স্বনামধন্য ইতিহাসবিদ
আচার্য যদুনাথ সরকার (জন্মঃ- ১০ ডিসেম্বর, ১৮৭০ – মৃত্যুঃ- ১৯ মে, ১৯৫৮)
ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবেষণার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। এ কারণে দেশবাসী তাকে আচার্য হিসাবে সহজেই বরণ করে নিয়েছিল। বেশ কয়েকটি ভাষার ওপর তার ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। সত্যনিষ্ঠ, তথ্যসমৃদ্ধ ও প্রামাণিক ইতিহাস রচনার জন্যই মূলত তিনি উর্দু, ফারসি, মারাঠি ও সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। তিনিই প্রথম ফ্রান্সের প্যারিসে অবস্থিত জাতীয় গ্রন্থাগারে মীর্জা নাথান রচিত বাহরিস্তান-ই-গায়বী- এর পাণ্ডুলিপি খুঁজে পান। পরবর্তীতে তিনি এ বিষয়ে বিভিন্ন জার্নালে বাংলা এবং ইংরেজিতে প্রবন্ধ রচনা করেন। ১৯২৬ সালে বৃটিশ সরকার তাঁকে সি আই ই এবং ১৯২৯ সালে ‘নাইটগুড’ (স্যার) খোতাবে সম্মানিত করেন। ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯৪৪ সালে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় ডি.লিট উপাধি প্রদান করে ।
যদুনাথ সরকার রাজশাহী জেলার করচমারিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রাজকুমার সরকার এবং মাতা হরিসুন্দরী দেবী। বিদ্যানুরাগী রাজকুমার সরকারের ব্যক্তিগত বিশালাকার গ্রন্থাগার ছিল। গণিতের ছাত্র হলেও ইতিহাসে ছিল তার গভীর আগ্রহ যা যদুনাথ সরকারকে প্রভাবান্বিত করেছিল। পিতাই তাঁর কিশোর চিত্তে ইতিহাসের নেশা জাগিয়ে দিয়েছিলেন। পিতার মাধ্যমেই অল্প বয়সে তাঁর পরিচয় হয়েছিল বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘Hisotry of England’ নামীয় গ্রন্থের সঙ্গে। রাজকুমার সরকার পুত্রের হাতে প্লুটার্ক রচিত প্রাচীন গ্রীক ও রোমান নায়কদের জীবনী তুলে দিয়েছিলেন। এছাড়াও যদুনাথ সরকারকে ইতিহাস-চর্চায় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন ভগিনী নিবেদিতা, যিনি সিস্টার নিবেদিতা নামে বেশি পরিচিত। ইতিহাস শাস্ত্রে অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী যদুনাথ সরকারের প্রাথমিক পড়াশোনার হাতেখড়ি হয় তার গ্রামের স্কুলে। এরপর রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল। এ স্কুল থেকেই ১৮৮৭ সালে বোর্ডে ষষ্ঠ স্থান অধিকার করে এন্ট্রান্স পাস করেন। ১৮৮৯ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে এফ. এ পাস করেন প্রথম বিভাগে দশম স্থান লাভ করে। এরপর ১৮৯১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি ও ইতিহাসে সম্মানসহ প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে বি. এ এবং ১৮৯২ সালে ইংরেজি সাহিত্যে ৯০ শতাংশ নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করে এম.এ পাস করেন। ১৮৯৭ সালে ‘প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ’ বৃত্তি স্বর্ণপদকসহ দশ হাজার টাকা বৃত্তি লাভ করেন।
যদুনাথ সরকারের কর্মময় জীবন ছিল বর্ণাঢ্য। চাকরিজীবন শুরু করেন অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে এবং অধ্যাপক জীবনের বেশীরভাগ সময় কাটে পাটনা ও কটকে। ১৮৯৩ সালে তিনি রিপন কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এখান থেকে পরে চলে যান মেট্রোপলিটন কলেজে। ১৮৯৮ সালে যোগদান করেন বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল এডুকেশনাল সার্ভিসে। ওই বছরই আবার চলে আসেন প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে। এক বছরের মাথায় বদলি হয়ে চলে যান পাটনা কলেজে। ১৯১৭ সালে যোগদান করেন কাশী হিন্দু কলেজে। যদুনাথ সরকার ১৯২৩ সালে রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির সম্মানিত সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯২৬ সাল পর্যন্ত তিনি কাশী হিন্দু কলেজে অধ্যাপনা করেন। অবসরের পূর্বে ৫ বছর তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে আসীন ছিলেন। ১৯২৬ সালের বছরের ৪ আগস্ট তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে মনোনীত হন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম অধ্যাপক ভাইস-চ্যান্সেলর ছিলেন তিনি। তার পূর্বে কোনো বাঙালি অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলেন না। এভাবে একবার কলেজ আবার এডুকেশনাল সার্ভিসে চাকরির পর ১৯৩০ সালে অবসর গ্রহণ করেন। যদুনাথ সরকার তার প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯২৬ সালে বৃটিশ সরকার তাঁকে সি আই ই এবং ১৯২৯ সালে ‘নাইটগুড’ (স্যার) খোতাবে সম্মানিত করেন। ১৯৩৬ ও ১৯৪৪ সালে ঢাকা ও পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি. লিট উপাধি প্রদান করেন।
জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও যদুনাথ সরকার ছিলেন অসম্ভব মানবদরদি। তিনি সবসময় সাধারণের পাশেই থাকার চেষ্টা করতেন। তাদের বিপদে-আপদে সাহায্য করতেন হাত খুলে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে যদুনাথ সরকারের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। রাজকুমার সরকারের সঙ্গে স্যার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচয় ছিল। রাজকুমারের বাসস্থান বর্তমান নাটোর জেলার করচমারিয়া গ্রাম দেবেন্দ্রনাথের জমিদারি পতিসরের পাশের এলাকা। ঠাকুরদের মানুষের প্রতি সহমর্মিতা ও ভালোবাসার অসাধারণ গুণটি তাকে দারুণ প্রভাবান্বিত করেছিল। সাহিত্য সমালোচক হিসেবেও তার পরিচিতি ছিল। রবীন্দ্র-সাহিত্যের ছিলেন সমঝদার পাঠক। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার লাভের আগেই তিনি কবির রচনার ইংরেজি অনুবাদ করে পাশ্চাত্য জগতের কাছে তার পরিচয় তুলে ধরেন। ১৯১০ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯১৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মডার্ন বিডিউ-এ রবীন্দ্রনাথের ১৭টি প্রবন্ধ ও একাধিক কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেন যদুনাথ।
যদুনাথ সরকারের মোট গ্রন্থ পঁচিশটি। এছাড়াও তিনি ১২টি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন। ১৯০১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গ্রন্থ পাঁচ খণ্ডে সমাপ্ত ‘হিস্ট্রি অফ ঔরঙ্গজেব’। তাঁর রচিত অন্যান্য গ্রন্থ হলোঃ ১। দ্য ফল অফ দ্য মুঘল এম্পায়ার, ২। শিবাজী (বাংলা), ৩। মিলিটারী হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া, ৪। দ্য রানী অফ ঝাঁসী, ৫। ফেমাস ব্যাটেল্স্ অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি, ৬। শিবাজী এন্ড হিজ টাইম, এবং ৭। ক্রোনোলজী অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি। তাঁর সংগৃহীত গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপি ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে।
স্বনামধন্য ইতিহাসবিদ স্যার যদুনাথ সরকার দীর্ঘ কর্মময় জীবন শেষে ১৯৫৮ সালের ১৯ মে কলকাতায় পরলোকগমন করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৮৮ বছর।