একটি কাল্পনিক কথোপকথন / দেবাশিস লাহা

একটি কাল্পনিক কথোপকথন / দেবাশিস লাহা

এই যে বাবা অবলাকান্ত!  এত দিন পর কি মনে করে?

কী যে বলেন ম্যাডাম!  সশরীরে আসতে না পারলেও ফোনে তো কথা হয়!  আজ একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি। সব কথা তো ফোনে হয় না!

অনুরোধ!  দুদিন পর আমাকে ঘেরাও করতে আসছেন!  লাখ লাখ লোক জুটিয়ে ভাঙচুর করার মতলব করছেন!  এখন বলছেন অনুরোধ!  লজ্জা করে না আপনার?  এমনি কী আপনাদের বরবাদ বলি! 

কী মুশকিল! প্লিজ! মাথা ঠাণ্ডা রাখুন ম্যাডাম !  পুরোটা শুনুন! 

কী শুনব?  আপনাদের ভাঙচুরের প্ল্যান?

না, ম্যাডাম।  আমার অনুরোধটা শুনুন!  তবেই বুঝবেন! 

কী অনুরোধ?

উদোম ক্যালাবেন!

ক্যালাব?  কাকে?  আপনাকে?

সর্বনাশ করেছে!  এই বয়সে কেলানি খেলে বাঁচব নাকি!  আমাকে নয়, পাবলিককে!

পাবলিক মানে?  কোন পাবলিক?

কেন, যারা আপনাকে ঘেরাও করতে আসছে, ভাঙচুর করার মতলব করেছে। তাদের ঠেঙাবেন!

আরে দাঁড়ান, দাঁড়ান!  একটাই তো মাথা। একটু ভাল করে বুঝতে দিন। আপনারই দলের কর্মসূচী!   আপনার লোকজনই মিছিল করে আসবে।  রাস্তা অবরোধ করবে!  আর আপনিই বলছেন ওদের কেলাতে!  আপনি তো মশাই খুব ধড়িবাজ লোক! 

আবার মাথা গরম করে! সত্যি আপনার বলিহারি রাগ!  সেদিন দুলাইন কবিতাও লিখে ফেলেছি এই নিয়ে!  রাগ — আমাদের বোমে বোমে / ম্যাডামের লোমে লোমে!  শুনুন আপনার আমার যাতে ভাল হয় তার জন্যই বলা!  সামনে ঘোর বিপদ। ভাজা পার্টির প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়ছে। আরও বেশি বাড়বাড়ন্ত হলে আমাদের দুজনকেই পাওভাজি বানিয়ে ছাড়বে। পাবলিকে বলাবলি করছে ভাজাই নাকি এখন প্রধান বিরোধী দল। আপনি তো সরকারে আছেন। বুঝবেন না এই যন্ত্রণা!  তাই বলছি কেলাবেন। যত কেলাবেন বিরোধী দল হিসেবে আমাদের সম্মান এবং স্বীকৃতি ততই বাড়বে!  তাছাড়া একটু ভাবলেই বুঝবেন আমাদের মধ্যে আসলে কোনো ফারাক নেই। শুধু রঙটাই যা আলাদা। তাই আমাদের পাবলিককে উদোম  কেলিয়ে আমাদের প্রধান বিরোধী দল হতে সাহায্য করুন ম্যাডাম, প্লিজ!

কী সব উল্টোপাল্টা বকছেন!  এমনি কী আপনাদের বরবাদ বলি! কী ভেবেছেন!  আমি কী কবিতা লিখতে পারি না?  আমার পরের বইয়ের নাম কী জানেন?  দেখ বামে শিয়রে সমন।   তিরিশ চল্লিশ বছরে রাজ্যটাকে বরবাদ করে ছেড়েছেন।  আমাকে দেখে শিখুন কি করে উন্নয়ন করতে হয়।

আরে ম্যাডাম আমরাও তো এই একই উন্নয়ন করেছি। নাম আর ধরণটাই যা আলাদা। আমরা সরকারে এসে কলকারখানা তুলে দিয়েছিলাম, আপনি কারখানা বন্ধ করে ক্ষমতায় এসেছেন।আমরা ল সা গু – কে তোল্লা দিয়েছি, আপনিও দিচ্ছেন। ওরাই আমাদের নয়ণের মণি!  গ সা গু দিয়ে কিছু হবে না!  ওরা গরুরও অধম।

কারখানার ব্যাপারটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু ল সা গু,  গ সা গু!  এসব আবার কি শুরু করলেন!  দেখুন আমি এমনিতেই অংকে কাঁচা!  রাজ্যটাকে তো লোনে ডুবিয়ে গেছেন। সুদ দেব না  আসল দেব, তার হিসেব করতে করতেই লাইফ হেল হয়ে যাচ্ছে! 

