হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ “বাঙ্গালী” তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বর্ণনায় ছেচল্লিশের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাঃ
(মুজিব যে কতটা সত্যের বিকৃতি ঘটাতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন, তা তাঁরই রচিত এই প্রতিবেদনে উল্লিখিত কলকাতার দাঙ্গা সংক্রান্ত প্রথম অংশটিতে বর্নিত হয়েছে। উক্ত বিবরণে তিনি স্রেফ চূড়ান্ত অসত্যের আশ্রয় নিয়ে ফুটিয়েছেন …. মিথ্যের অজস্র ফুলঝুরি। ইতিহাস ক্ষমা করেনি তাঁকে। তাঁর সেই মুসলমান ভাইদের হাতেই নিজের প্রান দিয়ে তাই একদিন নির্মম ও কদর্য ভাবে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন তিনি।
তবুও পড়ে দেখুন, … এই হাজার মিথ্যের মাঝেও লুকিয়ে আছে বহু নির্ভেজাল সত্য। আর তা আবিষ্কার করে নিজের মনে গেঁথে রাখার জন্যে সামান্য পড়াশুনার মাধ্যমে একটু পরিশ্রম যে না করলেই নয়…।)
জিন্নাহ সাহেব ১৬ আগস্ট তারিখে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ ঘোষণা করলেন। তিনি বিবৃতির মারফত ঘোষণা করেছিলেন শান্তিপূর্ণভাবে এই দিবস পালন করতে। ব্রিটিশ সরকার ও ক্যাবিনেট মিশনকে তিনি এটা দেখাতে চেয়েছিলেন যে, ভারতবর্ষের দশ কোটি মুসলমান পাকিস্তান দাবি আদায় করতে বদ্ধপরিকর। কোনো রকম বাধাই তারা মানবে না। কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার নেতারা এই ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’, তাদের বিরুদ্ধে ঘোষণা করা হয়েছে বলে বিবৃতি দিতে শুরু করলেন।
আমাদের আবার ডাক পড়ল এই দিনটা সুষ্ঠুভাবে পালন করার জন্য। হাশিম সাহেব আমাদের নিয়ে সভা করলেন। আমাদের বললেন, ‘তোমাদের মহল্লায় মহল্লায় যেতে হবে, হিন্দু মহল্লায়ও তোমরা যাবে। তোমরা বলবে, আমাদের এই সংগ্রাম হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে, আসুন আমরা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এই দিনটা পালন করি।’ আমরা গাড়িতে মাইক লাগিয়ে বের হয়ে পড়লাম। হিন্দু মহল্লায় ও মুসলমান মহল্লায় সমানে প্রপাগান্ডা শুরু করলাম। অন্য কোনো কথা নাই, ‘পাকিস্তান’ আমাদের দাবি। এই দাবি হিন্দুর বিরুদ্ধে নয়, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে। ফরোয়ার্ড ব্লকের কিছু নেতা আমাদের বক্তৃতা ও বিবৃতি শুনে মুসলিম লীগ অফিসে এলেন এবং এই দিনটা যাতে শান্তিপূর্ণভাবে হিন্দু-মুসলমান এক হয়ে পালন করা যায় তার প্রস্তাব দিলেন। আমরা রাজি হলাম। কিন্তু হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসের প্রপাগান্ডার কাছে তারা টিকতে পারল না। হিন্দু সম্প্রদায়কে বুঝিয়ে দিল এটা হিন্দুদের বিরুদ্ধে।
সোহরাওয়ার্দী সাহেব তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী। তিনিও বলে দিলেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে যেন এই দিনটা পালন করা হয়। কোনো গোলমাল হলে মুসলিম লীগ সরকারের বদনাম হবে।’ তিনি ১৬ই আগস্ট সরকারি ছুটি ঘোষণা করলেন। এতে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা আরও ক্ষেপে গেল।
