হেফাজত ইসলাম অর্থ্যাৎ কওমি মাদ্রাসা কেন্দ্রিক যতগুলো ‘সাংস্কৃতিক সংগঠন’ আছে তাদের প্রত্যেকের বাংলাদেশ নিয়ে দেশাত্মবোধক গান আছে। গত দশ বছর ধরে তারা বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, একুশে ফেব্রয়ারি উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠান করে। এসব অনুষ্ঠানে দেশপ্রেম এবং নিজেদের বাংলাদেশী হিসেবে গর্ব প্রকাশ করা হয়। একটা সময় পর্যন্ত ইসলামপন্থিরা বাংলাদেশের বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রুয়ারিকে অগ্রাহ্য করে যেতো। পাকিস্তান ভেঙ্গে যাবার পর তারা ভেবেছিলো পাকিস্তান রাষ্ট্রের মুসলিম মিল্লাতের যে চেতনা সেটা ভারত-সোভিয়েত তখনকার সেক্যুলার ভাবাদর্শে বিলিন হয়ে যাবে। এছাড়া পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়াতে আলেম ওলামারা নাখোশ ছিলেন দীর্ঘকাল। তাদের আওয়ামী লীগ তথা শেখ মুজিবে এলার্জির এটাও একটা কারণ। যদিও শেখ মুজিব ৭২ সালের পরই সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা রেখেও প্যান ইসলামিজমে ঝুঁকে ছিলেন আরব দেশগুলোর কৃপা লাভ করতে। তবু দীর্ঘকাল শেখ মুজিব এদেশের ইসলামপন্থিদের কাছে ভিলেন পাকিস্তান ভাঙ্গার বেদনায়।
‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ‘স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি’- মূলত এই আত্মপরিচয়ে এদেশে প্রগতিশীলতার চর্চা চলত। ইসলামপন্থিরাই এদেশে প্রগতিশীলতার শত্রু। আবার তারাই ছিলো মূখ্যত ‘স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি’। বস্তুত এদেশে ভাসাভাসা কতগুলো উদার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যতিত প্রগতিশীলতার কোন চর্চা বা ধারণা কখনই গড়ে উঠেনি। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ব্যানারে তাদের ফাইট মৌলবাদীদের সঙ্গে ছিলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কেন্দ্রিক। তখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে অগাহ্য করা ইসলামী শক্তিও কেবলমাত্র বাংলাদেশের জন্মের অনিবার্যতাকে অস্বীকার করে, ভারত-সোভিয়েত ষড়যন্ত্র আবিস্কার করে তথাকথিত প্রগতিশীলদের সঙ্গে ফাইট চালাতো। কথিত প্রগতিশীলদের ৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাবার ডাকও ছিলো সেক্যুলারিজমের উপর তাদের ভাসাভাসা একটা সমর্থন মাত্র।
ইসলামপন্থিদের নতুন প্রজন্ম যখন থেকে বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিয়ে, বুকে জাতীয় পতাকা বেধে কপালে আরবী হরফে কলেমা খচিত ব্যান্ড বেধে বিজয় র্যা লী শুরু করলো বস্তুত এদেশের এতদিনকার ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ‘স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি’ বলতে যে কাঁচের দেয়ালটি ছিলো তা ঝুরঝুর করে ভেঙ্গে পড়ল। ইসলামপন্থিরা কথিত প্রগতিশীলদের প্রশ্ন করল, মুক্তিযুদ্ধ কি ইসলামকে বিরোধীতা করেছিলো? ভবিষ্যতে আমরা আবার দেশের জন্য যুদ্ধে যেতে ‘আল্লাহো আকবর’ বলে শ্লোগান দিবো- কোন সমস্যা আছে?