জলের মত করে বুঝিয়ে দিচ্ছি, ম্যাডাম। ল সা গু হল সংখ্যালঘু রতন, আর গ সা গু হল সংখ্যাগরু ঘোঁতন!  আপনিও তো ওদের এটা ওটা দিয়ে বেশ দুধে ভাতে রেখেছেন। তামাম ভাতা দিয়ে মিত্র বর্ধন, হামাম ভাতা দিয়ে গাত্র মর্দন!  এব্যাপারে যে আপনি আমাদের ছাড়িয়ে গেছেন সেটা মানতেই হবে। তবে পথটা তো আমরাই দেখিয়েছিলাম কী বলুন!  প্লিজ একটু কেলাবেন, ম্যাডাম! 

মিষ্টার অবলাকান্ত!  এত বার করে যখন বলছেন, ফেরাই কি করে!  কিন্তু একটা ব্যাপারে খটকা লাগছে!  নির্বাচনে জেতার পরপরই যদিও বলেছিলাম বদনা নয়, বদন চাই। তবু  দুষ্টু ছেলেপেলেগুলো আপনাদের খুব একটা খারাপ কেলায় নি। সুযোগ সুবিধা পেলেই ঘুপ ঘাপ বসিয়ে দিচ্ছে। তবু আপনি সেধে কেলানি খেতে এসেছেন! 

এই যে আবার ভুল করছেন ম্যাডাম!  পাবলিক ঠেঙানিতে মাস সেন্টিমেন্ট জাগে না।  জনগণের ওসব ডাল ভাত হয়ে গেছে। পুলিশের কেলানিটাই আসল। আপনি যখন বিরোধী দলে ছিলেন, তখন কি আমরা আপনাদের কম কেলিয়েছি?  কেলিয়ে বেন্দাবন বললেও কম বলা হবে!  এমনকি, আপনার মাথা — ছি!  ঐতিহাসিক ভুল হয়ে গেছিল ম্যাডাম!  যাক let bygones be by gones!  কিন্তু এত কেলানির পরও কি আপনারা ক্ষমতায় আসতে পেরেছিলেন?  পারেন নি! বছর বছর ডাব্বা খেতেন। কিন্তু যেই পুলিশের মার পড়ল!  লাশ পড়ল!  ব্যাস আপনারা পরের নির্বাচনেই সোজা ক্ষমতায়!  ফন্দিগ্রামকে ভুললে চলবে ম্যাডাম!  ওটাই তো আসল!  দেখলেন না পাবলিক কেমন   খেপে গেল !  সব বুদ্ধজীবি রাতারাতি ঘাসজীবী! 

তাই তো!  এটা তো ভেবে দেখিনি!  ফন্দী গ্রামে তো দশ এগারজন মরেছিল। কিন্তু তার আগে আপনার দলের বরবাদরা তো শয়ে শয়ে মানুষ মেরেছে!  তবু তো আপনাদের গদিচ্যুত করা যায়নি!  ব্যাপারটা সত্যি-ই ভাবার! 

আরে ম্যাডাম, তবে আর বলছি কেন!  এর পেছনেও আমরা! 

মানে?

আরে ম্যাডাম!  গরীব, চাষা, নিম্নবিত্ত ঘরের ছেলেগুলোকে রাতারাতি শ্রেণিশত্রু বানিয়ে খতম করার ছকটা আমরাই তো বানিয়েছিলাম। একটু ভাবুন। এই পুলিশ কারা?  টাটা বিড়লার ঘরের ছেলেমেয়ে কি আর পুলিশ হয়?  পেটের ভাতের জন্যই তো ওরা পুলিশ হয়। আমরাই ওদের  ভিলেন বানিয়ে ছাড়ি! 

অবলাকান্তবাবু!  আপনি ঠিক কোন ধাতুতে গড়া বলুন তো!  নিজেই বলছেন গরীব ঘরের ছেলেপেলে পুলিশ হয়, আবার বলছেন ওরাই শ্রেণিশত্রু! 