১৫ই আগস্ট কে কোথায়, কোন এরিয়ায় থাকবে ঠিক হয়ে গেল। ১৬ই আগস্ট কলকাতার গড়ের মাঠে সভা হবে। সমস্ত এরিয়া থেকে শোভাযাত্রা করে জনসাধারণ আসবে। কলকাতার মুসলমান ছাত্ররা ইসলামিয়া কলেজে সকাল দশটায় জড়ো হবে। আমার উপর ভার দেওয়া হল ইসলামিয়া কলেজে থাকতে। শুধু সকাল সাতটায় আমরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব মুসলিম লীগের পতাকা উত্তোলন করতে। আমি ও নূরুদ্দিন সাইকেলে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত হলাম। পতাকা উত্তোলন করলাম। কেউই আমাদের বাধা দিল না। আমরা চলে আসার পরে পতাকা নামিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল শুনেছিলাম। আমরা কলেজ স্ট্রিট থেকে বউবাজার হয়ে আবার ইসলামিয়া কলেজে ফিরে এলাম। কলেজের দরজা ও হল খুলে দিলাম। আর যদি আধা ঘণ্টা দেরি করে আমরা বউবাজার হয়ে আসতাম তবে আমার ও নূরুদ্দিনের লাশও আর কেউ খুঁজে পেত না। ভাবসাব যে খারাপ আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যখন ফিরে আসি। নূরুদ্দিন আমাকে কলেজে রেখে লীগ অফিসে চলে গেল। বলে গেল, শীঘ্রই ফিরে আসবে।
বেকার হোস্টেল থেকে মাত্র কয়েকজন কর্মী এসে পৌঁছেছে। আমি ওদের সভাকক্ষ খুলে টেবিল চেয়ার ঠিক করতে বললাম। কয়েকজন মুসলিম ছাত্রী মন্নুজান হোস্টেল থেকে ইসলামিয়া কলেজে এসে পৌঁছেছেন। এরা সকলেই মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। এরা ইসলামিয়া কলেজে পৌঁছার কয়েক মিনিটের মধ্যে দেখা গেল কয়েকজন ছাত্র রক্তাক্ত দেহে কোনো মতে ছুটে এসে ইসলামিয়া কলেজে পৌঁছেছে। কারও পিঠে ছোরার আঘাত, কারও মাথা ফেটে গেছে। কী যে করব কিছুই বুঝতে পারছি না। কারণ, এ জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। মেয়েরা এগিয়ে এসে বললেন, ‘যারা জখম হয়েছে, তাদের আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। পানির বন্দোবস্ত করেন।’ কোথায় এরা কাপড় পাবে ব্যান্ডেজ করতে? যার যার ওড়না ছিঁড়ে শাড়ি কেটে ব্যান্ডেজ করতে শুরু করল। কাছেই হোস্টেল, তাড়াতাড়ি খবর দিলাম। এদের ব্যান্ডেজ করেই একজন পরিচিত ডাক্তার ছিলেন তাঁর বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে শুরু করলাম।
একজন ছাত্র বলল, দল বেঁধে আসরে হিন্দুরা আক্রমণ করছে না, তবে একজন দু’জন পেলেই আক্রমণ করছে। আরও খবর এল রিপন কলেজে ছাত্ররা পতাকা উত্তোলন করতে গেলে তাদের উপর আক্রমণ হয়েছে।
ইসলামিয়া কলেজেরে কাছেই সুরেন ব্যানার্জি রোড, তারপরেই ধর্মতলা ও ওয়েলিংটন স্কয়ারের জংশন। এখানে সকলেই প্রায় হিন্দু বাসিন্দা। আমাদের কাছে খবর এল, ওয়েলিংটন স্কোয়ারের মসজিদে আক্রমণ হয়েছে। ইসলামিয়া কলেজের দিকে হিন্দুরা এগিয়ে আসছে। কয়েকজন ছাত্রকে ছাত্রীদের কাছে রেখে, আমরা চল্লিশ পঞ্চাশজন ছাত্র প্রায় খালি হাতেই ধর্মতলা মোড় পর্যন্ত গেলাম। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা কাকে এ ধারণাও আমার ভাল ছিল না। দেখি শত শত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক মসজিদ আক্রমণ করছে। মৌলভী সাহেব পালিয়ে আসছেন আমাদের দিকে। তাঁর পিছে ছুটে আসছে একদল লোকট লাঠি ও তলোয়ার হাতে। পাশেই মুসলমানদের কয়েকটা দোকান ছিল। কয়েকজন লোক কিছু লাঠি নিয়ে আমাদের পাশে দাঁড়াল। আমাদের মধ্য থেকে কয়েকজন ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ দিতে শুরু করল। দেখতে দেখতে অনেক লোক জমা হয়ে গেল। হিন্দুরা আমাদের