সম্প্রতিকালে দুটো ঘটনা তোলপাড় তুলছে, এক- সৌদি যুবরাজ নারীরা পুরুষের সমান’ বলে গণমাধ্যমের কাছে মত ব্যক্ত করেছেন, দুই- কেরালার এক অধ্যাপক মেয়েদের পর্দাহীনতাকে দোকানের কাটা তরমুজের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তরমুজের ভেতরের লাল দেখে যেমন ক্রেতা আকৃষ্ট হয় তেমনি বোরখা-হিজাব না পরলে নারীরা পুরুষদের কাটা তরমুজের মত আকৃষ্ট করে। এটা অনেকটা আমাদের দেশের ছিলা কলায় মাছি বসার মত তুলনা বলা চলে। যাই হোক, নারী পুরুষের সামান কিংবা নারীর পর্দা করা উচিত এরকম বিতর্কের সময় আমি সব সময় লক্ষ্য করেছি আর সবার কথা এইসব বিতর্কে চলে আসলেও প্রকাশ্যে কোথাও ইসলামের নামটা আসে না! মুসলমানরা তাদের নারীদের কঠরভাবে পর্দা করতে বলে তা কি তাদের ধর্ম বিরোধী অবস্থান? ইসলামের জন্মস্থান এবং শরীয়ার যেখানে কঠরভাবে প্রয়োগ হয় সেই সৌদি আরবে বোরখা না পরলে নারীদের জেলে যেতে হয়। সেখানে কোন নারী তার পুরুষ অভিভাবক ছাড়া একা ঘরের বাইরে বের হতে পারে না। এত কঠরভাবে নারীদের প্রতি পর্দার নামে অবরোধ করার পিছনে ইসলামের হাত কতটুকু? মডারেটরা যে বলেন, কুরআন-হাদিসের কোথাও বোরখার কথা নেই!
মডারেটরা আত্মপ্রতারণা করে। ইসলামে নারীকে চোখ বাদে সারা মুখমন্ডল কাপড়ে আটকে রাখতে বলছে- এরকম পোশাকের নাম বোরখা না গোখরা রাখবে সেটা মানুষের ইচ্ছা। ইচ্ছা করলে একটা বস্তা উপুর করে কোন মহিলাকে পরালেই ইসলামের পর্দার শর্ত মান্য হয়- তার নাম স্থান কাল ভেদে ভিন্ন কিছু হতে পারে। দেখুন কুরআন এবং তার তাফসির এ বিষয়ে কি বলে- ‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে ও মুমিনদের নারীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে। ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু (সূরা আহযাব : ৫৯)। আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, আল্লাহ তাআলা মুমিন নারীদেরকে আদেশ করেছেন যখন তারা কোনো প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হবে তখন যেন মাথার উপর থেকে ওড়না বা চাদর টেনে স্বীয় মুখমন্ডল আবৃত করে। আর (চলাফেরার সুবিধার্থে) শুধু এক চোখ খোলা রাখে (ফাতহুল বারী ৮/৫৪, ৭৬, ১১৪)।
কাজেই কেরালার সেই অধ্যাপক একজন বিশ্বাসী মুসলমান হিসেবে তার ছাত্রীদের যা বলেছেন সবই তার ধর্ম তাকে শিক্ষা দিয়েছে। ভারতীয় গণমাধ্যম ঐ অধ্যাপক একজন নারী বলে জানিয়েছে। হোক বা না হোক, এরকম পর্দাপ্রিয় বহু নারী আছে সরকারী বেসরকারী বড় পদে আছেন। যাদের অধিনে বা নেতৃত্বে শত শত পুরুষ কাজ করেন। দক্ষতার সঙ্গেই এইসব নারীরা বস হয়ে বসেছেন তাদের পুরুষ কলিগদের। মাথায় বড় কাপড়ের বিড়া বেধে বা ইসলামী লেবাস ধরে এইসব শিক্ষিত ক্ষমতাবান নারীরা কর্মক্ষেত্রে মুসলিম নারীদের পোশাক নিয়ে কটুক্তি করেন। নিজেদের প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে অনেক ক্ষেত্রে নিচের