বাংলাদেশে ইসলামী দলগুলোর ভোট বেড়েছে। খুলনা সিটি নির্বাচনে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন ভোট পেয়েছে ১৪ হাজার ৩৬৩ ভোট। কমিউনিস্টরা পেয়েছে দুই-আড়াইশ ভোট। ঢাকা নারায়ণগঞ্জ রংপুরের সিটি নির্বাচনে ইসলামী দলগুলোর প্রার্থীরা তৃতীয় স্থানে ছিলো। জাতীয় পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি সেখানে জামানত বাজেয়াপ্ত পর্যন্ত হয়েছিলো।… ভোটের এই হিসাবের কারণ কি?
১৯৪৭ সালের দেশভাগের আগে বাংলাদেশে (তখনকার পূর্ববঙ্গে) হিন্দু জনসংখ্যা ছিলো ২৮%। বদরুদ্দীন উমারের ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ নামক গবেষণা গন্থে লিখেছেন, দেশভাগের কারণে শ্রমিকদের একটা বড় অংশ যারা ধর্মীয় পরিচয়ে হিন্দু ছিলেন তারা ভারতে চলে যাবার কারণে পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট আন্দোলন স্তমিত হয়ে পড়ে। এর আগে পূর্ববঙ্গে কমিউনিস্টদের শক্তিশালী একটা অবস্থান ছিলো। উমারের তথ্য যে সঠিক সেটা বলাই বাহুল্য। ১৯৬৪-৬৫ সালের দিকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারের ছেলেদের বাম রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ছিলো বাস্তব সত্য। এ কারণেই ৬৫ সালের দাঙ্গায় হিন্দু পরিবারগুলোর উপর পাকিস্তানের মহানায়করা দ্বিতীয়বার একটি সুদ্ধি অভিযান চালিয়ে তাদের ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। একই সময়ে মুসলমানদের সকলেই মুসলিম লীগের রাজনীতির সমর্থক ছিলো। শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে সবাই মুসলিম জাতীয়তাবাদী ছিলো। পরবর্তীকালে এখনকার মুসলমানরা বাঙালী পরিচয়ে বৈষম্যের শিকার হবার পর বাঙালী জাতীয়তাবাদে তাদের অধিকার আদায়ে সচেতন হতে থাকে। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা এভাবেই বাড়তে থাকে। কিন্তু এখানে সেক্যুলার মুভমেন্ড ধরার কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। পাকিস্তানে ক্ষমতার লড়াইয়ে যারা নিয়োজিত ছিলো তারা সকলে ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান ছিলো। কাজেই অর্থনৈতিক রাজনৈতিক বৈষম্য ঘটছিলো জাতিগত পরিচয়ে। যেমন বাঙালী ও বেলুচরা ছিলো জাতিগত বৈষম্যের শিকার। যেকারণে এই দুই জায়গায় জাতিগত জাতীয়তাবাদ জেগে উঠে। কিন্তু বাঙালী মুসলমান মূলত মুসলিম জাতীয়তাবাদী। তাই বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরও সেটি মুসলিম দেশ হয়েছে। এখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি সবগুলোই মুসলিম জাতীয়তাবাদী দল। যেহেতু দেশের ভেতর প্রতিদ্বন্দ্বি কোন ধর্মীয় সম্প্রদায় নেই তাই তাদের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ সহসা প্রকাশিত হবার কোন চান্স থাকে না। কিন্তু বৈদেশিক নীতিতে ঠিকই মুসলিম জাতীয়তাবাদ প্রকাশিত হয় তাদের দিয়ে। এখন এই যে ইসলামী দলগুলোর ভোট বাড়ছে এটাকে এসবের সঙ্গে কিভাবে