সামনা সামনি এসে পড়েছে। বাধা দেওয়া ছাড়া উপায় নাই। ইট পাটকেল যে যা পেল তাই নিয়ে আক্রমণের মোকাবেলা করে গেল। আমরা সব মিলে দেড় শত লোকের বেশি হব না। কে যেন পিছন থেকে এসে আত্মরক্ষার আমাদের কয়েকখানা লাঠি দিল। এর পূর্বে শুধু ইট দিয়ে মারামারি চলছিল। এর মধ্যে একটা বিরাট শোভাযাত্রা এসে পৌঁছল। এদের কয়েক জায়গায় বাধা দিয়েছে, রুখতে পারে নাই। তাদের সকলের হাতেই লাঠি। এরা এসে আমাদের সঙ্গে যোগদান করল। কয়েক মিনিটের জন্য হিন্দুরা ফিরে গেল, আমরাও ফিরে এলাম। পুলিশ কয়েকবার এসে এর মধ্যে কাঁদানো গ্যাস ছেড়ে চলে গেছে। পুলিশ টহল দিচ্ছে। এখন সমস্ত কলকাতায় হাতাহাতি মারামারি চলছে। মুসলমানরা মোটেই দাঙ্গার জন্য প্রস্তুত ছিল না, একথা আমি বলতে পারি।
আমরা রওনা করলাম গড়ের মাঠের দিকে। এমনিই আমাদের দেরি হয়ে গেছে। লাখ লাখ লোক সভা উপস্থিত। কালীঘাট, ভবানীপুর, হ্যারিসন রোড, বড়বাজার সকল জায়গায় শোভাযাত্রার উপর আক্রমণ হয়েছে। শহীদ সাহেব বক্তৃতা করলেন এবং তাড়াতাড়ি সকলকে বাড়ি ফিরে যেতে হুকুম দিলেন। কিন্তু যাদের বাড়ি বা মহল্লা হিন্দু এরিয়ার মধ্যে তারা কোথায় যাবে? মুসলিম লীগ অফিস লোকে লোকারণ্য। কলকাতা সিটি মুসলিম লীগ অফিসেরও একই অবস্থা। বহু লোক জাকারিয়া স্ট্রিটে চলে গেল। ওয়েলেসলী, পার্ক সার্কাস, বেনিয়া পুকুর এরিয়া মুসলমানদের এরিয়া বলা চলে। বহু জখম হওয়া লোক এসেছে; তাদের পাঠাতে হয়েছে মেডিকেল কলেজ, ক্যাম্বেল ও ইসলামিক হসপিটালে। মিনিটে মিনিটে টেলিফোন আসছে, শুধু একই কথা, ‘আমাদের বাঁচাও, আমরা আটকা পড়ে আছি। রাতেই আমরা ছেলেমেয়ে নিয়ে শেষ হয়ে যাব।’ কয়েকজন ফোনের কাছে বসে আছে, শুধু টেলিফোন নাম্বার ও ঠিকানা লিখে রাখবার জন্য।
লীগ অফিস রিফিউজি ক্যাম্প হয়ে গেছে, ইসলামিয়া কলেজও খুলে দেওয়া হয়েছে। কলকাতা মাদ্রাসা যখন খুলতে যাই, তখন দারোয়ান কিছুতেই খুলতে চাইছে না। আমি দৌড়ে প্রিন্সিপাল সাহেবের কাছে গেলে তিনি নিজেই এসে হুকুম দিলেন দরজা খুলে দিতে। আশেপাশে থেকে কিছু লোক কিছু কিছু খবর দিতে লাগল। বেকার হোস্টেল, ইলিয়ট হোস্টেল পূর্বেই ভরে গেছে।
এখন চিন্তা হল টেইলর হোস্টেলের ছেলেদের কি করে বাঁচাই। কোন কিছুই জোগাড় হচ্ছে না। কিছু ছাত্র দুপুরে চলে এসেছে। কিছু আটকা পড়েছে। বিল্ডিংটা এমনভাবে ছিল যে, একটা মাত্র গেট। চারপাশে হিন্দু বাড়ি, আগুন দিলে সমস্ত হিন্দু মহল্লা শেষ হয়ে যাবে। রাতে কয়েকবার গেট ভাঙবার চেষ্টা করেছে, পারে নাই। সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে ধরতে পারছি না। ফোন করলেই খবর পাই লালবাজার আছেন। লালবাজার পুলিশ হেডকোয়ার্টার। নূরুদ্দিন অনেক রাতে একটা বড় গাড়ি ও কিছু পুলিশ জোগাড় করে তাদের উদ্ধার করে আনার ব্যবস্থা করেছিল। অনেক হিন্দু তালতলায়, ওয়েলেসলী এরিয়ায় ছিল। তাদের মধ্যে কিছু লোক গোপনে আমাদের সাহায্য চাইল। অনেক কষ্টে কিছু পরিবারকে আমরা হিন্দু এরিয়ায় পাঠাতে সক্ষম হলাম, বিপদ মাথায় নিয়ে। বেকার হোস্টেলের আশেপাশে কিছু কিছু হিন্দু পরিবার ছিল, তাদেরও রক্ষা করা গিয়েছিল। এদের সুরেন ব্যানার্জি রোডে একবার পৌঁছে দিতে পারলেই হয়।