স্তরের নারীদের পর্দা করতে কঠরতা দেখান। ধর্মের কাছে এইসব মানসিক প্রতিবন্ধি মহিলারা ইসলামকে মহান করেন তুলেন সুযোগ পেলেই। অথচ ইসলাম মতে একজন নারী কখনই পুরুষদের বস হতে পারেন না। পারেন না কোন সিদ্ধান্ত নিতে। কারণ কুরআন পরিস্কার করে বলে দিয়েছে, ‘তোমাদের আপন পুরুষ লোকের মধ্য হইতে দুইজন সাক্ষী রাখ, যদি দুইজন পুরুষ না পাওয়া যায়, তাহা হইলে একজন পুরুষ ও দুইজন স্ত্রীলোক – (সূরা বাকারা, আয়াত,৮২)। কুরআনের এই আয়াত নারী যে পুরুষের সমান নয় তার দলিল। কুরআনের এমন কোন আয়াত নেই যেটা দিয়ে কেউ প্রমাণ করতে পারবে ইসলাম নারীদেরকে পুরুষের মত সমান মনে করেছে। এমন কোন নজির দেখাতে পারবেন না যেখানে ইসলামের নবী ও সাহাবীরা নারীদের স্বাধীনভাবে চাকরি ব্যবসা করার অনুমতি দিয়েছেন। বরং সহি হাদিসে দেখা যায় নারীকে মুহাম্মদ পুরুষ গার্জেন ছাড়া ঘর থেকেই বের হতে নিষেধ করেছেন। নবী বলেছেন, একজন পর-পুরুষ একজন মহিলার সাথে কোন মুহরিম ছাড়া একাকী হতে পারবে না। এবং কোন মহিলা মুহরিম ছাড়া সফর করতে পারবে না। একথা বলার পর এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার স্ত্রী হজ্বের উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন। আর আমি অমুক যুদ্ধে তালিকাভুক্ত হয়েছি। (এখন আমি কি করবো?) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি চলে যাও এবং তোমার স্ত্রীর সাথে হজ্ব কর (মুসলিম-২২৯১)।
একজন অভিভাবক ছাড়া যেখানে মুসলিম নারীর ঘর থেকে বের হবার সুযোগ ইসলাম স্বীকার করে না সেখানে মাথায় বিড়া পাকিয়ে ইসলামের গুণগান করা নারীদের মধ্যে ক্ষমতাবাণদের করুণা করা ছাড়া উপায় নেই। সৌদি যুবরাজ তাই পরিস্কারভাবেই ইসলামকে ডিঙ্গিয়ে সৌদি নারীদের মুক্তি দেয়ার চেষ্টা করছেন। সৌদি আরবের সংস্কার প্রসঙ্গে ইসলাম ধর্মের কথা বার বার আসার কথা। শরীয়া আইন তো মুসলমানদের ধর্মীয় বিধান। সেই শরীয়া আইনকে সংস্কার করে সৌদি নারীদের একা সফর করার সুযোগ অবশ্যই ইসলাম ধর্মকে পাশ কাটানো। সৌদি নারীদের ইসলাম অনুসারে ভোট দানের ক্ষমতা ছিলো না কারণ কুরআনের বাকার সেই আয়াত। ইসলাম নারীদের পুরুষের মত রাজনীতি বা নেতৃত্ব মানে না বলেই কোন ইসলামী খিলাফতবাদী দলের নারী সংগঠন নেই।
জানি এবার কিছু মডারেট দৌড়ে আসবেন কিছু আয়াত নিয়ে যা দিয়ে নারী-পুরুষ সমতা প্রমাণের চেষ্টা করবে। যেমন ‘তোমার বিবিগন তোমাদের আচ্ছাদন আর তোমরা তাদের আচ্ছাদন (সূরা বাকারা, আয়াত, ১৮৭)। আরো একটি জনপ্রিয় তাকিয়া আয়াত ‘পুরুষদের ওপর নারীদের হক আছে যেমন দস্তুর অনুযায়ী নারীদের ওপর পুরুষের হক আছে (সূরা বাকারা, আয়াত, ২২৮)। বস্তুত মডারেটরা এই আয়াতগুলোর আগে পিছের আসল বক্তব্য কাট করে সবার সামনে ইসলামকে নারী বান্ধব হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করেন। এবার তাই এই দুটো আয়াতের আসল মানে আপনাদের দেখাই। ‘তোমার বিবিগন