উপেক্ষিত মহাপ্রাণ: যীশুর অজানা জীবন।

★উপেক্ষিত মহাপ্রাণ: যীশুর অজানা জীবন★

   ভারতে তখন চলছে কুষাণ যুগ। কাশ্মীরের জোজিলা গিরিপথের কাছে হেমিস বৌদ্ধ মঠে দেহত্যাগ করলেন পশ্চিম দেশীয় সাধক ঈশা। শ্রীনগরের কাছে “রোজাবাল”, সেখানে তাঁকে সমাধি দেওয়া হয়। কাশ্মীরে সাধুসন্তদের সমাধিকে রোজাবাল বলা হয়। কাশ্মীরের অধিবাসীরা একজন প্রাচীন হিব্রুভাষী ইহুদি পুণ্যবান পুরুষের কথা বলে আসছে। তাঁর নাম উজ আসাফ (Yuz asaf) অর্থাৎ “Leader of Healed”। এই উজ আসাফই হলেন ঈশা। ঈশাই হলেন যীশু খৃষ্ট। কাশ্মীরে মুসলিম আগমনের পূর্বে বৌদ্ধ ও হিন্দুরা রোজাবাল দেখাশোনা করত। পরে পঞ্চদশ শতকে মুসলিম এক পীরকে রোজাবাল এ সমাহিত করা হয়। সেই পীরের নাম সৈয়দ নাসর-উদ-দিনিস ।

    যীশুর জীবনের ১৩ থেকে ৩০ বছরের কথা বাইবেলে উল্লেখ নেই। খৃষ্টান দুনিয়া সযত্নে এড়িয়ে চলে ঐ নিয়ে চর্চা। কারণ হিসাবে মনে করা হয় যে, যীশুর উপর খৃষ্টান দুনিয়া তথা ভ্যাটিকানের একাধিপত্য থাকবে না সব প্রকাশ পেলে।
     গবেষকদের মতে যীশুর শান্তি, অহিংসা ও প্রেমের বাণী হিন্দু ও বৌদ্ধ প্রভাবে প্লাবিত। মিশরের আলেকজেন্দ্রিয়া বৌদ্ধধর্ম চর্চার বড় কেন্দ্র ছিল। সেখানেই প্রথম বৌদ্ধ দর্শনের পাঠ নেন যীশু, পরবর্তীতে ভারতে।

     দুই বার ভারতে এসেছিলেন যীশু।
    ◆ প্রথম বার মিশর থেকে ভারতে এসেছিলেন বৈদিক, বৌদ্ধ ও আয়ুর্বেদ শিক্ষার জন্য। তক্ষশীলা সহ বিভিন্ন স্থানে শিক্ষা লাভ ক‍রেন।
   ◆ দ্বিতীয় বার এসেছিলেন ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পর। বাইবেল অনুযায়ী যীশুকে ক্রশবিদ্ধ করা হয়েছিল শুক্রবার দুপুরে। তিন ঘন্টা পর অচেতন যীশুর দেহ ক্রশ থেকে নামিয়ে নিকটস্থ সমাধি গুহায় রাখা হয়। ক্রশবিদ্ধ হওয়ার পর ৬ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকার সম্ভব। যীশুও বেঁচে ছিলেন। সমাধি গুহা থেকে পালিয়ে জেরুজালেমের বাইরে কোথাও লুকিয়ে ছিলেন যীশু ও মেরি। তারপর ক্ষত সেরে উঠার পর নাম বদলে ফেলে ছদ্মবেশ ধারণ করে কাফেলার সঙ্গে রেশম পথ ধরে পূর্ব পরিচিত ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পন্ডিতদের ধারণা প্রথম শতকের মাঝামাঝি কাশ্মীরে পৌঁছান যীশু। মেরি কাশ্মীরেই মারা যান। পাকিস্তানের “মারি” শহরে মেরির সমাধি ছিল।
  
কিছু প্রমাণ :-
  ● নিকোলাস নটোভিচ ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে জ্ঞানলাভের উদ্দেশ্যে ভারতের কাশ্মীর আসেন এবং লাদাখের হেমিস মঠে কিছু সময় অতিবাহিত করেন। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা নটোভিচকে প্রাচীন তিব্বতিয় পান্ডুলিপির কথা বলেন, যাতে ইসা নামে এক পশ্চিমদেশীয় জ্যোর্তিময় পুরুষের কথা রয়েছে।
   নটোভিচ তিব্বতিয় পান্ডুলিপি অনুবাদ করেন এবং রাশিয়া ফিরে যান। যীশুর অজানা জীবনের কথা প্রকাশ হতে যাচ্ছে শুনে রুশ খ্রিষ্টান কট্টরপন্থিরা ক্ষোভ প্রকাশ করে। অবশেষে ১৮৯৪ সালে বহু বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে The Unknown life of Jesus Christ বইটি প্রকাশিত হয়। বইটিতে নটোভিচ দাবি করেন যে হারানো বছর গুলোয় যীশু ভারতবর্ষে এসেছিলেন ও এই সময়ে তিনি বৈদিক দর্শন, বৌদ্ধ ধর্ম এবং আয়ুর্বেদ সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করেন।