আমি নিজেও খুব চিন্তাযুক্ত ছিলাম। কারণ, আমরা ছয় ভাইবোনের মধ্যে পাঁচজনই তখন কলকাতা ও শ্রীরামপুরে। আমার মেজো বোনের জন্য চিন্তা নাই, কারণ সে বেনিয়া পুকুরে আছে। সেখানে এক বোন বেড়াতে এসেছে। এক বোন শ্রীমামপুরে ছিল। একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের ম্যাট্রিক পড়ে। একেবারে ছেলে মানুষ। একবার মেজোজনের বাড়ি, একবার আমার ছোটবোনের বাড়ি এবং মাঝে মাঝে আমার কাছে বেড়িয়ে বেড়ায়। কারো কথা বেশি শোনে না। খুবই দুষ্ট ছিল ছোটবেলায়। নিশ্চয়ই গড়ের মাঠে এসেছিল। আমার কাছে ফিরে আসে নাই। বেঁচে আছে কি না কে জানে।
শ্রীরামপুরের অবস্থা খুবই খারাপ। যে পাড়ায় আমার বোন থাকে, সে পাড়ায় মাত্র দুইটা ফ্যামিলি মুসলমান। কলকাতা শহরে শুধু মরা মানুষের লাশ বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে। মহল্লার পর মহল্লা আগুনে পুড়ে গিয়েছে। এক ভয়াবহ দৃশ্য! মানুষ মানুষকে এইভাবে হত্যা করতে পারে, চিন্তা করতেও ভয় হয়। লেডী ব্র্যাবোর্ন কলেজে রিফিউজিদের থাকার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। দোতলায় মেয়েরা, আর নিচে পুরুষরা। কর্মীদের ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। আমাকেও মাঝে মাঝে থাকতে হয়। মুসলমানদের উদ্ধার করার কাজও করতে হচ্ছে। দু’এক জায়গায় উদ্ধার করতে যেয়ে আক্রান্তও হয়েছিলাম। আমরা হিন্দুদেরও উদ্ধার করে হিন্দু মহল্লায় পাঠাতে সাহায্য করেছি। মনে হয়েছে, মানুষ তার মানবতা হারিয়ে পশুতে পরিণত হয়েছে। প্রথম দিন ১৬ই আগস্ট মুসলমানরা ভীষণভাবে মার খেয়েছে। পরের দিন মুসলমারা হিন্দুদের ভীষণভাবে মেরেছে। পরে হাসপাতালের হিসাবে সেটা দেখা গিয়েছে।
এদিকে হোস্টেলগুলিতে চাউল, আটা ফুরিয়ে গিয়েছে। কোন দোকান কেউ খোলে না, লুট হয়ে যাবার ভয়েতে। শহীদ সাহেবের কাছে গেলাম। কি কর যায়? শহীদ সাহেব বললেন, “নবাবজাদা নসরুল্লাহকে (ঢাকা নবাবা হাবিবুল্লাহ সাহেবের ছোট ভাই, খুব অমায়িক লোক ছিলেন, শহীদ সাহেবের ভক্ত ডেপুটি চিফ হুইপ ছিলেন) ভার দিয়েছি, তার সাথে দেখা কর।” আমরা তাঁর কাছে ছুটলাম। তিনি আমাদের নিয়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে গেলেন এবং বললেন, “চাউল এখানে রাখা হয়েছে তোমরা নেবার বন্দোবস্ত কর। আমাদের কাছে গাড়ি নাই। মিলিটারি নিয়ে গিয়েছে প্রায় সমস্ত গাড়ি। তবে দেরি করলে পরে গাড়ির বন্দোবস্ত করা যাবে।” আমরা ঠেলাগাড়ি আনলাম, কিন্তু ঠেলবে কে? আমি নূরুদ্দিন ও নূরুল হুদা (এখন ডিআইটির ইঞ্জিনিয়ার) এই তিনজনে ঠেলাগাড়িতে চাউল বোঝাই করে ঠেলতে শুরু করলাম। নূরুদ্দিন সাহেব তো ‘তালপাতার সেপাই’- শরীরে একটুও বল নাই। আমরা তিনজনে ঠেলাগাড়ি করে বেকার হোস্টেল, ইলিয়ট হোস্টেলে চাউল পৌঁছে দিলাম। এখন কারমাইকেল হোস্টেলে কি করে পৌঁছাই? অনেক দূর, হিন্দু মহল্লা পার হয়ে যেতে হবে। ঠেলাগাড়িতে পৌঁছান সম্পূর্ণ অসম্ভব। নূরুদ্দিন চেষ্টা করে একটা ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি জোগাড় করে আনল। আমরা তিনজন কিছু চাল নিয়ে কারমাইকেল হোস্টেলে পৌঁছে ফিরে আসলাম।