কথিত প্রগতিশীলদের মুখে জবাব নেই বলাই বাহুল্য। একটা দেশের নয় মাসের যুদ্ধের ইতিহাস দিয়ে কখনই সেক্যুলারিজম, প্রগতিশীলতার আন্দোলন টেনে নেয়া যায় না। প্রগতিশীলতার সঙ্গে সরাসরি ধর্মের বিরোধীতা। পুরাতনকে বর্জন করে নতুনকে আলিঙ্গন করাই প্রগতিশীলতা। অপরদিকে পুরাতনকে ভবিষ্যতেও আকড়ে থাকার নামই ধর্ম। সেক্যুলারিজম মানেই হচ্ছে রাষ্ট্র হবে নাস্তিক ধর্মহীন। রাষ্ট্র কোন সংখ্যাগরিষ্ঠ বা বিশেষ জাতি ধর্ম বর্ণের পরিচয়ে পরিচিতি হবে না। এটা তো সরাসরি ইসলামী রাজনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই প্রগতিশীল সেক্যুলাদের শত্রুই জ্ঞান করে ইসলামপন্থিরা। এই শত্রুতায় প্রগতিশীল সেক্যুলারদের অবশ্যই রাষ্ট্র সমাজ চিন্তায় ধর্ম তথা ইসলামের বিরুদ্ধতা করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর স্বাধীনতার স্বপক্ষতার ব্যানার মার খেয়ে গেছে মাথায় টুপি আর গালে অবিনস্ত দাড়িতে পায়জামা-পাঞ্জাবী পরিহত মাদ্রাসার ছাত্রদের জাতীয় পতাকা আর আরবী হরফে কলেমার কাছে। মনে রাখতে হবে এদেশে ইসলামী শক্তি হিসেবে জামাত ইসলামের অর্থবল থাকলেও জনসমর্থন নেই। তাদের বাদে অন্যান্য ইসলামী শক্তির জনসমর্থন ব্যাপক এবং অরাজনৈতিক! যেমন আওয়ামী লীগের নেতারা শর্ষীণার পীর সাহেবের মুরিদ। আল্লামা শফির ভক্ত মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির বহু ভোটার! এই নেতা এবং ভোটারদের কেউই আজ ৭২ সালের সংবিধানে আস্থা রাখে না। আপনি ইসলামের সঙ্গে আপোষ করে কি করে তাহলে তাদের প্রগতিশীলতা আর সেক্যুলারিজমের কথা বলবেন?
ব্লগারদের এই বিষয়ে সবচেয়ে ভাল অভিজ্ঞতা ছিলো অনলাইনে। মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে সেক্যুলার মুক্তচিন্তার ব্লগাররা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ছাগু ফাইটারদের মতই ইসলামপন্থিদের সঙ্গে লড়লেও মুক্তচিন্তা বিষয়ক লেখালেখির সময় এইসব ছাগু ফাইটাররা সবাই ইসলামন্থিদের শিবিরে গিয়ে দাঁড়াতো। হেফাজত ১৩ দফা দেবার পর তারা গবেষণা করে দেখিয়েছিলো ১৩ দফা কুরআন-হাদিস অনুসারে হয়নি। তখন ব্লগে একজন ছাগু ফাইটারকে প্রশ্ন করেছিলাম, এখন যে বলছেন ১৩ দফা কুরআন সম্মত নয়, তাহলে কাল যখন কুরআন-হাদিস থেকে দেখাবে নারী নেতৃত্ব ইসলামে হারাম তাহলে কি শেখ হাসিনাকে তখন রাজনীতি থেকে সরে যেতে বলবেন? মুক্তিযুদ্ধের যে চার মূলনীতি তা যদি আজকে প্রচার করেন এগুলো ইসলাম সম্মত, মুক্তিযুদ্ধ ইসলামী ভাবধারায় বিরোধী ছিলো না তাহলে কালকে জাতীয় পতাকায় কলেমা যুক্ত করার দাবীকে কি দিয়ে ফাইট করবেন?
বলা বাহুল্য ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ কোন জবাব দিতে পারেনি!