলিম আওয়ামী লীগ’ হয়ে যাবে।
রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে কথা বলা অবান্তর। মানুষ ধর্ম করে মূলত পরকালের জন্য। রাষ্ট্রের কি পরকাল আছে? মানুষ মরলে স্বর্গ বা নরক যেখানেই যাক, রাষ্ট্রের কি স্বর্গ-নরক আছে? বা রাষ্ট্রের কি মরণ আছে? রাষ্ট্রের আকার পরিবর্তন হতে পারে, রাষ্ট্র মওে না। তাই এর ধর্ম থাকতে পারে না। রাষ্ট্রধর্ম ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ মতো একটি উদ্ভট উদ্ভাবন, যদিও এতে ধর্মান্ধদের পোয়াবারো। দেশ যেমন একটু একটু করে ইসলামি হচ্ছে, আওয়ামী নেতারাও একটু একটু করে রাজনৈতিকভাবে ইসলামী হচ্ছেন বা হতে বাধ্য হচ্ছেন। খেলাফতের সঙ্গে আব্দুল জলিলের চুক্তির কথা সবার মনে থাকার কথা। তখন বলা হয়েছিল, কৌশলগত কারণে ওটা হয়েছে। কৌশলগত কারণেই হয়তো এখন সবাই একটু একটু করে মুসলমান হচ্ছেন। সম্ভবত একই কারণে ঢাকার মেয়র হানিফ মরার আগে আওয়ামী লীগের নীতিমালায় ‘শরিয়া’ অন্তর্ভুক্তির আবদার করেছিলেন। সবাই লক্ষ করেছেন যে, নাসিরাবাদ ঘটনার পর প্রতিমন্ত্রী ছায়েদুল হক প্রেস কনফারেন্স করেছেন টুপি পরে। এমনিতে ধর্মীয় কারণে একজন মুসলমান টুপি পরবেন সেটা ঠিক আছে। কিন্তু এই টুপি সেই টুপি নয়; এটা ‘রাজনৈতিক’ টুপি, মানুষকে ধোঁকা দেয়ার রাস্তা। আর একটু পেছনে গেলে দেখা যাবে, নারায়ণগঞ্জের এমপি সেলিম ওসমান যখন শিক্ষক শ্যামল ভক্তকে ইসলাম ধর্ম অবমাননার ভুয়া ধুঁয়া তুলে ‘চরম অপমান’ করেছিলেন, তৎপরবর্তী সব কর্মকাণ্ডে তার মাথায় টুপি ছিল। এদের টুপিকে ‘মোশতাক টুপি’ বললে কি খুব একটা বেমানান হবে?
শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবী এখন ধীর লয়ে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হচ্ছে। ট্রাম্পের বিজয় সেটাকে এগিয়ে দেবে। ফ্রান্স ও জার্মানিতে রক্ষণশীলদের বিজয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। কেউ কি কখনো ভেবেছেন, পৃথিবীর সব দেশ যদি ধর্মভিত্তিক দেশ হয়, তাহলে কেমন হয়? অর্থাৎ, আমেরিকা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা খ্রিস্টান রাষ্ট্র এবং জাপান, শ্রীলঙ্কা বৌদ্ধ বা ভারত হিন্দু রাষ্ট্র হয়ে গেলে কেমন হবে? তারাও যদি বলতে শুরু করে, তাদের দেশে অন্য ধর্মের মানুষ থাকতে পারবেন না, বা অন্য ধর্মের মানুষদের খেদিয়ে বিদায় করে, তাহলে কি হবে? পৃথিবীর সব রাষ্ট্র যদি ধর্মীয় রাষ্ট্র হয়ে যায়, তাতে তো কারো আপত্তি থাকার কোনো কারণ নেই? আবার দেখুন, সৌদি আরবে গেলে মহিলাদের বাধ্যতামূলক হিজাব পরতে হয়। এখন ইউরোপ-আমেরিকা যদি বলে, তাদের দেশে এলে মহিলাদের তাদের মতো খোলামেলা ড্রেস পরতে হবে, তাতে কি খুব অন্যায় হবে? রাষ্ট্রের আইন তো সবাইকে মানতে হবে! এদিক থেকে অবশ্য পুরুষদের সুবিধা আছে, স্যুট-কোট-টাই সর্বত্র সমাদৃত। ঢাকায় একদা দেশবাংলা নামে একটি কাগজ ছিল, এর মালিক-সম্পাদক ছিলেন ফেরদৌস আহমদ কোরেশী। তিনি বলতেন, একজন হিন্দুকে জনাব বললে তার মনে যেমন ব্যথা লাগে; একজন মুসলমানের নামের আগে শ্রী লাগালেও তিনি রাগ করেন। কিন্তু এই হিন্দু বা মুসলমানের নামের আগে মিস্টার যুক্ত করলে কিন্তু কেউ অখুশি হন না।
কথাটা সত্য। আমরা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু কোনো ক্রিস্টান বিশ্ব কিন্তু নেই! থাকলে কেমন হতো? ওআইসি আছে, ওসিসি মানে অর্গানাইজেশন অফ খ্রিস্টান কান্ট্রিজ নেই। চীন যদি হঠাৎ বৌদ্ধ রাষ্ট্র হয়ে যায়, তাহলে কেমন হয়? একেবারেই কি অসম্ভব? সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে বেশ ক’টি মুসলিম রাষ্ট্র এবং বাকিগুলো (খ্রিস্টান রাষ্ট্র নয়) গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে। ফিদেল ক্যাস্ত্রো মারা গেছেন। রাহুল ক্যাস্ত্রোর পর হয়তো কিউবায় সমাজতন্ত্রও মারা যাবে। এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে গণতন্ত্রের ওপর কোনো সুন্দর ব্যবস্থা নেই; বাংলাদেশে সেই গণতন্ত্র আসুক। আর সাম্প্রদায়িকতা ও গণতন্ত্র একসঙ্গে থাকতে পারে না। তাই দেশ থেকে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাস্ত করতে হবে। পত্রিকায় দেখলাম, ২৬ নভেম্বর বুয়েট সিভিল সামিটে হিন্দু ছাত্রছাত্রীদের চালাকি করে গরুর মাংস খাওয়ানো হয়েছে। কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পুনর্মিলনীতে একই কাণ্ড ঘটেছিল। আচ্ছা গরুর মাংস খেলে যেমন হিন্দুর হিন্দুত্ব যায় না, তেমনি অন্যকে গরুর মাংস খাইয়ে বেহেশতের চাবি পাওয়া যায় না, এটা শুধুই হীনমন্যতা। তাও আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে, সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে! ছেলেবেলায় পড়েছিলাম, বিদ্যা বিনয় দান করে। আমাদের ভার্সিটির কর্মকর্তারা কি শুধুই শিক্ষিত, বিনয়ী বা বিদ্বান নন?
নিউইয়র্ক। ৫ ডিসেম্বর ২০১৬
শিতাংশু গুহ : কলাম লেখক।

এইবেলাডটকম/প্রচ