   ● যীশুর রহস্য সন্ধানে লাদাখ যান স্বামী বিবেকানন্দের গুরুভাই পন্ডিতপ্রবর স্বামী অভেদানন্দ। হেমিস মঠে যীশু বিষয়ক তিব্বতি পান্ডুলিপি সচক্ষে দেখে বিস্মিত হন তিনি এবং তাঁর বই ‘কাশ্মীর ও তিব্বতী’ গ্রন্থে যীশু বিষয়ক তথ্যাদি সর্বমোট ২২৪ পঙতি বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন।

  ● হেমিস মঠে তিব্বতিয় পান্ডুলিপিটি অনেকেই দেখেছেন। তাদের মধ্যে হেনরিয়েটা মেররিক অন্যতম। ইনি In the World’s Attic নামে বইয়ের লেখিকা। ১৯২১ সালে মেররিক পান্ডুলিপিটি দেখেন। মেররিক তাঁর লিখেছেন,”In Leh (লাদাখ -এর রাজধানী) is the legend of Jesus who is called Issa, and the Monastery at Himis holds precious documents fifteen hundred years old which tell of the days that he passed in Leh where he was joyously received and where he preached.” (লাদাখের রাজধানী লেহ্তে কিংবদন্তীর যীশু ইসা নামে পরিচিত। এবং হেমিস মঠে রক্ষিত পনেরশ’ বছরের পুরনো মূল্যবান নথিপত্রে যীশুর কথা কথা রয়েছে, যীশুর শিক্ষার কথা রয়েছে। )

  ● ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে মীর ইজ্জুৎউল্লাহ নামে একজন পারস্যবাসী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নির্দেশে মধ্য এশিয়া ও লাদাখ সফর করেন। Travels in Central Asia বইতে তিনি লিখেছেন: “They keep sculptured representations of departed saints, prophets and lamas in their temples for contemplation. Some of these figures are said to represent a certain prophet who is living in the heavens, which would appear to point to Jesus Christ.”(তাহারা ধ্যানের নিমিত্ত তাহাদের প্রার্থনাগৃহে পরলোকগত সাধুসন্তের ভাস্কর্য সংরক্ষণ করে। এইসব ভাস্কর্যের কয়েকটি স্বর্গবাসী নবীর-যাহাকে যীশু খৃষ্ট বলিয়া প্রতীয়মান হয়।)

   ● কাশ্মীরের ইতিহাসের অন্যতম উৎস হল ‘রাজতরঙ্গিনী’। এটি রচিত হয় ১১৪৮ খ্রিস্টাব্দে। রাজতরঙ্গিনী গ্রন্থটিতে রয়েছে, “ইসানা নামক একজন মহৎ সন্ত ডাল হ্রদের তীরে ইসাবারে বসবাস করিতেন। তাঁহার অসংখ্য ভক্ত ছিল।”

   ●  “বৈশ্যমহাপুরাণ” হিন্দুদের আঠারোটি পবিত্র গ্রন্থের অন্যতম। বৈশ্যমহাপুরাণে প্রথম শতকের কাশ্মীরের রাজার সঙ্গে যীশুর সাক্ষাতের দৃশ্য বর্ণিত আছে। বৈশ্যমহাপুরাণে যীশুকে ‘ইসাপুত্তম’ এবং ‘কুমারীগর্ভস্বংবরণ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
      শ্রীনগরের কাছে রাজা শালিবাহনের সঙ্গে ইসা মহি-র সাক্ষাতের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। রাজা শালিবাহন-এর সময়কাল ৩৯ থেকে ৫০ সাল। শালিবাহন কুষাণ সাম্রাজ্যের কাশ্মীর অঞ্চলের শাসক ছিলেন।

————————————————————-
   সত্য প্রকাশ পাবেই। আজ না হোক কয়েক শত বছর পরে। জ্ঞানবৃদ্ধ মহাপ্রাণ সাধু যীশুকে ক্ষুদ্র স্বার্থে ধর্মের গন্ডীতে আবধ্য রেখে তাঁর অবমূল্যায়ন করা হয়ে আসছে।

** কিছু অংশ ডঃ মৃণাল কান্তি দেবনাথের লেখা থেকে নেওয়া।