শ্রীরামপুরে কোনো গোলমাল হয় নাই শুনলাম, কিন্তু নাসের কোথায়? লোক পাঠালাম শ্রীরামপুরের খবর আনতে। দাঙ্গা ও লুটতরাজ একটু বন্ধ হয়েছে। নাসের কলকাতায় এসেছিল ১৬ই আগস্ট। হ্যারিসন রোডে এসে বিপদে পড়ে। তারপর একটা এ্যাম্বুলেন্স গাড়িতে উঠে জীবনটা বাঁচায়। নাসেরের একটা ছোটকালে টাইফয়েড হয়ে খোঁড়া গয়ে গিয়েছিল। পা টেনে টেনে হাঁটতে হয়। সেই পা দেখিয়ে এ্যাম্বুলেন্সে উঠে পড়ে। দিনভর এ্যাম্বুলেন্সে থাকে, সন্ধ্যায় হাওড়া থেকে ট্রেনে উঠে শ্রীরামপুর যায়। ট্রেনে তিন ঘণ্টা লাগে। কয়েকবার ট্রেনে আক্রমণ হয়েছে। কোনোমতে বেঁচে গিয়েছে। একটা কথা সত্য, অনেক হিন্দু মুসলমানদের রক্ষা করতে যেয়ে বিপদে পড়েছে। জীবনও হারিয়েছে। আমি নিজেই এর প্রমাণ পেয়েছি। মুসলিম লীগ অফিসে যেসব টেলিফোন আসত, তার মধ্যে বহু টেলিফোন হিন্দুরাই করেছে। তাদের বাড়িতে মুসলমানদের আশ্রয় দিয়েছে, শীঘ্রই এদের নিয়ে যেতে বলেছে, নতুবা এরাও মরবে, আশ্রিত মুসলমানরাও মরবে।
একদল লোককে দেখেছি দাঙ্গাহাঙ্গামার ধার ধারে না। দোকান ভাঙছে, লুট করছে, আর কোনো কাজ নাই। একজনকে বাধা দিতে যেয়ে বিপদে পড়েছিলাম। আমাকে আক্রমণ করে বসেছিল। কারফিউ জারি হয়েছে, রাতে কোথাও যাবার উপায় নাই। সন্ধ্যার পর কোন লোক রাস্তায় বের হলে রক্ষা নাই। কোন কথা নাই, দেখামাত্র গুলি। মিলিটারি গুলি করে মেরে ফেলে দেয়। এমনকি জানালা খোলা থাকলেও গুলি করে। ভোরবেলা দেখা যেত অনেক লোক রাস্তায় গুলি খেয়ে মরে পড়ে আছে। কোনো কথা নেই শুধু গুলি।
একবার আমার ও সিলেটের মোয়াজ্জেম চৌধুরীর (এখন কনভেনশন মুসলিম লীগের এমএনএ) উপর ভার পড়েছে রাতে পার্ক সার্কাস ও বালিগঞ্জের মাঝে একটা মুসলমান বস্তি আছে- প্রত্যেক রাতেই হিন্দুরা সেখানে আক্রমণ করে- তাদের পাহারা দেওয়ার জন্য। কারণ, বন্দুক চালানোর লোকের নাকি অভাব। আমরা গুলি ছুঁড়তে জানতাম।
সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময় খবর এল মিল্লাত অফিস থেকে ঐ এলাকায় যাবার জন্য। আমরা রওয়ানা করে তাড়াতাড়ি ছুটতে লাগলাম, কোন গাড়ি নাই। আমাদের পায়ে হেঁটেই পৌঁছাতে হবে। কেবলমাত্র লোয়ার সার্কুলার রোড পার হয়ে আমরা ছোট রাস্তা ঢুকেছি, অমনিই কারফিউর সময় হয়ে গেছে। কবরস্থানের পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। গাড়ির শব্দ পেলেই আমরা লুকাই, আবার হাঁটি। অনেক কষ্টে পার্ক সার্কাস ময়দানের পিছনে এলাম। ময়দান পাই হই কি করে? অনেক্ষণ ধরে চেষ্টার পর ময়দানের পিছন দিয়ে ‘সওগাত’ প্রেসের মালিক ও সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সাহেবের বাড়ির কাছে পৌঁছলাম। সেখান থেকে আর একটা রাস্তা পার হয়ে এক বন্ধুর বাড়িতে ঢুকলাম। কিন্তু এখন কি করি? বন্ধুর বাবা ও মা আমাদের কিছুতেই বার হতে দিতে রাজি হলেন না। কারণ, রাস্তার মোড়েই মিলিটারি পাহারা দিচ্ছে। তারা ছায়া দেখলেও গুলি করে। উপায় নাই। রাতে আমাদের সেখানেই কাটাতে হল। আমরা জায়গামত পৌঁছাতে পারলাম না। যদিও সে রাতে কোনো গোলমাল হয় নাই। প্রায় মাইল দেড়েক পথ অতিক্রম করেছিলাম। যে কোনো সময় গুলি খেয়ে মরতে পারতাম।
পার্ক সার্কাস এরিয়ায় বিচারপতি সিদ্দিকী, জনাব আবদুর রশিদ, জনাব তোফাজ্জল আলী (ভূতপূর্ব মন্ত্রী), আরও অনেকে ডিফেন্স পার্টির নেতৃত্ব দিতেন। আমরা ছিলাম স্বেচ্ছাসেবক। শিয়ালদহ ও হাওড়া স্টেশনে হিন্দু ও মুসলমানদের ক্যাম্প করা হয়েছিল যাতে বাইরে থেকে কেউ এসেই হিন্দু বা মুসলমান মহল্লায় না যায়। কারণ মুসলমানরা হিন্দুদের মহল্লায় এবং হিন্দুরা মুসলমান মহল্লায় গেলে আর রক্ষা নাই। কলকাতায় মহিলাদের মধ্যে জনাব সোহরাওয়ার্দীর মেয়ে মিসেস