নৃত্যশিল্পী-উদয়-শংকর

বিশ্বখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্কর, ধ্রুপদী ও লোকনৃত্যে এক বিস্ময়কর নাম।

বিশ্বখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্কর। রাশিয়ার বিখ্যাত ব্যালে নৃত্যশিল্পী আন্না পাভলোভা ‘রাধাকৃষ্ণ’ এবং ‘হিন্দুবিবাহ’ এ দুটি বিষয়ের ওপর দুটি নৃত্য তৈরির জন্য উদয়শঙ্করকে নিয়োজিত করেন। তিনি নিজে কৃষ্ণরূপে এবং পাভলোভা রাধারূপে কভেন্ট গার্ডেনের রয়েল অপেরা হাউজে এ দুটি নৃত্য উপস্থাপন করেন। বিভিন্ন দেশের অসংখ্য দর্শক মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে তাঁদের অভিনন্দিত করে।

নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্কর পাভলোভার জন্য রাধাকৃষ্ণ কিংবদন্তি ও অজন্তা গুহাচিত্রের ওপর আরও কয়েকটি ব্যালে তৈরি করেন। পাভলোভার সাথে উদয়শঙ্কর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে অসংখ্য প্রদর্শনী করেন।

নৃত্যের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ১৯২৯ সালে তিনি ভারতে ফিরে আসেন। তাঁর সঙ্গে আসেন প্যারিসের পিয়ানোবাদক সিমন বারবিরি। তিনি উদয়ের নৃত্যসঙ্গী হন এবং তাঁর শিষ্যত্ব বরণ করেন। তাঁরা একসঙ্গে গোটা ভারত সফর করে বহু প্রদর্শনী করেন যা সর্বত্র মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় দর্শকদের আকর্ষণ করে।

মিস এলিস বনার নামে একজন বিখ্যাত সুইস ভাস্কর ও শিল্পকলাবিদও তাঁর সঙ্গে ভারতে আগমন করেন। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে উদয়  লোকনৃত্য ও বাদ্যযন্ত্রের সন্ধানে ভারতের সব এলাকা ঘুরে বেড়ান এবং বিভিন্ন অঞ্চলে নানা ধরনের শিল্পসমৃদ্ধ ধ্রুপদী লোকনৃত্য দেখে অত্যন্ত মুগ্ধ ও অনুপ্রাণিত হন।

তিনি কেরালার স্থানীয় লোকনৃত্য ‘কথাকলি’ সংগ্রহ করেন এবং সেটিকে গোটা ভারতে, বিশেষকরে বাংলায় জনপ্রিয় করে তোলেন। এলিস বনারের সহযোগিতায় উদয় প্যারিসে The Compagnie Uday Shankar de Dance Musique Hindous নামে একটি নৃত্য ও সঙ্গীত কোম্পানি স্থাপন করেন।

১৯৩০ সাল থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত তাঁর দল সারা ইউরোপে ৮৮৯টি প্রদর্শনী করে। এ সময় কয়েকবার তিনি তাঁর দলসহ আমেরিকা ভ্রমণ করেন। উদয়শঙ্করের আকর্ষণীয় অভিনয়কলা দক্ষিণ এশিয়ার ধ্রুপদী লোকনৃত্য ও সঙ্গীতের সমৃদ্ধি সম্পর্কে পাশ্চাত্য জগতে এক নতুন ধারণার জন্ম দেয়।

১৯৩৭ সালে কলকাতায় উদয়শঙ্করকে প্রদান করা হয় এক বীরোচিত সংবর্ধনা।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। তাঁরই অনুপ্রেরণায় উদয়শঙ্কর ১৯৩৯ সালে হিমালয়ের পাদদেশ আলমোড়ায় ‘শংকর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টার’ নামে একটি ইনস্টিটিউট স্থাপন করেন।

এ কেন্দ্রে তিনি, কথাকলিতে শঙ্করণ নাম্বুদ্রি, ভরতনাট্যমে কন্ডপ্পা পিল্লাই, মণিপুরীতে অমবি সিং এবং সঙ্গীতে ওস্তাদ  আলাউদ্দিন খাঁ প্রমুখ গুরুগণকে শিক্ষাদানের জন্য আমন্ত্রণ জানান।

খুব শীঘ্রই উদয়শঙ্করের আলমোড়া কেন্দ্রটি ভারতীয় বিভিন্ন ঘরানার নৃত্য ও সঙ্গীতের একটি সম্মেলন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। উল্লেখ্য যে, এ কেন্দ্রের বেশির ভাগ অর্থই সংগৃহীত হতো উদয়ের ইউরোপ ও আমেরিকার বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে।

