আত্মবলিদান দিবসে ভারত কেশরী ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে জানাই শতকোটি প্রণাম। .

সেদিন ছিল কোজাগরী পূর্ণিমা। ওরা এলো, এসে বলল আমাদের ধর্ম আমাদের ছেড়ে দিতে হবে। কারণ, এখন নাকি এই জমিতে খালি ওদেরই অধিকার। ওরা আমাদের খুন করল, আমাদের মেয়েদের ধর্ষণ করল। আমরা পালিয়ে এলাম আমাদের সাত পুরুষের ভিটে নোয়াখালি ছেড়ে। যারা পালাতে পারলোনা, তারা খুন হলো, তারপরে ধর্মান্তরিত হলো। মেয়েরা ধর্ষিত হলো, তারপরে খুন হলো। এমনকি মেয়ে কম পরলে কোন কোন মেয়ে খুন হওয়ার পরেও ধর্ষিত হলো।

তারপরে একজন এলেন, হাতে লাঠি, পরণে ধুতি, খালি গা। দুই শিষ্যার কাধে ভর দিয়ে তিনি এলেন। এসে আমাদের বোঝালেন, “ওরা ভুল করেছে। ওদের ক্ষমা করে দাও। তোমরা ভুলে যাও ওরা যা করেছে তা। তোমরা ওদের বাধা দিওনা। বাধা দিলে ওরা আরও ক্রুদ্ধ হবে। তাতে সম্প্রীতি বিঘ্নিত হবে”।

আমরা বুঝলাম তার কথা। বুঝে ছেড়ে দিলাম আমাদের জমি, আকাশ, আমাদের স্মৃতি, আমাদের আত্মসম্মান।

এর আগে যেদিন কলকাতায় মিটিং হয়েছিল, একটা বড় মিটিং। সেখানে নাকি লাখে লাখে লোক হয়েছিল। সেখানে নেতারা বলল, এই দেশ নাকি খালি ওদের। আমাদের কোন অধিকার নেই। সেই শুনে ওরা আমাদের উপরে ঝাপিয়ে পরল। বাড়ি বাড়ি ঢুকে আমাদের মেয়েদের ধর্ষণ করল। খুন করল আমাদের বাড়ির বাচ্চা, বুড়োদের। আমরা বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে পাল্টা দিলাম। তখন আবারও সেই তিনি এলেন। হাতে লাঠি, খালি গা, পরণে ধুতি। দুই শিষ্যার কাঁধে হাত দিয়ে সেবারেও তিনি এসেছিলেন। এসে বললেন আমাদের নাকি খুব অন্যায় হয়েছে। আমাদের উচিত হয়নি ওদের বাধা দেওয়া। ওতে ওরা রেগে গেছে। তাই নাকি আর কোন উপায় নেই, দেশভাগ হবে। আমরা বুঝলাম তার কথা। আমরা বুঝলাম দেশভাগ আমাদের দোষেই হয়েছে। ওদের তো কোন দোষ ছিলনা। তারপরেও যেটুকু বোঝার বাকী ছিল তা বোঝানোর চেষ্টা চলছে গত সত্তর বছর ধরে। পাছে আমরা বুঝতে না পারি। তাই আমাদের বোঝানো হয় দেশভাগের জন্য দায়ী জিন্নাহ নয়, গান্ধী নন, নেহেরু নয়। দেশ ভাগের জন্য দায়ী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী।

ইতিহাস তো বরাবরই জয়ী পক্ষের মোসাহেবদের লেখা একগুচ্ছ মিথ্যা। তাই আমাদের এসবই বোঝানো হচ্ছে বারেবারে।

তারপরে আবার ওরা বোঝাতে এল যে কালিয়াচকে কিছু হয়নি। দেগঙ্গায় আমরা বাড়িঘর ছাড়া হইনি। ক্যানিঙে আমাদের বাড়িতে আগুন লাগেনি। ওরা আমাদের বোঝালো কোথাও কিচ্ছু হয়নি। সব ঠিক আছে।