সোলায়মান, নবাবজাদা নসরুল্লাহর মেয়ে ইফফাত নসরুল্লাহ, বেগম আক্তার আতাহার আলী, সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদিকা নূরজাহান বেগম, বেগম রশিদ, রোকেয়া কবীর এবং মন্নুজান হোস্টেলের ও ব্র্যাবোর্ন কলেজের মেয়েরা খুবই পরিশ্রম করেছেন। রাতদিন রিফিউজি সেন্টারে এরা কাজ করতেন মেয়েদের ভিতর, আমাদের করতে হতো পুরুষদের মধ্যে। রাতে অসুবিধা হতো, তবুও হাজেরা মাহমুদ আলী, হালিমা নুরুদ্দিন, আরও কয়েকজনকে সারারাত পরিশ্রম করতে দেখেছি।
কলকাতার অবস্থা খুবই ভয়াবহ হয়ে গেছে। মুসলমানরা মুসলমান মহল্লায় চলে এসেছে। হিন্দুরা হিন্দু মহল্লায় চলে গিয়েছে। বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা করার জায়গা ছিল একমাত্র অ্যাসপ্লানেডে, যাকে আমরা চৌরঙ্গী বলতাম। এখন অবস্থা হয়েছে আরও খারাপ। বেশ কিছুদিন কোনো গোলমাল নাই। হঠাৎ এক জায়গায় সামান্য গোলমাল আর ছোরা মারামারি শুরু হয়ে গেল। শহীদ সাহেব সমস্ত রাতদিন পরিশ্রম করছেন শান্তি রক্ষা করার জন্য। কলকাতায় চৌদ্দ-পনের শত পুলিশ বাহিনীর মধ্যে মাত্র পঞ্চাশ-ষাটজন মুসলমান, অফিসারদের অবস্থাও প্রায় সেই রকম। শহীদ সাহেব লীগ সরকার চালাবেন কী করে? তিনি আরও এক হাজার মুসলমানকে পুলিশ বাহিনীতে ভর্তি করতে চাইলে তদানীন্তন ইংরেজ গভর্নর আপত্তি তুলেছিলেন। শহীদ সাহেব পদত্যাগের হুমকি দিলে তিনি রাজি হন। পাঞ্জাব থেকে যুদ্ধফেরত মিলিটারি লোকদের এনে ভর্তি করলেন। এতে ভীষণ হৈচৈ পড়ে গেল। কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার কাগজগুলি হৈচৈ বেশি করল।
কলকাতার দাঙ্গা বন্ধ হতে না হতেই আবার দাঙ্গা শুরু হল নোয়াখালীতে। মুসলমানরা সেখানে হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুট করল এবং আগুন লাগিয়ে দিল। ঢাকায় তো দাঙ্গা লেগেই আছে। এর প্রতিক্রিয়ায় শুরু হল বিহারে ভয়াবহ দাঙ্গা। বিহার প্রদেশের বিভিন্ন জেলায় মুসলমানদের উপর প্ল্যান করে আক্রমণ হয়েছিল। এতে অনেক লোক মারা যায়, বহু ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়।
দাঙ্গা শুরু হওয়ার তিন দিন পরেই আমরা রওয়ানা করলাম পাটনায়। বহু স্বেচ্ছাসেবক রওয়ানা হয়ে গিয়েছে। অনেক ডাক্তারও কলকাতা থেকে গিয়েছিল। আমার কলকাতার এক সহকর্মী মিস্টার ইয়াকুব, খুব ভালো ফটোগ্রাফার, সে ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছে। ঘুরে ঘুরে অনেক ফটো তুলেছিল বিহার থেকে। জহিরুদ্দিন, নূরুদ্দিন ও আমি যেদিন যাই সেদিন জনাব ফজলুল হক সাহেবও পাটনায় রওনা দিলেন। শহীদ সাহেব পাটনায় মুসলিম লীগ নেতাদের খবর দিলেন যে কোন সাহায্য প্রয়োজন হলে বেঙ্গল সরকার দিতে রাজি আছে। বিহার সরকারকেও তিনি একথা জানিয়ে দিলেন। আমরা যখন পাটনায় নামলাম, অবস্থা দেখে রীতিমতো ভয় লাগতে লাগল। কাউকেও চিনি না, কোথা থেকে কোথায় যাই! তবে জহির পাটনায় কয়েকবার গিয়েছে। আমরা মিস্টার ইউনুস, মন্ত্রী বিহার সরকারের, তাঁর একটা হোটেল আছে- ‘গ্রান্ড হোটেল’, সেই হোটেলে গিয়ে হাজির হলাম। সেখানে মওলানা রাগীব আহসান সাহেব অফিস খুলেছেন, বেঙ্গল মুসলিম লীগের তরফ থেকে। আবদুর রব নিশতার সাহেব সেদিন পাটনায় আসলেন। আমরা একসাথে কনফারেন্স করলাম, কী করা যায়! তিন দিন পরে নূরুদ্দিন কলকাতায় চলে গেল। জহির পাটনায় রইল। আমরা বললাম, বিহারে