#আশার_ছলনে_ভুলি
কবি মধুসূদন দত্ত হলেন মাইকেল মধুসূদন ডাট ব্যারিস্টার এটেল। হেনরিয়েটা , শর্মিষ্ঠা ও পুত্র মেঘনাদ কে তাকে রক্ষা করতেই হবে । কখনো কখনো রেবেকার কথা মনে পরে । মনে পরে বারথা, ফিবি, জর্জ কেও।
বিদেশ থেকে এসে মাইকেল উঠলেন স্পেন্সস হোটেলে। তিনি এবার নিশ্চিন্ত সাফল্য আসবে অর্থ আসবে । অনর্গল ইংরেজিতে তার মতন জেরা আর কেউ করতে পারবে না। এই আকাশ কুসুম কল্পনা ব্যর্থ হলো। হোটেল থেকে চলে এসে বাড়ি ভাড়া নিলেন ।
আজকাল প্রচুর মদ পান করতে শুরু করেছে হেনরিয়েটা ।
“জীবন্ত চলন্ত ছায়া নির্বোধ উপাখ্যান এক, আগাগোড়া লম্ফঝম্পও করে ভরা …
অর্থ নেই কোন “
শর্মিষ্ঠা বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছেছে । ব্যারিস্টার হয়ে টাকা রোজগার করেছেন ,উড়িয়ে দিয়েছেন , সঞ্চয় করেন নি।
মাইকেল এখন স্বাস্থ্য ভাঙতে শুরু করেছে।
“তেমতি দুর্বল দেখো করিছে আমারে নিরন্তর।
হব আমি নির্মূল সমূলে এই শরে।”
” মাই ডিয়ার বোতল শেষ ….মদ চাই আমার । ” কৃষ্ণকুমারী রচনা করছেন মাইকেল । হেনরিয়েটার কথায় মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন।
অশক্ত শরীর , তবুও মদ চাইলে দেবেন না এমনটা হতে পারে না । খুব দ্রুত অসুস্থতা থেকে মুক্তি পেলেন হেনরিয়েটা। কবিকে ফেলে রেখে তার মৃত্যু হল ।কবিও অপেক্ষা করে আছেন স্রষ্টার কাছে ফিরে যাবার জন্য ।
রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন তাকে জিজ্ঞেস করেলেন ” মধু ধর্মান্তর নিয়ে তোমার কি কোনো অনুতাপ আসছে?”
মাইকেল বলেলেন , ” না “
কৃষ্ণ বললেন ” তুমি কি কোনো স্বীকারোক্তি দিতে চাও প্রভু যীশুর কাছে?”
মাইকেল বললেন , “আমি তো কোনো পাপ করিনি… মানুষের তৈরি চার্চে প্রতি আমার কোন বিশ্বাস নেই…”
কৃষ্ণমোহন বললেন, ” খ্রিস্ট ধর্ম অনুযায়ী তুমি কিছু বলতে পারো…”
মাইকেল চিৎকার করে উঠে বললেন “আমি ধর্ম মানিনা…”
প্রসঙ্গ বদলানোর চেষ্টা করলেন কৃষ্ণমোহন, “উত্তরপাড়া কেমন লাগছে মাইকেল?”
অভিভূত মাইকেল বললেন ,”অসাধারণ এই গঙ্গার ধার….কোপ্তাক্ষের কথা মনে পড়ে গেল ।”
মাইকেলের রোগ জীর্ণ শরীর উদাস মুখে দাঁড়িয়ে আছে ….. “গৌড় ছাদে গিয়ে বসব”
কথা শেষ করার আগেই যেন এক আশ্চর্য জীবন শক্তি অর্জন করলেন মাইকেল…. ” হরি … ও হরি …আরে dear harrison তিনটে কেদারা দিতে হবে ছাদে ।”
অবাক হলেন কৃষ্ণমোহন, ঋণে জর্জরিত মাইকেল ডাট, অবশ্য এখন মধুসূদন দত্ত লেখেন। এই অবস্থায় ভৃত্য পরিবৃত হয়ে রয়েছেন ?
কৃষ্ণের মনোভাব বুঝতে পেরেছেন কবি। হেঁসে বললেন ” ভূদেব পাঠিয়েছেন।
হ্যারিসনকে আমি ছোট করে হরিদা বলি।”
…. “জান কৃষ্ণমোহন ছোটবেলায় আমার স্কুলে নিয়ে যেত আরেক হরি দা… কত অত্যাচার তার ওপর করেছি… তবু কখনো মায়ের কাছে নালিশ করত না”
কণ্ঠস্বর ভেজা ভাব কবির। কেদ্বারা পাতা হয়েছে ।গোলাপী বিকেল। দুটো কোকিল ছাদে এসে বসলো।
“এই গৌড় জানো ওরা না প্রায়ই এসে বসে… কিন্তু ডাকে না ।”ছল ছল চোখে গৌড় মাইকেলের চোখের দিকে তাকালো
সবুজ বা স্রোতস্বিনী গঙ্গা এখন নিস্তরঙ্গ ।ঐদিকের গঙ্গার পাড়ে দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণী মন্দির। কোকিল ডাকছে না। কেন? কেউ জানে না…হয়ত এখনো মধুমাস সমাগত হয়নি ।বরং নীরব দুপুরে ঘুঘু ডেকে উঠল।
কবি ধরা গলায় কবির কাব্য থেকে বলতে লাগলেন
” লিখনু কি নাম মোর বিফলে যতনে বালিতে , রে কাল , তোর সাগরের তীরে ?কেন চূর আসি কি রে ফিরে ,
মুছিয়ে তেমনি তুচ্ছেতে ত্বরা এ মোর লিখনে?”
সামনে শুধু নীল অন্ধকার ।কবি বিছানায় ফিরে এলেন ।মাদ্রাসা যখন ছিলেন কবির শরীর ছিল স্থূল। মাঝেমধ্যেই জোরে কাতর হয়ে পড়তেন। ভার্সাইতে অনাহারের মধ্যে নতুন ভাষা শিখেছিলেন ।বাংলা ভাষায় লিখতে শুরু করে সম্মান যশ অর্থ সব পেয়েছিলেন ।ব্যারিস্টার পেশায় বিফল হলেন। দিনের বেলায় দরজা-জানলা বন্ধ করে পেগের পর পেগ হুইস্কি নিতেন ।অনাহারের পেটে নির্জলা whisky । পঞ্চকোটের রাজার বিশেষজ্ঞ হয়েছিলেন। মাটিতে পা পড়ত না তখন।
পঞ্চকোট এ গিয়ে তিনি ভেবেছিলেন সাধারণ প্রজাদের দুঃখ দূর করবেন। সে কথা তিনি জানিয়েছিলেন কৃষ্ণমোহনকে। কৃষ্ণমোহন উত্তরে লিখেছিলেন ” কিভাবে সম্ভব মধু– তোমার পরিকল্পনা কি?”
উত্তরে কবি মাইকেল লিখেছিলেন
“ভাঙ্গা গড় গড়াইব, জল পূর্ণ করি
জলশূন্য পরিক্ষায়, ধনুরবান ধরি দ্বারীগন আবার রক্ষীবে দ্বার অতি কুতূহলে।”
“এই …এই কৃষ্ণ কতদিন হুইস্কি খাই নি…” কাতর কন্ঠে বলে উঠলেন মাইকেল। গৌড়দাস চিৎকার করে উঠে বললেন , “তোমায় হুইস্কি দেওয়া যাবে না ।তোমার শরীরে মদের বিষ আর দেওয়া হবে না।”
হাসলেন মাইকেল, ” তবে বন্ধু brandy হোক …শক্তি বর্ধক।” শেষমেষ ব্র্যান্ডি দিতে হলো ওকে। একদম জল মেশাতে দিলেন না।
প্রবল খরতাপের দিনে মাইকেল মারা গেলেন । কৃষ্ণমোহন যা আশঙ্কা করেছিলেন তাই সত্য হলো। কবির মৃতদেহ খ্রিস্টান গোরস্থানের সমাধিস্থ করতে দেওয়া হল না। অনেক রাত অবধি মর্গে পড়ে রইল কবির দেহ ।
কৃষ্ণমোহন ছিলেন কলকাতার ধর্মযাজকদের মধ্যে প্রধান ।অবশ্য তখন তিনি ধর্মযাজকের কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি তখন বিশপস কলেজে পড়াচ্ছেন।
কৃষ্ণমোহন আর এমিলি মিলে এলেন লর্ড বিশপ মিলম্যান এর কাছে। কাজ হলো না।
শেষমেষ এংলিকয়ান চার্চেএর একজন সিনিয়র Chaplain তাকে লোয়ার সার্কুলার রোডের গোরস্থানে সমাধিস্থ করতে অনুমতি দিলেন। চারদিন আগে হেনরিয়েটাকে ওখানে কবর দেওয়া হয়েছে । কৃষ্ণমোহন শেষকৃত্যে থাকেন নি। এমিলি এসেছিল।
কবির গুণমুগ্ধ পাঠক এর সংখ্যা প্রচুর ছিল। যারা জীবিত কবির খোঁজ করেনি। মৃত কবির জন্য এসেছেন। এদের মধ্যে এক ঝকঝকে তরুন ছিলেন উমেশ চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়।
তথ্যঃ
ধর্মান্তর