মেলানো যাবে? মুসলমান মাত্রই দুই প্রজাতির হয়ে থাকে। মুসলিম জাতীয়তাবাদী নয়ত ফান্ডামেন্ডালিস্ট মুসলিম। মুসলিম জাতীয়তাবাদী হলে রবীন্দ্র জয়ন্তীতে বিসমিল্লাহ বলে বক্তব্য শুরু করে একটা মিশ্র অনুভূতির জায়গা তৈরি করে তার নাম দেয়া যায় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। রবীন্দ্রনাথের গানকে জাতীয় সংগীত করার পর মনের ভেতর কোন খচখচানি থাকলে ভারত থেকে কবি নজরুলকে এনে নাগরিত্ব দিয়ে ‘জাতীয় কবি’ পদ দিয়ে মনের অস্বস্তি দূর করা যায়। মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে আবার ‘পাকিমনা’ বলতে আরেকটা রাজনৈতিক ক্যাটাগরি আছে। মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের এই পাকিমনা গ্রুপ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গ্রুপের সঙ্গেই ছিলো স্বাধীনতার কয়েক দশকের রাজনৈতিক ভোটযুদ্ধ। ৯০ দশকের শেষ দিকে আফগান যুদ্ধ ফেরত বাংলাদেশী মাদ্রাসার মুফতি মাওলানা যারা মুজাহিদ হিসেবে যুদ্ধ করেছিলো আফগানিস্থানে তাদের দিয়ে গঠন করা হয় দুই ধরণের খিলাফতী দল। একটা সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ইসলামী খিলাফত কায়েমের জন্য হরকাতুল জিহাদ, জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। ১৯৮৬ সালে ‘মুসলিম মিল্লাত বাহিনী’ নামের প্রথম জিহাদী দল গঠন করেন সেনা কর্মকর্তা মতিউর রহমান। তিনি আফগান ফেরত মুজাহিদদের দিয়ে সংগঠনটি গঠন করেন। পরে এই দলের সদস্যরা ফিলিস্তিনে গিয়ে ইজরাইলের বিরুদ্ধে জিহাদে অংশ গ্রহণ করে। একদিকে যেমন সশস্ত্র খিলাফতী দলগুলো গঠন করা হয় অপরদিকে প্রচলিত শাসন ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে নানা রকম ইসলামী রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়। জনগণ কখনই আওয়ামী লীগ বিএনপিকে সেক্যুলার দল বলে গ্রহণ করেনি। বরং তারা মুসলিম উম্মার সঙ্গে বাংলাদেশকে মেলবন্ধন করে রাখবেন, ঈমানআকিদার উপর রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন এমনটাই বিশ্বাস করেন। যে কারণে দুই দলেরই ভোটের আগে ইসলাম নিয়ে বড় ধরণের শোডাউন এবং প্রতিপক্ষকে ইসলাম বিরোধী হিসেবে প্রমাণ করতে দেখা যায়। পাকিস্তান ভাঙ্গার কারণে প্রবলভাবে মুসলিম মিল্লাতে বিশ্বাসী জনগণ আওয়ামী লীগকে পছন্দ করে না। এরাই মূলত বিএনপির ভোট। যে কারণে তাদের উশকে দিতে আওয়ামী লীগকে ‘হিন্দুদের দল’ বলে বিএনপি কোণঠাসা করতে চায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ যে ইসলামের প্রকৃত বন্ধু তার প্রমাণ করতে দলটি ৯৬ সাল থেকে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে গনগণের কাছে।