আমরা কি সাহায্য করতে পারি? শহীদ সাহেব বলেছেন, ট্রেন ভরে আসানসোলে রিফিউজিদের পৌঁছে দিলে বাংলা সরকার তাদের সকল দায়িত্ব নিতে রাজি আছে। জনাব আকমল (আইসিএস) আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কেমন করে শহীদ সাহেবের পক্ষ থেকে কথা বলতে পারেন?” আমার অল্প বয়স দেখে তিনি বিশ্বাস করতেই চাইলেন না যে শহীদ সাহেব আমার সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করতে পারেন। আমি তাঁকে বললাম, “আমি শহীদ সাহেবের মতামত জানি এবং তাঁর পক্ষ থেকে কথাও কিছু বলতে পারি।” অনেকে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। আমি শহীদ সাহেবের ফোন নাম্বার দিয়ে বললাম, “টেলিফোন করে দেখতে পারেন।”
সকালবেলা আবার বসবার কথা। আকমল সাহেব আমাকে বললেন, “আজ থেকেই আমরা আসানসোলে লোক পাঠাব।” যে সমস্ত লোক গ্রাম থেকে শহরে আসছে তাদের জায়গা দেওয়া একেবারেই অসম্ভব। আঞ্জুমানে ইসলামিয়া ও আর যে সমস্ত জায়গা করা হয়েছিল সেখানে আর জায়গা নাই। সীমান্ত থেকে পীর মানকী শরীফের দল, আলীগড় থেকে আমাদের বন্ধু মোস্তফা ও সৈয়দ আহমেদ আলীসহ বহু ছাত্রকর্মী এসেছে। কলকাতা থেকে ছাত্র, ডাক্তার, ন্যাশনাল গার্ড মিলে প্রায় হাজার লোক পাটনায় জমা হয়েছে। দূর দূর গ্রাম থেকে দুর্গতদের উদ্ধার করে আনা হচ্ছে। আমি হাজার খানেক রিফিউজি নিয়ে রওয়ানা করলাম আসানসোলের দিকে। আসানসোল মুসলিম লীগ নেতা মওলানা ইয়াসিন সাহেবকে টেলিগ্রাম করা হয়েছে। তিনি দুইখানা ট্রাক ও কিছু ভলানটিয়ার নিয়ে স্টেশনে হাজির ছিলেন। লোকগুলিকে প্লাটফর্মেই রাখা হল। অনেক লোক জখম ছিল। নূরুদ্দিন শহীদ সাহেবকে পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলেছে। পাটনা থেকেও খবর দেওয়া হয়েছে শহীদ সাহেবকে। তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও এসডিওকে হুকুম দিয়েছেন, এদের জায়গা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করতে।
নূরুদ্দিন কলকাতা থেকে আমাকে সাহায্য করবার জন্য কিছু স্বেচ্ছাসেবক ও কিছু ডাক্তার পাঠিয়েছে। এসডিও ছিলেন একজন ইউরোপিয়ান। তিনি যুবক ও খুবই ভদ্রলোক। শহীদ সাহেব হুকুম দিয়েছেন, যে সমস্ত ব্যারাক যুদ্ধের সময় করা হয়েছিল সৈন্যদের থাকবার জন্য সেগুলির মধ্যে রিফিউজিদের রাখতে। সরকার থেকে খাবার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। তার বিলি বণ্টনের জন্য এসডিও, আসানসোল মুসলিম লীগ নেতারা ও আমি একটা বৈঠক করলাম। প্রথম ক্যাম্প খোলা হল, ‘নিগাহ’ নামে একটা ছোট্ট গুদামে। সেখানে হাজার খানেক লোক ধরবে। পরে কান্দুলিয়া ক্যাম্প খোলা হল। এতে প্রায় দশ হাজার লোকের জায়গা হবে। আমি এই ক্যাম্পের নাম দিলাম ‘হিজরতগঞ্জ’। মওলানা ইয়াসিন নামটা গ্রহণ করলেন এবং খুশি হলেন। আসানসোল স্টেশনে ও পরে রাণীগঞ্জ স্টেশনে মোহাজেরদের নামানো হত, পরে ট্রাকভরে ক্যাম্পগুলিতে নিয়ে আসা হত। আমার সাথে সকল সময়ের জন্য কাজ করতেন মওলানা ওয়াহিদ সাহেব। আমরা একসাথে পড়তাম, এখন তিনি শাহজাদপুরের পীর সাহেব।