আপনাকে নিয়ে এটাই মুশকিল!  সব স্ট্রেইট ড্রাইভে খেলেন। তাই বরদা, হরদায় চটজলদি ফেঁসে যান। আরে ম্যাডাম আমরা কি কম খেয়েছি!  কিন্তু সোজা ব্যাট!  নৈব নৈব চ!  বল আসছে!  বল আসছে!  বল আসছে!  তারপর —–

তারপর কি?

আলতো করে একটা সুইপ!  টুক করে একটু ঠেকিয়ে দেওয়া! ব্যাস অবধারিত চার!  ব্যাটে লাগল না প্যাডে লাগল বুঝতে বুঝতেই পাবলিকের ছত্রিশ মাস!  এতদিন গদিতে ছিলুম!  দেখান দেখি একটা ঘোটালা!  পারবেন না!  হেলিন, হালিন, হাও — এরা কখনও স্ট্রেইট ব্যাটে খেলেন নি!  পুলিশের ঘোটালাটা ওদেরই বানানো!  আমরা সেটাকেই apply করি মাত্র!  নইলে ইউনিফরম পরা মাত্র গরীব গুবরোগুলো রাতারাতি শ্রেণিশত্রু হয়ে যায় কি করে! 

কি করে?

সেটাই তো বুঝতে হবে ম্যাডাম!  ভাজা পার্টি আমাদের কমন এনিমি!  এসব না বুঝলে ওদের আটকাবেন কিভাবে!  শুনুন। first world  country গুলোতে পুলিশকে বন্ধু হিসেবেই দেখা হয়। জনগণের সেবক। লণ্ডনে তো পুলিশকে ববি বলে ডাকে!  কী প্রেম কী প্রেম!  ব্যাপারটা আসলে তো তাই। সংবিধান, আইনকানুন পালন করার জন্যই তো ওদের নিয়োগ করা হয়। এই সংবিধান মেনে তো আমাদের মত বমরেডরাও চাকরি করছে!  কেউ স্কুলে, কেউ কলেজে, কেউ আবার সরকারী কর্মচারী!  পুলিশও তাই করছে! 
তবু আমরা ওদের ভিলেন বানাই!  কেন বলুন তো?

কেন বাবা অবলাকান্ত? 

ভেরি সিম্পল!  ক্ষমতা দখল করার জন্য! কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা!  বুঝলেন কিনা!  পুলিশ কারা?  সাধারণ মানুষ। ওদের গুলিতে মরছে কারা?  সাধারণ মানুষ!  খেপাচ্ছে কারা?  আমরা, মানে বমরেডরা!  কিভাবে খেপাচ্ছি?  এই বলে যে ওরা বড়লোকের দালাল!  আর তাই শ্রেণিশত্রু!  বড়লোকের দালাল কেন?  না, সংবিধান, আইন কানুন সব বড়লোকের স্বার্থে,  আর সেই আইনকে ওরা রক্ষা করছে বলে ওরাও শ্রেণিশত্রু!  হা হা হা!  অথচ দেখুন এই আইনকে মেনেই আমরা বমরেডরা মাইনে নিই, পেনশন গিলি, এল আই সি করি!  মুরগি হয় ওরা!  পার্থক্য কোথায়?  ওই যে ওদের একটা ইউনিফরম আছে! হেভি ফেটিগ, ভারি বুট!   দেখলেই কেমন একটা — পাবলিককে খেপিয়ে দিতে সুবিধে হয়!  হা হা হা!