দেখা গেছে এদেশের মানুষ আগেও ‘ভারতের বিরুদ্ধে লং মার্চ করেছে, ‘ইজরাইল দুতাবাদ’ ঘোরাও করতে চেয়েছে, ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে অস্থির হয়েছে। সেই বিএনপি আওয়ামী ভোটাররাই ফান্ডামেন্টালিস্ট দলগুলোর উপর ঝুঁকে পড়ছে। এটার উদাহরণ এমনভাবে দেয়া যেতে পারে, আগে এলাকার যে ভাইকে দেখেছেন স্বাভাবিক জামা কাপড় পড়ে অফিস আদালত করছেন। মসজিদে গিয়ে ইহুদীদের বিরুদ্ধে লানত বর্ষণ করছেন। রোজার একমাস সেভ না করে দাড়ি রাখছেন। আবার সিনেমাতে যাচ্ছেন, বিয়েবাড়িতে গিয়ে বীয়ারও খাচ্ছেন… সেই তিনি এখন লম্বা দাড়ি রেখে পাঞ্জাবী পায়জামা ধরে হুজুর হয়ে গেছেন। এলাকার এই ভাইয়ের বিবর্তনে কি কোন মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে? ঘটেনি। তিনি একই রকম ধর্মীয় চেতনায় বিশ্বাস রাখতেন। এখন তিনি তার প্রয়োগিক প্রচেষ্টায় রত। কাজেই চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বা মুফতি ফয়জুল্লাহর ইসলামী ঐক্যজোটের ভোট বৃদ্ধি এইদেশের ৯০ ভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠদের বড় ধরণের পরিবর্তন নয়। একইভাবে কমিউনিস্টদের হজ গমন, ইসলামের দালালী, ইজরাইলের পতাকা পুড়ানো, হিন্দু নির্যাতনে চোখ বুজে থাকার পরও জনগণের প্রত্যাখান নতুন কোন মেরুকরণ নয়। এর নেপথ্য কারণ বদরুদ্দীন উমারের বইতেই আছে কেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে ধস নামল। সহজ আর পরিস্কার করে বললে এদেশে মুসলমানরা বসবাস করে। এখানে তাই কোন সেক্যুলারিজম, প্রগতিশীলতা তাদের দ্বারা সম্ভব নয়।
ইজরাইলকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চায় মুসলমানরা। কাজেই কেমন করে ফিলিস্তিন ইজরাইল শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব? ইজরাইল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়নি মডারেট মুসলিম বাংলাদেশ। কেমন করে বাংলাদেশের মত শান্তিবাদীদের কাছে ফিলিস্তিনী ইজরাইল শান্তি সম্ভবপর হবে? জিহাদী সন্ত্রাসী হামাস, কাস্মিরের জিহাদী দলগুলোকে সমর্থন জানানো উপমহাদেশীয় মুসলিমদের ৮০ ভাগই এখনো ভোট দেয় প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোকে। তাদের কিছু সংখ্যাক আস্তে আস্তে ইসলামী খিলাফতী দলগুলোর সমর্থক হয়ে পড়ছে। এতে এমন কি মৌলিক রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটছে? ওআইসি কোন চরমপন্থি জিহাদী মুসলিমদের সংগঠন নয়। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্টের জোড়ে ‘মুসলিম দেশ’ এই পরিচয়ে বিশ্বকে মুসলিম অমুসলিম সাম্প্রদায়িক পরিচয়ে বিভেদ তৈরিকারীরা আইএস তালেবানদের তালাতো ভাই মামাতো ভাই বৈ কম কিছু কি? ইসলামী দেশগুলোকে নিয়ে যে আলাদা ক্রীড়া প্রতিযোগীতা হয় বিশ্বে (কিছুদিন আগে যেটার হোস্ট ছিলো বাংলাদেশ) তাতে হিজাব পড়ে বা না পড়ে নারীরা খেলায় অংশগ্রহণ করলেও বিশ্বকে ধর্মীয় পরিচয়ে, রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ধর্মীয়ভাবে বিভেদ করে ফান্ডামেন্টালিজমকে তো এইসব মুসলিম জাতীয়তাবাদী মডারেটরাই প্রতিষ্ঠা করে দিচ্ছে। কারণ ধর্মীয় বিভেদই ফান্ডামেন্টালিজমকে সামনে টেনে আনে। তো, ইসলামী দলগুলোর ভোট বৃদ্ধি নতুন কি কথা?