তোমাদের আচ্ছাদন আর তোমরা তাদের আচ্ছাদন’ আয়াতটির পুরোটা এরকম ‘তোমাদের জন্য রমজানের রাত্রে তোমাদের বিবিগনের নিকট গমন করা জায়েজ করা হইয়াছে, তোমার বিবিগন তোমাদের আচ্ছাদন আর তোমরা তাদের আচ্ছাদন, আল্লাহ জানিতে পারিলেন যে তোমরা নিজেদের ক্ষতি করিতেছিলে, সুতরাং তিনি তোমাদের অপরাধ মার্জনা করিলেন এবং তোমাদের দোষ ছাড়িয়া দিলেন, সুতরাং এখন উহাদের সহিত সহবাস কর (সুরা বাকারা, আয়াত, ১৮৭ )। এবার দেখা গেলো এখানে মোটেই নারী পুরুষ একে অপরের উপর সমান অধিকার রাখে তা বলা হয়নি। বরং রমজান মাসে দিনের বেলার পরিবর্তে যে রাতের বেলা তারা সহবাস করতে পারবে সেটাই বলা হচ্ছে! রোজা রেখে সেক্স করা নিষেধ। এটার কারণে সাহাবীদের অনেকেই ভেবেছিলো এই মাস পুরোটাই বুঝি সেক্স না করে থাকতে হবে। এই গুঞ্জন মুহাম্মদের কানে গেলে বাকারার এই আয়াত নাযিল করে তাদের বলা হয়েছিলো রোজা ভাঙ্গার পর সেক্স করা যাবে। অথচ এই আয়াতকে কাটছাট করে মডারেটরা দেখানোর চেষ্টা করে এখানে নারী-পুরুষের সমতার কথা বলা হয়েছে।
এবার দ্বিতীয় আয়াতটার কথা বলি। এটি দিয়েই বেশি বাটপারি করা হয়। ‘পুরুষদের ওপর নারীদের হক আছে যেমন দস্তুর অনুযায়ী নারীদের ওপর পুরুষের হক আছে’- এই আয়াত দিয়ে বলা হয় ইসলাম নারীর সমাধিকারের কথা বলেছে। কিন্তু সম্পূর্ণ আয়াতটায় বলা হয়েছে এরকম ‘পুরুষদের ওপর নারীদের হক আছে যেমন দস্তুর অনুযায়ী নারীদের ওপর পুরুষেরও হক আছে, অবশ্য নারীদের ওপর পুরুষদের বিশেষ মর্যাদা রহিয়াছে, এবং আল্লাহ শক্তিমান ও প্রজ্ঞাশীল (সূরা-বাকারা, আয়াত, ২২৮)। একদম পরিস্কার করেই নারী থেকে যে পুরুষ উচু স্তরের সেটা বলা হয়েছে। এখানে কতৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য ‘বিশেষ মর্যাদার’ কথাটা বলা হয়েছে। কুরআনের এইসব আয়াত খন্ডিতভাবে প্রকাশ করে যদি কেউ ইসলামে নারী-পুরুষদের সমান অধিকার আছে বলে তাহলে সেটাকে তো পজেটিভভাবেই নেওয়া উচিত কি বলেন? অনেকেই হয়ত একমত হয়ে বলবেন সেটাই তো ভাল। কিন্তু মডারেটদের কি আপনি কখনই দেখেছেন ভারতীয় নারীদের তিন তালাকের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে সমর্থন জানাতে? বাংলাদেশের নারীদের সম্পত্তিতে সমাধিকারের বিলকে সমর্থন জানাতে? ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাক দায়ী নয়-কখনই কি তারা এরকম অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়েছে? দাঁড়ায়নি। বরং প্রতিটি ইস্যুতে বিরোধীতা করেছে। তাদের এইসব কাটছাট আয়াত নিয়ে তাকিয়াবাজী একমাত্র তখনই শুরু হয় যখন ইসলাম সমাজ জীবনে রাষ্ট্রীয় জীবনে উপযোগী কিনা সেই বিতর্ক উঠে আসে। মূলত সাময়িকভাবে ইসলামকে বাঁচাতেই তাদের এইসব দৌড়ঝাপ। একটা গুন্ডাকে গুন্ডাই বলা উচিত। এভাবে না বলে অমুক আসলে গুন্ডা নয়, তার দলের লোকজন গুন্ডামী করে তার নাম দিচ্ছে বলে বিশেষ সুবিধা পাওয়া যাবে না।