এ ধরনের পরনির্ভরশীলতার কারণে এক সময় এর ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে এবং সফলভাবে চারবছর চলার পর অর্থের অভাবে কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। এ নাতিদীর্ঘ সময়ে উদয়শঙ্কর কেন্দ্রটি অনেক মহান নৃত্যশিল্পী সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়।

তাঁদের মধ্যে গুরু দত্ত, শান্তি বর্ধন, সিমকি, অমলা, নরেন্দ্র শর্মা, প্রভাত গাঙ্গুলী, জোহরা সেগাল, উজরা, শচীন শঙ্কর, মোহন সেগাল, সুন্দরী শ্রীধরণী, দেবীলাল সমর এবং ভগবান দাশের নাম উল্লেখযোগ্য।

উদয়শঙ্কর ‘কল্পনা’ নামে একটি ব্যালে চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেন। এতে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী অমলা প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। ‘কল্পনা’ যদিও বাণিজ্যিকভাবে সফল হয় নি, কিন্তু এতে উদয়শঙ্করের নৃত্যের উৎকর্ষ, তাঁর ব্যালে, তাঁর শৈল্পিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিভার প্রতিফলন ঘটেছে।

নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্করের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ভারতীয় নৃত্যকলার জন্য অভূতপূর্ব সম্মান, প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদা বয়ে আনে। তাঁর নৃত্য-রীতির পূর্বপর্যন্ত ভারতীয় নৃত্যকলা ঐতিহ্যগতভাবে বাইজি, দেবদাসী, মিরাসিস এবং নর্তকীদের সম্পত্তি ছিল।

ভারত ও বাংলায় উদয়শঙ্কর নৃত্যকে সঙ্গীত ও নাটকের সমমর্যাদায় উন্নীত করেন। ১৯৬০ সালে তিনি কলকাতায় স্থায়িভাবে বসবাস শুরু করেন।

জন্ম ও শিক্ষা পিতা পন্ডিত শ্যামশঙ্কর ছিলেন  নড়াইল জেলার অধিবাসী। ঝালোয়ারের মহারাজার ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে চাকরি করার সময় উদয়পুরে তাঁর পুত্র উদয়শঙ্করের জন্ম হয়। শ্যামশঙ্কর ছিলেন একজন পন্ডিত ব্যক্তি এবং অভিনয়কলার রসজ্ঞ সমঝদার।

তাঁর নিকট নৃত্য ছিল কলা ও সাধনা উভয়ই। উদয় নিজেও স্বভাবগতভাবেই নৃত্য ও অঙ্কনের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ১৯১৮ সালে তাঁকে মুম্বাই-এর বিখ্যাত জে.জে আর্ট স্কুল এবং পরবর্তী সময়ে গন্ধর্ব মহাবিদ্যালয়ে পাঠানো হয়।

পরে নৃত্য ও অঙ্কনে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য তিনি ১৯১৯ সালে লন্ডনের রয়েল কলেজ অব আর্টসে ভর্তি হন। সেখানে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য চিত্রাঙ্কন এবং নৃত্যের ওপর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় বিষয়েই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

রয়েল কলেজ অব আর্টসের সভাপতি স্যার রদেনস্টাইন ব্রিটেনের খ্যাতনামা শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেন। চিত্রাঙ্কনের ওপর আরও প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য তিনি রয়েল কলেজ অব আর্টসের বৃত্তি নিয়ে রোম গমন করেন।

উদয়শঙ্কর দেশ-বিদেশের অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন। ভারতীয় অভিনয়কলার নবজাগরণে অসামান্য অবদান রাখার জন্য তাঁকে ১৯৭১ সালে ‘পদ্মবিভূষণ’ পদকে ভূষিত করা হয়। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৫ সালে তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি প্রদান করে।

ভারতীয় ডাকবিভাগ তাঁর এবং তাঁর দলের ‘তান্ডব নৃত্যের’ ওপর বেশ কয়েকটি বর্ণাঢ্য ডাকটিকিট প্রকাশ করে। শিল্পকলা বিশেষজ্ঞদের বিচারে উদয়শঙ্কর ছিলেন একজন অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন উদ্ভাবক।

নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্কর
নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্কর

ধ্রুপদী ও লোকনৃত্যের ওপর ভিত্তি করে তিনি একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য তৈরি করেছিলেন, যা ছিল রীতিমতো বিস্ময়কর ও অসাধারণ। নৃত্যের ক্ষেত্রে তিনি পৌরাণিক ও আধুনিক ভাবধারার সংমিশ্রণে আধুনিক রুচি ও ধ্যানধারণার উপযোগী নব নব ভাবধারার সৃষ্টি করেন। ১৯৭৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।

