জার্মানিকে অনেকে “হিটলারের দেশ” বলে অভিহিত করে থাকেন, বা অভিহিত করে আনন্দ পান। যারা জার্মানিকে “হিটলারের দেশ” বলে দাবী করে থাকেন, তারা আসলে কখনো জার্মানিতে আসেন-ই নি, কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের জার্মানি সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না। বিশেষ করে তারা দেখেন নি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জার্মান জনগণের আধুনিক মানসিকতা আর বন্ধুত্বসুলভ আচরণ, এদের মানবতা, সততা, নৈতিকতা, কঠোর কর্মস্প্রীহা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সর্বোপরি এই জাতিটির উন্নত মানবিক মূল্যবোধ।
তবে আডল্ফ হিটলারও রাজনৈতিক জার্মানির একটা অংশ, কারণ হিটলার একটা উল্লেখযোগ্য সময় ধরে জার্মানি শাসন করেছিলেন। হিটলার বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়েছিলেন, সভ্য জার্মানিকে কলঙ্কিত করেছিলেন, এবং জার্মানি, তথা বিশ্বকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন।
তবুও বলছি, জার্মানি হিটলারের দেশ না। দীর্ঘদিন ধরে জার্মানিতে থেকে দেখছি- স্বয়ং ৯৯% জার্মানরাই হিটলারকে কী পরিমাণ ঘৃণা করে, হিটলারের আচরণের জন্য এখনো লজ্জাবোধ করে, হিটলারের রাজনীতি আর সমর্থন এ দেশে নিষিদ্ধ রাখতে সরকারকে সহযোগিতা করে। আর হিটলারের কৃতকর্মের কলঙ্ক থেকে জার্মান জাতিকে মুক্ত করার জন্য সারা বিশ্বের বিপদগ্রস্ত মানুষ আর মানবিক ঘটনাগুলোতে কিভাবে সাড়া দেয়। হিটলার সভ্য আর মানবিক জার্মান রাজনৈতিক ইতিহাসের একটা কলঙ্কিত আর দূঃখজনক অধ্যায় মাত্র।
বাংলাদেশ যেমন গোলাম আজম, সাঈদী কিংবা এরশাদের দেশ হয়ে যায়নি, জার্মানিও তেমনি হিটলারের দেশ নয়।
কথাগুলো বলছিলাম আপনাদেরকে একটা প্রশ্ন করার জন্য।- বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত এবং অমানবিক ঘটনার ইতিহাস যাদের আছে, মানব সভ্যতার সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা ঘটেছে যাদের দেশে, সেই জার্মানিই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাত্র কয়েক দশকের মধ্যেই আবার কি করে এতো মানবিক রাষ্ট্র বা জাতিতে পরিণত হলো?
জার্মানিতে যারা অল্প কয়েক দিনের জন্য হলেও এসেছেন, উত্তরটা তারা নিশ্চয়ই জানেন। জ্বি, আর তা হচ্ছে জার্মানদের শিক্ষা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, প্রচন্ড আইন মেনে চলার প্রবনতা, আর সার্বক্ষণিক মানবাধিকার রক্ষা সম্পর্কিত সচেতনতা।
এবার আসল প্রসঙ্গে আসি।- আমরা বাংলাদেশীরা রাষ্ট্রের আইন আর মানবাধিকারের তেমন একটা ধার ধারিনা। এ বিষয়ে আমাদের দেশের যে যতো বেশী অজ্ঞ, সে ততো বড় বিশেষজ্ঞ। এই দেশের সহজ সরল শিক্ষাবঞ্চিত বিশাল জনগোষ্ঠীর কথা বাদই দিলাম। দূঃখ হয়- শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য। দেশে যারা শিক্ষিত, যারা নিজেকে সচেতন বলে দাবী করেন, যারা সমাজ পরিবর্তনের জন্য প্রগতিশীল আন্দোলনে সদা ব্যস্ত থাকেন, তারাই দেশের আইন আর মানবাধিকারের তোয়াক্কা করেন না। তারা নির্দিধায় আইন নিজের হাতে তুলে নেন, যখন তখন ভয়াবহভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেন। বাংলাদেশে শিক্ষিতরাও অশিক্ষিতদের মতো একজন সন্দেহভাজন অপরাধীকে গণপিটুনিতে শতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ করেন, ধর্ষণে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তার অপরাধ আদালতে প্রমাণিত হবার আগেই তাকে মারধর করে জুতার মালা পরাণ, এমনকি তারা বিনাবিচারে মানুষ হত্যাতেও আনন্দ প্রকাশ করেন। শুধু তাই নয়; আমরা যারা আইন নিজের হাতে তুলে না নেবার, কিংবা মানবাধিকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবার পরামর্শ দিই, তারা আমাদেরকেও জুতাপেটা করেন।-
আমি মনে করি এটাই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় সঙ্কট এবং রাষ্ট্র আর জাতির মানবিক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে আর দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে সবচেয়ে ভয়াবহ বাধা।
যে দেশের শিক্ষিত আর অশিক্ষিতদের আচরণের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকেনা, সে দেশ ক্রমশ আরো বর্বর হবে।