এবার কিছু কিছু বুঝতে পারছি!  তোমরাই তো সেই নক্সাবাড়িতে —

এই তো ঠিক ধরেছেন! নক্সা বাড়িতে আমরাই নক্সা করেছিলাম। ইয়ে মানে আমাদেরই মাথা গরম বমরেডরা !   ১৯৬৭ এর মে মাসের ঘটনা। গ্রামের অশিক্ষিত, গরীব মানুষগুলোকে ভুজুংভাজুং দিয়ে — পলিশি খুব সিম্পল!  মেয়েমানুষ আর বাচ্চাদের সামনে এগিয়ে দাও!  বুড়ো হলেও মন্দ নয়। তারপর ইট পাটকেল, পেটো ছুঁড়ে পুলিশকে খেপিয়ে দাও। তার আগে বড়সড় একটা জমায়েত!  এত লোক দেখলে ভগবানও ভয় পায়!  আর সামান্য পুলিশ!  শালাগুলো এমন প্যানিকে পড়ে!  নে এবার চালা গুলি!  পটাপট লাশ!  যদিও এই মাথাগরম বমরেডদরা অফিশিয়ালি দল ভেঙে বেরিয়ে যায়। কিন্তু সত্তর দশকে ওরা যা কেলোর কীর্তি করল তার সুবাদেই তো আমরা ক্ষমতায় এলুম!  সেই একটাই শ্লোগান! বর্বর, অমানবিক পুলিশি জুলুম!  ফন্দীগ্রামেও তো একই কেস!  ওখানেও আমাদের হাও বাদী বমরেডরা ছিল!  একই কায়দায় অপারেশন!  বেশ কিছু লাশ!  আর আপনি আবার ক্ষমতায়!  হাওবাদীদের যেভাবে ইউজ করেছেন না ম্যাডাম!  দুর্দান্ত !  ইউজ এণ্ড থ্রো!  নক্সাবাড়িতে আমরা, ফন্দীগ্রামে আপনি!  হাওবাদী আর ল সা গু!  এদের যদি ঠিকঠাক ইউজ করা যায় না!  সোনায় একেবারে সোহাগা!  প্লিজ ম্যাডাম,  দিন না একটু কেলানি!  তবে ক্যাডার দিয়ে নয়, পুলিশ দিয়ে!  প্লিজ ম্যাডাম! 

খেপেছেন?  হাঙরে একটু দিয়েছিলাম!  তাতেই তো আপনারা আবার আন্দোলন শুরু করেছেন।

ওটা লস্ট কেস ম্যাডাম!  পাবলিক খাচ্ছে না। সরকারি উদ্যোগ ছিল যে!  দেশি বা বিদেশি পুঁজিপতি ইনভলভ থাকলে দেখতেন, আগুন লাগিয়ে দিতাম!  আপনি যেমন হিঙ্গুরে হাটা গোষ্ঠীকে ঝাঁটা দেখালেন।

মাথা খারাপ!  পাগল নাকি!  শিল্প করে মরি আর কী! বেঁচে থাক আমার ঢপ শিল্প!  জমি অধিগ্রহণের কোনো দরকারই পড়ে না।  যাক আমার একটা জরুরী মিটিং আছে। শর্টে বলুন তো ঠিক কি চাইছেন। আমি তো ঠিক করেছি ওদিন ক্ষান্তিনিকেতনে চলে যাব! আপনারা যত ইচ্ছে ভাঙচুর করুন।

তাই?  বাহ!  খুব ভাল আইডিয়া ম্যাডাম। ওদিন মুখোমুখি না হওয়াই ভাল। মুরগি পাবলিক খেপে থাকবে। বুঝতেই পারছেন!  আমাদের মধ্যে তো কোনো শত্রুতা নেই। শুধু ওদের বলে দেবেন যেন উদোম কেলায়। তার আগে ইট পাটকেলের বন্দোবস্ত আমরাই করব!  ভয় নেই ম্যাডাম। আপনার গদি আপবারই থাকবে। ভাজা পার্টিকে আটকানোই এখন মূল লক্ষ্য। শুনছি এরা নাকি সংখ্যা গরুদের একজোট করছে!  সব ঘোঁতন যদি একসঙ্গে ঘোঁতঘোঁত করা শুরু করে — আপনি আমি কেউ টিকবো না! 

বেশ,  তবে তাই হোক। আপনাদের ওদিন কেলাব! 

বাপরে!  এমন ভয় দ্যাখান না!  আমাদের নয়, পাবলিককে!  আমরা বুড়ো মানুষ। যদিও বাধ্য হয়েই দু একজনকে সামনের দিকে থাকতে হবে!  পাবলিক সেন্টু বলে কথা!  আমাদের  না হয় একটু হেলাবেন, কিন্তু ওদের কেলাবেন! 

হা হা হা!  বুঝেছি অবলাকান্তবাবু!  বেশ আপনাদের একটু হেলিয়ে দেব, ওদের একটু কেলিয়ে দেব!  Done !  Live and let live!

আবার ভুল করলেন ম্যাডাম!  live and let live নয়। live and let die!  ওরা না মরলে আমরা বাঁচব কি করে?  হা হা হা!