উদয়শঙ্কর,তুমি নৃত্যকলাকে সঙ্গিনী করে পশ্চিম মহাদেশের জয়মাল্য নিয়ে বহুদিন পরে ফিরে এসেছ মাতৃভূমিতে। মাতৃভূমি তোমার জন্য রচনা করে রেখেছে– জয়মাল্য নয়–আশীর্বাদপূত বরণমাল্য। বাংলার কবির হাত থেকে আজ তুমি তা গ্রহণ করো।

আশ্রম থেকে তোমাকে বিদায় দেবার পূর্বে একটা কথা জানিয়ে রাখি। যে-কোনো বিদ্যা প্রাণলোকের সৃষ্টি– যেমন নৃত্যবিদ্যা– তার সমৃদ্ধি এবং সংবৃদ্ধির সীমা নাই। আদর্শের কোনো একটি প্রান্তে থেমে তাকে ভারতীয় বা প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য নামের দ্বারা চরম ভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা বিহিত নয়, কারণ সেই অন্তিমতায় মৃত্যু প্রমাণ করে।

তুমি দেশবিদেশের নৃত্যরসিকদের কাছ থেকে প্রভূত সম্মান পেয়েছ, কিন্তু আমি জানি তুমি মনে মনে অনুভব করেছ যে, তোমার সামনে সাধনার পথ এখনো দূরে প্রসারিত, এখনো তোমাকে নূতন প্রেরণা পেতে হবে, উদ্ভাবন করতে হবে নব নব কল্পমূর্তি। আমাদের দেশে “নবনবোন্মেষশালিনী বুদ্ধি’কেই প্রতিভা বলে।

তোমার প্রতিভা আছে, সেই কারণেই আমরা আশা করতে পারি যে, তোমার সৃষ্টি কোনো অতীত যুগের অনুবৃত্তিতে বা প্রাদেশিক অভ্যস্ত সংস্কারে জড়িত হয়ে থাকবে না। প্রতিভা কোনো সীমাবদ্ধ সিদ্ধিতে সন্তুষ্ট থাকে না, অসন্তোষই তার জয়যাত্রাপথের সারথি। সেই পথে যে-সব তোরণ আছে তা থামবার জন্যে নয়, পেরিয়ে যাবার জন্যে।

একদিন আমাদের দেশের চিত্তে নৃত্যের প্রবাহ ছিল উদ্‌বেল। সেই উৎসের পথ কালক্রমে অবরুদ্ধ হয়ে গেছে। অবসাদগ্রস্ত দেশে আনন্দের সেই ভাষা আজ স্তব্ধ। তার শুষ্ক স্রোতঃপথে মাঝে মাঝে যেখানে তার অবশেষ আছে সে পঙ্কিল এবং ধারাবিহীন। তুমি এই নিরাশ্বাস দেশে নৃত্যকলাকে উদ্‌বাহিত করে আনন্দের এই বাণীকে আবার একবার জাগিয়ে তুলেছ।

নৃত্যহারা দেশ অনেক সময় এ কথা ভুলে যায় যে, নৃত্যকলা ভোগের উপকরণমাত্র নয়। মানবসমাজে নৃত্য সেইখানেই বেগবান, গতিশীল, সেইখানেই বিশুদ্ধ, যেখানে মানুষের বীর্য আছে। যে দেশে প্রাণের ঐশ্বর্য অপর্যাপ্ত, নৃত্যে সেখানে শৌর্যের বাণী পাওয়া যায়। শ্রাবণমেঘে নৃত্যের রূপ তড়িৎ-লতায়, তার নিত্যসহচর বজ্রাগ্নি।

পৌরুষের দুর্গতি যেখানে ঘটে, সেখানে নৃত্য অন্তর্ধান করে, কিংবা বিলাস-ব্যবসায়ীদের হাতে কুহকে আবিষ্ট হয়ে তেজ হারায়, স্বাস্থ্য হারায়, যেমন বাইজির নাচ। এই পণ্যজীবিনী নৃত্যকলাকে তার দুর্বলতা থেকে তার সমলতা থেকে উদ্ধার করো।

সে মন ভোলাবার জন্যে নয়, মন জাগাবার জন্যে। বসন্তের বাতাস অরণ্যের প্রাণশক্তিকে বিচিত্র সৌন্দর্যে ও সফলতায় সমুৎসুক করে তোলে। তোমার নৃত্যে ম্লানপ্রাণ দেশে সেই আনন্দের বাতাস জাগুক, তার সুপ্ত শক্তি উৎসাহের উদ্দাম ভাষায় সতেজে আত্মপ্রকাশ করতে উদ্যত হয়ে উঠুক, এই আমি কামনা করি। ইতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , প্রবাসী, ভাদ্র, ১৩৪০। বিশ্বখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্কর (জন্মঃ- ৮ ডিসেম্বর, ১৯০০ – মৃত্যুঃ- ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭) 

আর পড়ুন….