আমরা দেখলাম বাংলাদেশ, পাকিস্তানে আস্তে আস্তে হিন্দু কমে গেল। আর যারা আমাদের তাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, আমাদের ওখানে কোন স্থান নেই, তারাই আবার আমাদের বেঁচে থাকা জায়গাটুকুতেও এসে অধিকার ফলাচ্ছে। আমাদের চোখ রাঙাচ্ছে। ধূলাগড়ে আবার আমাদের মেয়েরা ধর্ষিতা হোল, আমাদের বাড়িতে আগুন লাগল। ওরা এলো, এসে আমাদের বোঝালো ওসব আমাদের দোষেই হয়েছে। কারণ আমাদের উচিত হয়নি ওদের ধর্মীয় শোভাযাত্রা থেকে থেকে কেউ আমাদের মেয়েদের দিকে অশ্লীল ইঙ্গিত করলে তার প্রতিবাদ করা। ধর্মীয় শোভাযাত্রা অতি পবিত্র জিনিষ। আমরা বুঝলাম আমাদের দোষ, তাই আমরা চুপ করে গেলাম।

এরপর আমরা ভাবলাম আমরাও আর ভুল করবনা। ধর্মীয় পবিত্র কাজই করব। আমরা রামনবমীর শোভাযাত্রা করব। রাণীগঞ্জে সেই শোভাযাত্রার উপরে আক্রমন হোল।ওরা আবার এলো এসে আমাদের বোঝাল যে ধর্মীয় শোভাযাত্রা খুবই অপবিত্র ব্যাপার। আমাদের সংস্কৃতিতে এসব মানায় না। আমরা বললাম মহরমের সময় যে তোমরা বললে ধর্মীয় শোভাযাত্রা পবিত্র কাজ।আর আমাদের যে লোকগুলো মারা গেল। তার বিচার? ওরা বলল, “চুপ চুপ, ঈমাম সাহেবের পুত্র মারা গেছেন। ওনাকে দেখ উনি কিন্তু প্রতিশোধের কথা বলছেন না”। তখন আমরা বললাম সে তো মহেশ রাউতের মাও বলছেন না প্রতিশোধের কথা। কিন্তু বিচার কেন চাইবো না? ওরা বোঝাল এসবের বিচার হওয়া সম্ভব নয়। কারণ ঈমাম সাহেবের পুত্র মারা গেছেন। আমরা বললাম তা ঈমাম সাহেবের পুত্রেও মৃত্যুরও বিচার করুন। ওরা বলল, “চুপ চুপ।এসব নিয়ে বেশী খোচাখুচি না করাই ভালো।এতে ওরা রেগে যাবে।” আমরাও চুপ করে বুঝে গেলাম।

আমরা আমাদের সরস্বতী পুজো করতে গেলাম। সরস্বতী পুজো, বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বাঙালির প্রেমের দিন। ওরা বলল বন্ধ করতে হবে। আমরা রুখে দাড়ালাম বন্ধ করবো না বলে। ওরা তখন আবার এলো এসে আমাদের বোঝাল যে এসব পুজো আচ্চা খুব খারাপ ব্যাপার। ইংলিশে যাকে বলে রিগ্রেসিভ। আমরা বুঝলাম। বললাম ঠিক আছে আর পুজো হবেনা। আমাদের পুজো বন্ধ হোল, সে জায়গায় ওদের নতুন পরব শুরু হোল। আমরা যখন জিজ্ঞেস করলাম এটা কেন? ওরা কেন ধর্মের উপরে উঠবেনা? তখন ওরা বলল, না না ধর্ম তো ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমরা ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারিনা। আর ধর্ম অতি পবিত্র ব্যাপার, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিত নয়। আমরা বুঝলাম কারুর ধর্ম বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা তার ব্যক্তিগত অধিকারে হস্তক্ষেপ করা। আমরাও তাই আর কিছু না বলে চুপ করে গেলাম।

