আমরা হাদিসে ‘গাজওয়াতুল হিন্দের’ কথা জানি। ভারতে মুসলমানরা হামলা করবে ইসলামিক খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য। দুর্গা পুজার আগ দিয়ে হঠাৎ ওয়াজের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে যাবার ব্যাপারটা এক সময় নজরে এসেছিলো। এবারো শুনলাম ওয়াজ হচ্ছে এবং আগামী সপ্তাহে অনেক জায়গাতে ওয়াজ হবে। হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে বা কাছাকাছি জায়গায় মাইক লাগিয়ে ওয়াজ হবে।
ওয়াজের বিষয়বস্তু হযরত ইব্রাহিম কি করে তার মূর্তি পুজারী বাবা-মা ভাইদের মূর্তি ভেঙ্গে একেশ্বরবাদের শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। যারা আর কয়েকদিন পর মূর্তিকে পুজা করবে তাদেরকে শুনিয়ে মূর্তি পুজার বদলে ইসলামের ছায়াতলে আসার আহ্বান আসলে তাদের ঈমানী দায়িত্ব। যেমন পহেলা বৈশাখের আগে বিগত কয়েক বছর ধরে ওয়াজ ও ইসলামি সংস্কৃতি নামের হেড়ে গলায় মাইকের বিকট শব্দে গজল গেয়ে পহেলা বৈশাখের শিরকি ঈমান নষ্টকারী উৎসব সম্পর্কে সতর্ক করার চেষ্টা চলছে…।
আমি হুজুরদের কোন দোষ দেই না। তারা যাটাকে তাদের ধর্ম হিসেবে পেয়েছে তাকেই প্রচার করছে। আবু বকরের ছেলে আবু বকরকে বলেছিলো, বদরের যুদ্ধে সে আবু বকরকে দেখতে পেয়েও চলে গেছে শত হোক সে তার বাবা। আবু বকরের ছেলে কুরাইশদের হয়ে লড়ছিলেন। আবু বকক জবাবে বলেছিলো, আল্লার কসম, যদি আমি তোমাকে দেখতে পেতাম তাহলে ধর থেকে মাথা আলাদা করে ফেলতাম…।
এর নাম ইসলামের শিক্ষা ও নৈতিকতা। মন্দিরে ঢুকে মূর্তি ভাংচুর করা মুসলমান হযরত ইব্রাহিমের, হযরত মুহাম্মদের মূর্তি ভাঙ্গা থেকে দলিল নিয়ে নৈতিক দায়মুক্তি নেয়। সহি হাদিস বলছে, “হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, তোমাদের সামনে যখন ইসলামবিরোধী কাজ হতে দেখবে তখন হাত দিয়ে প্রতিরোধ করবে। যদি এতে অক্ষম হও তবে মুখ দিয়ে প্রতিবাদ জানাবে। যদি তাতে অক্ষম হও তবে অন্তর দিয়ে তাকে ঘৃণা করবে, তবে এটি দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক।” (সহীহ মুসলিম)।
এই হাদিস থেকেই আইএস সিরিয়া জাদুঘরে রক্ষিত প্রাচীন ভাস্কর্য, মূর্তি, ধ্বংস করে দিয়েছে কারণ তারা সক্ষম হয়েছে। তালেবান বুদ্ধ মূর্তি কামান দেড়ে ধ্বংস করেছিলো। বাংলাদেশে বকের ভাস্কর্য, লালন ভাস্কর্য, জাস্টিসিয়া ভাস্কর্য ধ্বংস করা হয়েছে কারণ এখানে তারা শক্তি অর্জন করতে পেরেছে। যারা এখনো সক্ষম হয়নি তারা মুখ দিয়ে বলছে।
যারা সেটাও পারছে না তারা মনে মনে এর বিরোধীতা করছে। ইসলামের চোখে যা ‘অন্যায়’ তার কোন ইউনিভার্সাল ভ্যালু নেই। যেমন গান বাজনা করাও ইসলামের চোখে অন্যায়। রমনায় যারা বোমা ফাটিয়ে গান শুনতে আসা মানুষদের হত্যা করেছিলো তারা এই হাদিস থেকেই শিক্ষা নিয়েছে। জাকির নায়েক এই হাদিস দেখিয়ে বলেছিলো, মুসলমানরা মদের দোকান বন্ধ করতে বলবে যদি তাদের মুখে বলার মত সক্ষমতা থাকে।
যদি সেটা না থাকে তাহলে মদের দোকানের বিরোধীতা মনে মনে করতে হবে। আর যদি সশস্ত্র শক্তিমত্তা এসে যায় তাহলে মদের দোকান বল প্রয়োগ করে বন্ধ করে দিতে হবে। বাংলাদেশ পাকিস্তানে রোজার দিনে খাবার দোকান মুসলমানরা বন্ধ রাখে। মালয়েশিয়াতে এবার রোজার দিনে খাবার খাওয়ার কারণে অনেক অমুসলিমদের গ্রেফতার করেছিলো ইসলামিক নৈতিক পুলিশ।
মালয়েশিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ বিধায় তারা এই শক্তি প্রয়োগ করেছে। বাংলাদেশ পাকিস্তানে একই অবস্থা। ইউরোপে মুসলিমদের সেই ক্ষমতা নেই তাই তারা মনে মনে এরকম কিছুই কামনা করছে আর স্বপ্ন দেখছে যেদিন তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে…।
