ইসলামপুরের ঘটনা নিয়ে আমার সিরিজ যাঁরা পড়ছেন এবং শেয়ার বা কপি পেস্টের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, তাঁরা জানেন যে সিরিজের ২য় পর্বে আমি লিখেছিলাম যে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রুলিং পার্টির একাংশ এমন আছেন, যাঁরা বাংলা ও বাঙালী সেন্টিমেন্টকে স্টিমুলেট করে আসলে একটা বৃহত্তর ভাষা আগ্রাসন ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে আড়াল করছেন বলে সন্দেহ হয়।
এটি ৪র্থ পর্ব।
ইসলামপুরে চুপিসাড়ে বাংলা শিক্ষকের জায়গায় উর্দু শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে যখন পশ্চিমবঙ্গ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, তখন নিম্নোক্ত সংবাদ অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, তৃণমূলের একশ্রেণীর মানুষ বাংলা ও বাঙালী প্রীতিপ্রদর্শন করার উদ্দেশ্যে দুর্গাপুজোর একটি প্যাণ্ডেল জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছেন।
কেন?
কারণ প্যাণ্ডেলটিকে “হলুদের প্যাণ্ডেল” না বলে বলা হয়েছে “হলদি কা প্যাণ্ডাল”। এ না কি দুর্গাপুজোয় হিন্দি আগ্রাসন।
এবার দয়া করে ভাবুন, যাঁরা বাঙালী, খাঁটি বাঙালীয়ানা যাঁদের আত্মায় অবস্থান করে, তাঁরা কি কস্মিনকালেও, কোনো কারণেই, পৃথিবীর কোনো প্রান্তেই দুর্গাপুজোর কোনো প্যাণ্ডেল জ্বালিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতে পারেন?
দুর্গাপুজোর প্যাণ্ডেল জ্বালিয়ে দেওয়ার আওয়াজ তোলামাত্রই কি তাঁদের বাঙালীত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায় না?
হিন্দি আগ্রাসনের অজুহাত দেখিয়ে যাঁরা কেবলমাত্র “হলদি কা প্যাণ্ডাল” বলা হয়েছে বলে সেই প্যাণ্ডাল জ্বালিয়ে দেওয়ার কথা বলা তো দূর, ভাবতে পর্যন্ত পারেন, তাঁরা আর যা-ই হোন্ পশ্চিমবাংলার পক্ষে নন। তাঁরা বাঙালীর পক্ষেও নন। যতই তাঁরা নিজেদেরকে বাঙালীয়ানার ঠিকাদার বলে প্রজেক্ট করুন না কেন।
এই তথাকথিত বাঙালিদের মধ্যে একজন মন্তব্য করেছেন যে প্যাণ্ডেল থেকে মায়ের মূর্তি বের করে নিয়ে এসে প্যাণ্ডেল জ্বালিয়ে দেবেন (প্যাণ্ডেল-স্পনসরের আর্থিক ক্ষতি সুনিশ্চিত করার জন্য বোধ হয়)। অর্থাৎ মন্দির আর মূর্তিকে আলাদা করে দেখতে চান এঁরা।
প্যাণ্ডেল হল ঐ চার দিন মায়ের মন্দির। মন্দির থেকে তার আত্মাকে আলাদা করার কথা ভাবতে বা বলতে যাঁরা পারেন, তাঁদের শুধু বাঙালীয়ানা নয়, হিন্দুত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠে যায় না কি? এঁরা কারা?
যাঁরা মায়ের পূজোর প্যাণ্ডেল থেকে আজ মা’কে বের করে আনতে চাইছেন, তাঁরা যে কাল (বাংলাদেশে বা পশ্চিমবঙ্গের বহু জায়গায় তাঁদেরই দলভুক্ত অন্যরা যেভাবে মায়ের মূর্তি ভেঙ্গে ফেলেন, সেইভাবে) মূর্তি তৈরিতে হিন্দিওয়ালাদের পয়সা ব্যবহৃত হয়েছে এই অজুহাতে মায়ের সেই মূর্তিও ভেঙ্গে ফেলতে চাইবেন না, তার কি গ্যারান্টি আছে?
প্রায় সকলেই হয়ত বুঝতে পেরেছেন যে এ হেন ধুয়ো তোলার পিছনে ওঁদের আসল উদ্দেশ্য ছিল ইসলামপুরের উর্দুবিরোধিতার আবহে একটা পাল্টা হিন্দিবিরোধিতার হাওয়া তৈরি করা। অর্থাৎ ইসলামপুরে জোর করে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদটা তথাকথিত বাংলা ও বাঙালী পক্ষের পছন্দ হয় নি।
যদি কেউ প্রশ্ন করেন যে কলকাতায় দুর্গাপুজোর প্যাণ্ডেলকে “হলুদের প্যাণ্ডেল” না বলে “হলদি কা প্যাণ্ডাল” বলা হবেই বা কেন?
তার উত্তর হল, কলকাতা ভারতবর্ষের একটি কসমোপলিটান মেট্রো সিটি এবং নবরাত্রি পুরো ভারতবর্ষ পালন করে। অর্থাৎ মহালয়া থেকে শুরু করে বিজয়া দশমী পর্যন্ত শারদীয়া নবরাত্রি বা দুর্গাপুজো প্রায় গোটা ভারতবর্ষের উৎসব। এক একটা রাজ্য এক এক ভাবে, এক এক extent এ তা উদযাপন করে। “হলুদ”কে যাঁরা “হলদি” বলে দুর্গাপুজো তাঁদেরও ততটাই উৎসব, যতটা আমাদের, বাঙালীদের।
অর্থাৎ এক্ষেত্রে “হলুদ”কে “হলদি” বলনেওয়ালাদের সাথে আমরা এক সাংস্কৃতিক সূত্রে বাঁধা, কিন্তু উর্দু ভাষা বা উর্দুভাষীদের সাথে আমাদের কোনো সাংস্কৃতিক মিলই নেই। সংবাদটি এবং সংবাদের সঙ্গে পরিবেশিত সমস্ত কমেন্ট ইত্যাদিগুলি অবশ্যই পড়ুন এবং আগ্রাসনের আসল চেহারা দেখুন। (ক্রমশঃ)