আমাদের খাওয়া-দাওয়ার কোনো বন্দোবস্ত ছিল না। মোহারিজরদের জন্য যা পাক করতাম, তার থেকেই কিছু খেয়ে নিতাম। দোকানপাট চিল না। শত শত লোক রোজই আসছে। দিনে একবেলার বেশি খেতে দিতে পারতাম না। একটা হাসপাতাল করেছিলাম। ময়মনসিংহের ডা. আবদুল হামিদ এবং গফরগাঁওয়ের ডা. হজরত আলী এই হাসপাতালে কাজ করতেন। আসানসোলের এসডিও মিস্টার রোজ চার পাঁচ দিন পরে একজন বৃদ্ধা মেম সাহেবকে নিয়ে আসলেন। তিনি আমাদের কাজের প্ল্যান করে দিয়ে সাহায্য করবেন। কারণ, এই ভদ্রমহিলা যুদ্ধের সময় ব্রহ্মদেশ থেকে যখন লোক পালিয়ে আসিছল তখন সরকারি ক্যাম্পের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি যে প্ল্যান দিলেন, তাতে কাজের সুবিধাই হল।
ছয়-সাতদিন পর, বাংলা সরকার জনাব সলিমুল্লাহ ফাহমীকে বিহার মোহাজেরদের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী নিয়োগ করলেন। তিনি আসানসোলে এসে আমাদের খোঁজ করেন। পরে ময়রা ক্যাম্পে এসে আমাকে পেলেন। তিনি ক্যাম্পগুলিকে সরকারের তত্ত্বাবধানে নিয়ে গেলেন। মুসলিম লীগ স্বেচ্ছাসেবকরাও কাজ করলেন। আমি ও সলিমুল্লাহ সাহেব পরামর্শ করে মোহাজেরদের থেকে সুপারিনটেনডেন্ট, এসিসট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট, রেশন ইনচার্জ, দারোয়ান ও অন্যান্য কর্মজচারী নিযুক্ত করলাম।
এক জায়গায় খানা পাকানো সম্ভবপর হচ্ছে না। রেশন কার্ড করে প্রত্যেক ফ্যামিলিকে বিনা পয়সায় চাল, জ্বালানি কাঠ, মরিচ, পিঁয়াজ সবকিছুই সাত দিনের জন্য দিয়ে দেওয়া হবে। শুধু মাংস একদিন পর পর দেওয়া হবে। মোহাজেররা এই বন্দোবস্তে খুশি হলেন। এই সমস্ত ঠিক করতে এক মাস হয়ে গেল। এই সময় বিহার থেকে জাফর ইমাম সাহেব মোহাজেরদের বাংলাদেশের লোকেরা কেমন রেখেছে দেখবার জন্য এলেন। আমার সাথেও দেখা করলেন, আমাদের অফিসে। আমরা একটা অফিস খুলেছিলাম, তার পাশেই আমরা থাকতাম। আমাদের পাকের বন্দোবস্তও হয়েছিল ঐখানেই। আমাদের সংগঠন এবং ব্যবস্থাপনা দেখে তিনি আমাকে ও আমাদেরে সহকর্মীদের অনেক ধন্যবাদ দিয়েছিলেন। মোহাজেরদের সাথে দেখা করে তাদের সুবিধা ও অসুবিধার কথা করছিলেন।
পরে ময়রা ও মাধাইগঞ্জে ক্যাম্প খুললাম। এই দুই ক্যাম্পর প্রায় দশ হাজার মোহাজের দেওয়া হয়েছিল। অনেক শিক্ষিত ভদ্র ফ্যামিলিও এসেছিলেন। মোহাজেরদের আর আসানসোল এরিয়ায় জায়গা দেওয়া সম্ভব হবে না। আমরা এর পরে বিষ্ণুপুর, অন্ডাল, বর্ধমানেও কিছু কিছু মোহাজের পাঠালাম। আমার সাথে যে সমস্ত কর্মী ছিল, আহার নিদ্রার অভাব ও কাজের চাপে প্রায় সকলেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তাই অনেককে পূর্বেই কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছি। আমারও জ্বর হয়ে গিয়েছিল। এই সময়ে মোহাম্মদ আলী ও এ. এফ.এম আবদুর রহমান মন্ত্রী ছিলেন। তাঁরা বেগম সোলায়মান, ইফফাত নসরুল্লাহ ও আরও কয়েকজন কর্মচারীসহ আসানসোলে আসেন। আমাকে পূর্বেই খবর পাঠিয়েছিল। আমিও আসানসোলে তাঁদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তাঁদের নিয়ে ক্যাম্পগুলি দেখান হয়েছিল। সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাঁদের সাথেই কলকাতা রওয়ানা হয়ে আসতে বাধ্য হলাম। বেগম সোলায়মান আমার শরীর ও চেহারার অবস্থা দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। দেড় মাস পরে আমি কলকাতায় হাজির হলাম অসুস্থ শরীর নিয়ে।
সূত্র: শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী ৬৩-৭১ পৃষ্ঠা
শেখ মুজিবের বর্ণনায় ছেচল্লিশের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা