রামতনু_লাহিড়ী_ও_স্বদেশ_ভাবনা

#রামতনু_লাহিড়ী_ও_স্বদেশ_ভাবনা

রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জি রামতনু লাহিড়ীর হাতে ইয়ংবেঙ্গল বন্ধুদের পক্ষ থেকে দেওয়া ঘড়ি তুলে দিয়ে বললেন  , “ব্রাদার! রেখো তুমি দাসেরে মনে।”

বলে মৃদু হাসতে লাগলেন , তাকালেন মধুর দিকে। মধু তখনও মাইকেল হননি। কিন্তু এই স্বরচিত লাইনটি প্রায়ই বলতেন । রামতনুর চোখ ছল ছল করছে। তাকে প্রিয় কলকাতা ছেড়ে তাকে চলে যেতে হবে সেই কৃষ্ণনগর।  তিনি কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলের দ্বিতীয় শিক্ষক হিসেবে জয়েন করেছেন। দক্ষিণারঞ্জন বললেন , “কি হে রামতনু মদ্যপান করবে তো?”

মদ যে তার পান করতে ভালো লাগতো এমনটা নয়। তবু খানিকটা খেলেন। মদ সামান্য পেটে পড়তেই মধু উল্টোপাল্টা বকতে শুরু করল । মধু বলে উঠলেন” রামতনু মনে রেখো ট্রুথ ইস সিনোনের্মাস ফর স্টুডেন্টস।”

রামতনু লাহিড়ী কে রাজা রামমোহন রায় বরাবরই টানেন । বহু ভাষা, জাতি, ঈশ্বরের দেশ ভারতবর্ষে রাজা রামমোহন রায় উপলব্ধি করতে পেরেছেন হিন্দু ধর্মের শেষ কথা হল ব্রহ্ম। পরম ব্রহ্মই সব। তিনি চরম ও ব্যাপ্ত। রাজা উপলব্ধি করে গেছেন উপনিষদই সব ধর্মীয় প্রশ্নের শেষ উত্তর।

সতীদাহ নিয়ে আইন রাজার উদ্যোগেই পাস হয়েছিল। কেশব চন্দ্র সেন রাজার  অনুসারী ছিলেন । টাউনহল এ কেশব সেনের বক্তৃতাই রামতনুর হৃদয় অগ্নি প্রজলন সম্পূন করে।

ব্রাহ্ম ধর্মের সূচনা ধর্মান্তরের প্রবাহমানতা এক নতুন বাঁক ।

রামতনু লাহিড়ীর সঙ্গে একদিন সংস্কৃত কলেজের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তাঁর দেখা হলো কৃষ্ণমোহনের সঙ্গে। রামতনু অন্যমনস্ক হয়েছিলেন। প্রথমে লক্ষ্য করেননি রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন কে। কৃষ্ণমোহন পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরলেন “ব্রাদার তুমি শেষ মেষ ব্রাহ্ম হলে? “

রামতনু হাসলেন…. তারপর বললেন, ” তুমি তো অনেক দূর এগিয়ে রয়েছ রেফারেনড সাহেব।”

কৃষ্ণমোহন বললেন , “ব্রাহ্মধর্মে তোমরা নতুন কিছু বলছো।”

সেদিন বৈশাখের দুপুর বাইরে প্রখর রৌদ্র। গরম হাওয়া চলছে।

নিতান্ত কাজ ছাড়া রাস্তায় তেমন লোক নেই।  হিন্দু কলেজের প্রাক্তন দুই বিখ্যাত ছাত্র ও বন্ধু গোলদিঘির পার্কে একটি বেদী বাঁধানো গাছ তলায় বসলেন। 

রামতনু কথা শুরু করলেন , ” কৃষ্ণমোহন ভারতবর্ষে নিজস্ব একটা শক্তি আছে ।ভারতবর্ষের ধর্মও সেই শক্তি থেকে উদ্ভূত ।আমাদের আচার বিচার সংস্কার ইংরেজরা নাড়া দিয়েছে। কিন্তু……”

বলতে গিয়ে থেমে গেলেন রামতনু । কৃষ্ণমোহন  বুঝতে পারলেন রামতনুর কোথাও গিয়ে দ্বিধা হচ্ছে।  তিনি বললেন, ” অকপটে বল ব্রাদার। তোমাদের রাজা রামমোহন রায়ের পুস্তকের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল ।”

তখন কৃষ্ণমোহন বললেন,  সব ধর্মে বিকৃতি আছে। আমাদের ভিতরকার বিকৃতি একদম সরে গিয়ে সংশোধন করা সম্ভব নয়। সনাতন ধর্মে তুমি যদি উনিষদ পর তাহলে কোথাও কিন্তু বিকৃত পাবে না।আমরা সামাজিক জীবরা নিজ স্বার্থে তাকে লৌকিক ভাবে বিকৃতি করেছি। কেন তোমার খ্রিস্ট ধর্ম  বিকৃত নয়?অস্বীকার করতে পারবে? “

কৃষ্ণমোহন দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন।  তারপর বললেন, ” তোমরা তবে ভারতবর্ষের ভিতর থেকে আহবান করছ।” খুব কঠিন সত্য কথাটা কৃষ্ণমোহন নিজেই বললেন । তারপর আবার বললেন ,”রামতনু খ্রিস্টান সংস্কারকে আমি …… আমি অস্থিমজ্জায় গেঁথে নিয়েছি তো। আর আমার ফেরা সম্ভব নয়।”

রামতনু মৃদু হেঁসে বললেন “কৃষ্ণমোহন তুমিও সত্যের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য রয়েছো ।”

কৃষ্ণমোহন অন্যমনস্ক হয়ে বললেন ” এক সময় আমার মনে হয়েছিল ,ইংরেজদের যদি আঘাত করতে হয় তবে ওদের ধর্ম দিয়ে আঘাত করতে হবে । ভারতবর্ষকে ওরা হেয় করেন ধর্মের কারণে ।”

অবাক হয়ে গেলেন রামতনু । ইয়ং বেঙ্গলের সদস্য কৃষ্ণমোহন খ্রিস্টান হয়েছিলেন আলেকজান্ডার ডাফ এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে । নাস্তিক কৃষ্ণমোহন হয়ে উঠেছিলেন যীশু অন্তপ্রাণ ।এমনকি বাইবেলকে তিনি পরম সত্য বলে ভাবতে শুরু করেছিলেন।

গ্যালিলিও নিয়ে একসময় কলকাতা তরুণদের মধ্যে যে ঝড় উঠেছিল, কৃষ্ণের মতো শিক্ষিত একজন ব্যক্তি আশ্চর্যজনকভাবে নীরব ছিলেন ।
কৃষ্ণমোহন আবার বললেন, ” অনেকেই এখন আমাকে আর বিশ্বাস করে না ।কেউ কেউ আমাকে বৃটিশের দালাল বলে।”

এসব কথা রামতনু জানেন…কিন্তু কখনো তিনি বিশ্বাস করেননি। ব্যক্তি স্বার্থের কারণেই কৃষ্ণমোহন কোনদিন কিছু করতে পারেন না।

রামতনু বললেন, ” ওসব আমি কখনো বিশ্বাস করিনি । তুমি সত্য ও ধর্মের অন্বেষক। তোমার মতের সঙ্গে আমার পার্থক্য আছে,  কিন্তু স্বদেশী আমাদের মূল লক্ষ্য ।”

কোথাও যেন একটু স্বস্তি পেলেন কৃষ্ণমোহন। অনেকদিন পর রামতনু সঙ্গে দেখা হয়ে সে হালকা হল। কৃষ্ণমোহনকে অন্তত একজন তো  বিশ্বাস করে ।

কৃষ্ণ বললেন , “রামতনু দেবেন ঠাকুরের কাছে যাবো একদিন…”
উৎসাহী হয়ে রামতনু বললেন , ” চল আজই যাই। চিতপুর আর কতক্ষণ লাগবে।”

কৃষ্ণমোহন বললেন ” না আজ যাবনা । “

রামতনু বুঝতে পারলেন কোথাও কোনো আত্মিক সংকটের মধ্যে রয়েছেন কৃষ্ণমোহন ।তাই জোর করলেন না দ্বিতীয়বার ।

কৃষ্ণমোহন এবার ব্রাহ্ম সম্পর্কে একদম অন্যরকম একটা গুজবের কথা বললেন ।
” রামতনু শহরে জোর চর্চা হচ্ছে শান্তিপুর নিয়ে ।”

ইয়ংবেঙ্গলদের বৈঠকে কৃষ্ণের জুড়ি মেলা ভার ছিল। সেই কৃষ্ণমোহন সেই কবে হারিয়ে গিয়েছে । রামতনু জানেন এবার কৃষ্ণমোহন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ব্রাহ্ম সমাজের ওপর আক্রমণ করবে।

তাই রামতনু বললেন , “শান্তিপুরের চণ্ডুখোরদের কথা বলবে তো? “

হাই উঠলো রামতনুর।

” গপ্পো কিনা জানিনা । শুনেছি শান্তিপুরে ব্রাহ্মদের সভায় শ্রোতার অভাবে চণ্ডুখোর দের ডাকা হতো।”

কোনরকমে  হাসি চেপে রাখলেন রামতনু….
কৃষ্ণমোহন বলতে লাগলো” শেষ অবধি চণ্ডুখোর রাও আস্ত না ।ধর্ম আলোচনার চটে পালাত। 1/2/ 3 আনার জন্য বরাদ্দ বাড়ালেও….শেষে এক বৃদ্ধ নেশাখোর কে জুটিয়ে ছিলে?”

রামতনু বললেন ” গাল গুজবের শেষ টুকু আমি জানি কৃষ্ণমোহন,  সে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে হাই তুলে বলেছিল আহা কি অপূর্ব জ্ঞান লাভ করিলাম।”

দুজনে অনেকদিন পর হেসে উঠলেন… পথচারীরা কেউ কেউ থমকে তাকালেন ওদের দিকে। কলকাতায় তখন দুজনেই গণ্যমান্য ব্যক্তি, চেনা লোকের অভাব থাকার কথা নয় ।

হটাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে রামতনু বললেন, ”  চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তুমি কি চোখে দেখছ কৃষ্ণ? “
সতর্ক হলেন কৃষ্ণমোহন। যতই হোক কৃষ্ণমোহন বৃটিশের অন্ন ভোগী , “গণবিক্ষোভ অনেকটাই প্রশমিত হয়েছে ।”

রামতনু বললেন , “কৃষ্ণমোহন আমি তোমার সুহৃদ। তুমি ডিপ্লোম্যাট দের মত কথা বলবে না ।”

কৃষ্ণমোহন বললেন , “লর্ড উইলিয়াম বেন্টিং এরকমটাই বলেছেন…. তবে রামতনু আমি তোমার ইঙ্গিত ধরতে পেরেছি …এক বিপুল সংখ্যক ধনী ভূস্বামী র  সৃষ্টি হয়েছে আর এরা হচ্ছে শাসকদের বংশবদ অনুচর।”

আকুল হয়ে রামতনু বললেন , “শুধু জমিদার নয় কৃষ্ণমোহন ফরে দালালদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে ।পুরো ওজনটা পড়ছে দরিদ্র রায়ত দের ওপর।”

কৃষ্ণ মোহন বললেন , “আমি জানি রামতনু …ভূমিহীন চাষীদের সংখ্যা বোধহয় লক্ষাধিক… চিরকালের স্বত্ব লোপ পেল । ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন এর সাধারণ কৃষকদের যাবতীয় দাবি নস্যাৎ করল । কৃষ্ণমোহন তুমি কিছু করবে না ? “

কৃষ্ণমোহন আত্মমগ্ন হলেন… তিনি যেন আর রেফারেনড নন। নতুন স্বদেশ চেতনা, রামতনু কে দেখে তাকে উদ্বুদ্ধ করল। তিনি বললেন , “রামতনু ইন্ডিয়ান লিগ লড়বে প্রজাদের জন্য …না পারলে আরো কোন বৃহত্তম প্লাটফর্ম তৈরি করা হবে ….অনেক ভালো ছেলে রয়েছে। আমি প্রজাদের স্বার্থরক্ষার আইন নিয়ে পড়ছি। তুমিও সঙ্গে থাকবে তো?

রামতনু হাত বাড়িয়ে দিলে ,কৃষ্ণমোহন বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

রামতনু বললেন “ওকে আমি থাকবো সুহৃদ।”

কৃষ্ণমোহন বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন ।তিনি খুব ঘাম ছিলেন। তপ্ত টা বাড়ছে ।সবকিছু অগ্রাহ্য করে কৃষ্ণমোহন বললেন , ” আমি উপলব্ধি করেছি রামতনু , হটাৎ করে মরুভূমির বুকে উৎপন্ন ধর্ম  …না না ধর্ম নয় মার্গ দিয়ে কিছু হয়না।ধর্ম তো একটা সনাতন। বাকি হল মার্গ। রামতনু নিরাকার , সাকার, বাইবেল নয় আমাদের বিদেশি ফরেনবডি শাসকের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হবে।”

ওঁরা গোলদিঘি থেকে বেরিয়ে পড়লেন।

তথ্যঃ

ধর্মান্তর