ভারতের নামকরণের ইতিহাস

ভারতের নামকরণের ইতিহাস:  ‘ভারত, ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান, ভারতবর্ষ’এক দেশের এত নাম কেন?

ভারতের নামকরণের ইতিহাস:  ‘ভারত, ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান, ভারতবর্ষ’এক দেশের এত নাম কেন? আমাদের এই উপমহাদেশীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতি পরতে পরতে রহস্য ওতপ্রোত ভাবে জড়িত আছে।

সেই সিন্ধু সভ্যতা থেকে শুরু করে হরপ্পা যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ, বৈদিক যুগ, মৌর্য সাম্রাজ্য, গুপ্ত সাম্রাজ্য, দিল্লী সুলতানি ও মুঘল সাম্রাজ্য সহ এমন অনেক সভ্যতার ক্রমবিকাশ হয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশে। বর্তমানে অনেকেই রাজনৈতিক সংবেদনশীলতার কারণে “ভারতীয় উপমহাদেশ” শব্দযুগল ব্যবহার না করে বরং দক্ষিণ এশিয়া বলে এই এলাকাকে সম্বোধন করে থাকেন।

আজ আমরা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস নিয়ে নয় বরং ভারতের নামকরণের ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করতে যাচ্ছি। ভারত, হিন্দুস্তান ও ইন্ডিয়া এ তিনটি নামের নামকরণ কীভাবে হয়েছিল তার আদ্যোপান্ত নিয়েই এই লেখাটি সাজানো হয়েছে। উল্লেখ্য যে, দ্য রিপাবলিক অফ ইন্ডিয়ার মূলত অফিশিয়াল নাম দুইটি, একটি হল ভারত এবং অপরটি ইন্ডিয়া।

ভারতের নামকরণের ইতিহাস: ইন্ডিয়া ও হিন্দুস্তান নামের উৎপত্তি

ইংরেজি নাম ‘ইন্ডিয়া’ মূলত গ্রীক শব্দ ইন্ডিকা থেকে এসেছে। ইন্ডিকা শব্দটি আবার সংস্কৃত শব্দ ‘সিন্ধু’ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। তৎকালীন সময়ে ইন্ডাস নদীর (সিন্ধু নদী) অববাহিকায় বসবাস করার কারণে প্রাচীন গ্রীকবাসী বর্তমান ভারতীয় উপমহাদেশের লোকদের ইন্দোই বলে ডাকত। সেই গ্রীক শব্দ থেকেই ধীরে ধীরে ল্যাটিন এবং পার্সিয়ান ভাষার মাধ্যমেই ইন্ডিয়া নামটি প্রচলিত হয়ে যায়।

অনেক ইতিহাসবিদদের মতে সিন্ধু নদের মাধ্যমে অনেক বাণিজ্য হতো। এই নদ ধরেই ভারতীয় উপমহাদেশে পারস্যদের আগমন। মজার বিষয় হল পারস্যের অধিবাসীরা নাকি তখন ‘স’ উচ্চারণ করতে পারতো না, বিধায় সিন্ধু নামটি হয়ে গিয়েছিল হিন্দু। আবার গ্রীকরাও এই ইন্ডাস অর্থাৎ সিন্ধু নদীর অববাহিকায় বসবাসকারীদের ইন্ডোই বলত। এই ‘ইন্ডোই’ শব্দটিই কালের বিবর্তনে ইন্ডিয়া হয়ে গিয়েছে।

ইন্ডিয়া শব্দটির মতো ঠিক একইভাবে প্রাচীন গ্রীক শব্দ থেকে কালের বিবর্তে হিন্দুস্তান শব্দটি এসেছে বলে অনেকে ধারণা করেন। সিন্ধু নদীর অববাহিকায় বসবাসরত উপমহাদেশীয়দের সিন্ধু শব্দটি থেকে হিন্দু বলে ডাকা হত। পারস্য এবং আরবি ভাষাতেও এই হিন্দ শব্দটি বহুল প্রচলিত।

 

ইন্ডিয়া) India: এটি ভারতের ইংরেজি নাম, Herodotus (খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতক) এর সময় থেকে গ্রিক শব্দ India থেকে উদ্ভূত হয়ে ল্যাটিন, পার্সিয়ান ভাষার মধ্য দিয়ে বিকাশ লাভ করেছে। India বলতে Indus river (সংস্কৃত, সিন্ধু নদ) এর তীরবর্তী এবং পেছনের এলাকা নির্দেশ করা হত। আ্যংলো-সেক্সনদের কাছে India শব্দটি পরিচিত ছিল এবং রাজা আলফ্রেডের Orosius অনুবাদে শব্দটি পাওয়া যায়। Middle English-এ ফরাসি প্রভাবে শব্দটি Ynde বা Inde-তে পরিণত হয়, যা Early Modern English-এ Indie হিসেবে প্রবেশ করে। বর্তমান India নামটি ১৭ শতক থেকে প্রচলিত।

 

এমনকি ইসলাম ধর্মের সর্বশেষ রসুল (স.) উপমহাদেশকে বুঝানোর জন্য প্রায় সময় আল-হিন্দ, শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তবে এই শব্দটি ইংরেজি ভাষার সাথে সংযোজিত হয়েছিল ১৭শ শতাব্দীর দিকে। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা যখন উপমহাদেশে বাণিজ্য করতে আসে, তখন তারা এই অঞ্চলকে ইন্ডিয়ার পাশাপাশি হিন্দুস্তান বলেও আখ্যায়িত করতো। বর্তমানে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকেই হিন্দুস্তান শব্দটি ব্যবহার করলেও, সাংবিধানিকভাবে ‘ইন্ডিয়া’ এবং ‘ভারত’ এই দুটো নামকেই স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।