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠবে যে কতজন মুসলমান এরকম জিনিসে বিশ্বাস করে? বেশির ভাগ মুসলমানই ভালো ইত্যাদি। আসলে এই প্রশ্নটার চাইতে বেশি জরুরী কতজন মুসলিম এই হাদিস ও কুরআনের আয়াতগুলো পড়বে? অর্থ্যাৎ একজন ধর্ম বিশ্বাসী মুসলমান পৃথিবীর অন্যসব ধর্মের ধার্মীকদের মতই অন্ধ আনুগত্য প্রকাশ করে তার ঈশ্বরের কাছে। ভয়টা এখানেই।
একজন মুসলমান, পরকালে কবরের আজাবে ভীত মুসলমান কুরআন খুলে দেখবে সেখানে লেখা আছে, “বসে ইবাদাতকারীদের চেয়ে আল্লাহর পথে সংগ্রামকারীদের মর্যাদা প্রভুর নিকট অনেক বেশি।” (সূরা নিসা : ৯৫)। আল্লার পথে সংগ্রাম মানে হচ্ছে ‘জিহাদ’।
জিহাদ কি জিনিস? জিহাদ আর জঙ্গিবাদ এক জিনিস না? জিহাদকে সন্ত্রাসের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা যাবে না? আপনি যখন কারোর উপর হামলা চালাবেন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য, অথবা ইসলামে অনুমোদন নেই এমন কিছুতে সেটা লোকে সন্ত্রাসই বলবে। ইসলামের চোখে জিহাদ মহান হলেও অন্যদের কাছে এটা নিছক সন্ত্রাস।
এখন পর্যন্ত যত জন জঙ্গি জিহাদী বই নিয়ে গ্রেফতার হয়েছে সেই বইগুলোর নাম দেখেছেন? সেই বইগুলো কারা লিখেছে তাদের নাম জানেন? জঙ্গিদের পাঠ্যসূচীর জিহাদী বইগুলো আসলে বিভিন্ন তাফসির, হাদিস, সীরাত গ্রন্থ। আছে জিহাদের উপর বিস্তারিত আলোচনা যা কোন ইসলামি স্কলারের লেখা বই।
আমরা হাদিসে ‘গাজওয়াতুল হিন্দের’ কথা জানি। ভারতে মুসলমানরা হামলা করবে ইসলামিক খিলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য আর সেই জিহাদে যে মুসলমান সুযোগ পাবে সে যে মিস না করে। অর্থ্যাৎ ভারতে বসবাস করা মুসলমানদের দায়িত্ব হচ্ছে ভারতে যখন বাইরে থেকে আক্রমন আসবে তখন যেন তারা হানাদারদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করে। দেওবন্ধে এই হাদিস রোজ পড়ানো হয়। মুসলমানদের ভারতের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে।
পাকিস্তান যদি জিহাদের নামে ভারত হামলা চালায় তাহলে ভারতীয় মুসলমানদের কি করতে হবে? কি ভয়ংকর অবস্থা! কতজন মুসলমান এসব জানে বা মানে তার চাইতে বড় কথা কতজন মুসলমান এসব বিশ্বাস করবে? পাকিস্তানের বড় বড় আলেমরা সেদেশের মুনির কমিশনে সাক্ষাৎকার দিয়ে কুরআন হাদিস সম্মতভাবে মত দিয়েছিলেন ভারতের মুসলমানদের উচিত হবে পাকিস্তান সেখানে হামলা করলে পাকিস্তানের হয়ে যুদ্ধ করা!
ইমরান খান কাম্মির নিয়ে সেই একই উশকানি দিলেন। ইমরান খান ইসলামফোবিয়া বলে বলে হাহাকার করলেন। গাজাওয়াতুল হিন্দের মত হাদিস, জিহাদের মত হাদিস ও কুরআনের আয়াত যেখানে মুসলমানদের সন্ত্রাসী করে তুলবে সেখানে ইসলামফোবিয়া তৈরি হবে না?
সত্য কথা বললেই এখন শুনতে হয় আরএসএস!
এসব নাকি আরএসএসের আইটিসেল থেকে টাকা পেয়ে লিখি! আগে বলত মোসাদের টাকায় লিখি। এরা জীবনে একটাও ইসলামিক বই পুড়োটা পড়েনি। আটক জিহাদী বইগুলোর লিস্ট একবার যোগার করে দেখেন এসব বই লিখেছে ইমাম বুখারী, মুসলিম, তিরমিযি, ইমাম ইবনে কাসির, আল তাবারীদের মত ইসলামিক পন্ডিতরা। মুসলমানরা অত্যাচারিত,
মুসলমানরা নির্যাতিত বলে বলে ইসলামিক রাজনীতির লাভ হতে পারে কিন্তু মুসলমানদের কোন লাভ নেই। মুসলমানদের স্ব স্ব জাতিসত্তায় মিশে যেতে হবে। বাঙালী তামিল পাঞ্জাবী আফ্রিকান, ইউরোপীয়ান, আরবী, ফারসী সকল জাতি সত্ত্বায় মিশে যেতে হবে। মুসলিম কোন জাতির নাম হতে পারে না। এটা একটা ধর্ম সম্প্রদায়ের নাম।
মুশকিল হচ্ছে লেখাপড়া শেখা জাকিরমাকিরদের যেখানে ‘মুসলমান সাহিত্যিক’ অবস্থান থেকে সরানো যায় না সেখানে হাজার হাজার কওমি অশিক্ষিত হুজুরদের কিভাবে সেটা বুঝানো যাবে?