তারপরে আমরা দেখলাম আমাদের দেবদেবী নিয়ে নানান কার্টুন আকা হোল। আমরা তাই দেখে রেগে গেলাম। তখন ওরা আমাদের এসে বোঝাল ধর্ম ব্যাপারটাই খারাপ। তাই তাকে নিয়ে মজা করে করে তার গুরুত্ব নষ্ট করে দেওয়াটাই উচিত। আমরাও বললাম, হ্যাঁ ঠিক ঠিক। ধর্ম না থাকলে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হতোনা। আমাদের নিজের বাড়ি, নিজের পুকুর, নিজের জমি, নিজেদের আকাশ, বাতাস ছেড়ে আসতে হতোনা।

তারপরে আমরা দেখলাম একটা বাচ্চা ছেলের নাম দিয়ে ধর্মীয় কিছু চরিত্রকে নিয়ে কিছু কার্টুন আকা হোল। ওরা তার বদলায় থানা আক্রমণ করে বাচ্চা ছেলেটাকে খুন করতে চাইল। আমাদের বাড়ি পোড়াল। আমরা যখন পাল্টা দিতে শুরু করলাম, তখন আবার ওরা আমাদের বোঝাল ভুল আমাদেরই। আমাদের উচিত হয়নি ওদের ধর্ম নিয়ে কিছু বলা। ওরা পিছিয়ে আছে এখনও আমাদের থেকে তাই আমাদের ওদের কিছু বলা উচিত নয়।আমরা বললাম বলবনা। ওরা স্লোগান তুলল, “আর্য জাতি ভারত ছাড়ো”।

আমরা দেখলাম সত্তর বছর ধরে ধরে একটু একটু করে বাংলাদেশ থেকে হিন্দু কমে গেল। ওরা ফটোশপে সিঁদুর মুছে দিয়ে আমাদের বোঝাল কিছুই হয়নি। আমরা যখন বললাম হিন্দুরা আমাদের এখানে চলে আসুক। আমাদের এখানে ওদের জায়গা করে দেওয়া হোক। ওরা আমাদের বোঝাল সব বাংলাদেশের সব হিন্দুদের জায়গা দিতে গেলে আমাদের এখানে জায়গা কমে যাবে। তারপরে একদিন রোহিঙ্গারা এলো। আমরা বললাম, ওদের আসতে দিওনা।ওরা এলে আমাদের জায়গা কমে যাবে। তখন ওরা বলল, এদের জন্যই তো আমরা জায়গা বাঁচিয়ে রেখেছি। নাও তুমি আরেকটু জায়গা ছাড়ো তো। ওদের জন্য আরেকটু জায়গা লাগবে। আমরা বললাম ওদের তাহলে বাংলাদেশে পাঠাও। ওরা তো নিজেদের জন্যই আমাদের থেকে বাংলাদেশ নিয়েছিল। তখন ওরা আমাদের বলল, ওখানে এখন ভূমিসংস্কার চলছে। তাই ওখানে ওদের উপরে চাপ দেওয়া যাবেনা। আমাদেরই আরেকটু জায়গা ছাড়তে হবে।

দিন তিনেক আগে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠা দিবস চলে গেলো। আজকের দিনে আবারও চিনে নিন আপনার আশপাশেই ঘাপটি মেরে থাকা সেই দালালদের যারা বাঙালি হিন্দুদের জমি, জল, আকাশ, বাতাস বেচতে চায় বিদেশী পুজিবাদী ধর্মীয় শক্তির কাছে। ওদের চিনে নিন, ঐ দালালদের নির্মূল করুন আমার আপনার সমাজ থেকে। ওদের চিনে নিন, যারা আপনার আমার স্বপ্নের সমাধির উপরে নিজেদের সৌধ গড়ে তুলতে চায়। ঘৃণা করুন সেই দালালদের, ছুঁড়ে ফেলুন ওদের সমাজ থেকে।

আত্মবলিদান দিবসে ভারত কেশরী ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে জানাই শতকোটি প্রণাম।
.
Diptasya দার লেখনীতে।