 

ভারতের নামকরণের ইতিহাস: ভারত নামের উৎপত্তি

সেই সুদূর অতীত থেকেই ইন্ডিয়াকে ভারত নামে ডাকা হয়। এমনকি এখনো আমরা ইংরেজি লেখার সময় India লিখলেও বাংলাতে লেখার সময় ভারতই লিখে থাকি। আর এই ভারত নামটি যে শুধু বাংলা এবং হিন্দি ভাষাতেই রয়েছে তা কিন্তু নয় বরং ইন্ডিয়ার প্রায় সকল আঞ্চলিক ভাষা সহ প্রাচীন কালের অনেক বিলুপ্ত ভাষাতেও ভারত নামটির প্রাধান্য পরিলক্ষিত করা গেছে।

 

ভারতীয় সংবিধানে ভারত নামটিকে সাংবিধানিক রূপ দেয়া হয়েছে। ভারতীয় সংবিধানের প্রথম আর্টিকেলেই লেখা হয়েছে,

“India, that is Bharat, shall be a union of states”

অনেক ঐতিহাসিকদের মতেই ভারত নামটি রাজা “ভরত” এর নাম থেকে এসেছে। মহাভারতে সেই কাহিনী পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, শকুন্তলা ও দুষ্মন্তের পুত্র রাজা ভারতকে এই বর্ষ দেয়া হয়েছিল বলেই এই এলাকার নাম তখন বলা হতো ভরতবর্ষ। আর সেখান থেকেই ভারতবর্ষ নামের উৎপত্তি। উল্লেখ্য যে, বর্ষ বলতে কোন একটি অঞ্চলকে বুঝানো হত।

 

দেখা যায় যে ভারত নামটিই প্রাচীনকাল থেকে বেশী প্রসিদ্ধ এবং স্থানীয় নাম ছিল। অপরদিকে ইন্ডিয়া নামটিই বরং উপমহাদেশে বাণিজ্য করতে আসা বহিরাগতদের দেয়া নাম যা পরবর্তীতে প্রসিদ্ধি লাভ করে।

ভারতের নামকরণের ইতিহাস: ইন্ডিয়াকে আর্যদেশ বলেও ডাকা হয় কেন?

এই নামে নামকরণের পেছনে মূলত দুইটি আলাদা যুক্তি পারস্পরিকভাবে একই সুতোয় গাঁথা রয়েছে। এই নাম করনের প্রথম যুক্তিটি হল, খ্রিষ্টপূর্ব পঁচিশ হাজার বছর পূর্বে ইরান অঞ্চল থেকে আর্যদের একটি দল উপমহাদেশে প্রবেশ করে সিন্ধু সভ্যতা গড়ে তোলে।। আর সেখান থেকেই অনেক ঐতিহাসিকগণ ভারতকে আর্যদেশ নামেও ডেকে থাকেন।

 

দ্বিতীয় সূত্রটিও কিন্তু সেই আর্যদের নিয়েই, তবে এখানে বলা হচ্ছে যে বিভিন্ন সংস্কৃত শ্লোক এবং প্রাচীন সব পৌরাণিক গ্রন্থের মধ্যে আর্যদের কথা উল্লেখ করা আছে। আর্য শব্দটি মূলত আর্য সভ্যতা থেকে আসেনি বরং আর্য শব্দের অর্থ হল জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমান। এছাড়া ঈশ্বরের যে পুত্রগণের মধ্যে পিতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ পেত তাদেরকেও আর্য বলা হতো। আর সেই ধ্যান ধারণা থেকে ভারতবর্ষে বিভিন্ন অবতার-গনের অভিপ্রকাশ হয়েছিল বলেই হয়ত আর্য নামটি দেয়া হয়েছিল।

 

তবে উপরোক্ত উভয় যুক্তির মধ্যে প্রথম যুক্তির সাথেই বেশীরভাগ ঐতিহাসিকগণ সম্মতি প্রদান করেছেন। অপরদিকে ভারতীয় গোঁড়া সম্প্রদায় এবং পুরোহিতরা হয়ত ভারতীয় সভ্যতার উৎপত্তির পবিত্রতা রক্ষার জন্যই দ্বিতীয় যুক্তিটিকে বেশী প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।

 

অনেক সংস্কৃত শ্লোক এবং পৌরাণিক লিপিতে দেখা যায় যে ভারতীয় এই উপমহাদেশটি পূর্বে জম্বুদ্বীপ নামেই বহুল প্রচলিত ছিল। এছাড়াও প্রাচীন কয়েকটি ভাষায় তেনজিকু নামেও ভারতকে আখ্যায়িত করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, তেনজিকু শব্দটি মূলত হিন্দু শব্দ থেক উৎপন্ন হয়েছে। হিন্দি শব্দটি চীনা ভাষায় পরিবর্তিত হয়ে তেনজিকু হয়ে গিয়েছে।

 

১৯৪৭ সালে যখন ভারত ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল তখন তৎকালীন সনাতন ধর্ম অনুসারীদের আধিপত্যর কারণে লোকমুখে “ভারত” নামটি বহুল প্রচলিত হয়ে যায়। অনেকে মনে করে থাকেন যে উপমহাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই মুসলিম শাসনের ইতিহাসকে প্রাধান্য না দিতেই প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনী থেকে রাজা ভরত এর নাম অনুযায়ী ভারত নামটিকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল।

 

আমাদের পাশে থাকতে একটি লাইক দিয়ে রাখুন।-ধন্যবাদ

আর পড়ুন….