ভারতীয় সভ্যতার এমন শক্তি আছে যা ভােগবাদী দুনিয়াকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে। প্রথমদিকে নানাভাবে অতিরিক্ত চাহিদা নিয়ন্ত্রণে বাধ্য করতে হবে। প্রয়ােজনে শক্তি প্রয়ােগ করা যেতে পারে। ব্যক্তি, সমাজ, পরিবেশের কল্যাণে তা করলে কোন অপরাধ হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতাে ভােগবাদী রাষ্ট্রও আজ ‘তা বুঝেছে।
তাই বিশেষ বিশেষ ভােগ্য পণ্যের ক্ষেত্রে চাহিদা কমাতে নানারকম করছাড় ও অন্যান্য সরকারী সুবিধা দিচ্ছে। যেমন পলিথিন ব্যাগের ব্যাপক ব্যবহার পরিবেশ দূষণ করে। মার্কিন সরকার ঘােষণা করেছেন যে সেখানের সুপার মার্কেটে কেনাকাটার | জন্য আসা ক্রেতারা যদি বাড়ি থেকে নিজের ক্যারি ব্যাগ বা বাজারের থলি নিয়ে আসেন তবে তারা দামের ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় পাবেন। অর্থাৎ পরিবেশ দূষণ বন্ধ করতে প্রয়ােজনে পুরস্কার ও শাস্তি উভয়ের প্রয়ােজন আছে। আমাদের পূর্বপুরুষের সাধারণ উপলব্ধি।
পোষ্টটি পড়ার আগে এখান থেকে প্রথম পর্ব আগে পড়ে আসুন
আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাঁদের সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে সমস্যাটির গুরুত্ব বুঝেছিলেন, বিপদে পড়ে নয়। প্রাচীন হিন্দু সাহিত্যের মূল শিক্ষাটিই ছিল ঈশ্বর তােমাকে যতটুকু দিয়েছেন তাই নিয়ে সুখে থাক। প্রয়ােজনের অতিরিক্ত কিছু ভােগ করার ইচ্ছা ত্যাগ করাে। যা তােমার নয় তা অধিকার করা থেকে বিরত হও। প্রাচীন ভারতে মানুষের চাহিদা নিয়ন্ত্রণে শক্তি প্রয়ােগ করতে হয়নি। সেকালের সামাজিক শিক্ষাই এমন ছিল।
ভাল মন্দ বিচার করার ক্ষমতা ছিল। শ্রেয়সী ও প্রেয়সীর দ্বন্দ্বে সর্বদা জয় শ্রেয়সীর হতাে। মনকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার এই শিক্ষারই নাম “সাধনা”। আর এই সাধনার পদ্ধতি বা সােপান হচ্ছে “যােগ”। একে অন্যের পরিপূরক। দুয়ে মিলে শিক্ষার নাম যােগ সাধনা। ভােগ নয় ত্যাগ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য জীবন দর্শনের মূল পার্থক্যটাই এখানে। পশ্চিমের তথাকথিত সভ্যতার মূল কথাই হলাে যথেচ্ছ ভােগ।
অথাৎ সম্পূর্ণভাবে বস্তুবাদী জীবনযাত্রা। প্রাচ্যের দর্শন বলে ত্যাগের মধ্যেই যথার্থ ভােগ হয়। জীবনের লক্ষ্য হােক পরমাত্মার আশীর্বাদ, পরম শান্তিলাভ। তুচ্ছ পার্থিব বস্তুর ভােগ জীবনে শান্তি আনেনা। তাই ভােগসুখের ইচ্ছা ত্যাগ করাে। জীবনধারণের জন্য যতটুকু প্রয়ােজন তায় বেশি চাহিদা যেন না থাকে। এই কথাটা আধুনিক ভাষায় বলতে গেলে বলা যেতে পারে যে চিন্তাধারার রঙ হােক গৈরিক।
তবেই দূষণমুক্ত পরিবেশে সুস্থ জীবনযাপন সম্ভব। সনাতন ভারতীয় জীবন দর্শনে গৈরিক রঙ ত্যাগী সন্ন্যাসীর প্রতীক। আধুনিক বিশ্বে দূষণ মুক্ত পরিবেশকে গ্রীন বা সবুজ রঙ বলা হয়। তাই গৈরিক চিন্তনই পারে আধুনিক বিশ্বে গ্রীন লিভিং বা দুষণহীন সমাজ ও পরিবেশ সৃষ্টি করতে। ভােগ নয়, ত্যাগের মাধ্যমেই প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা সম্ভব। ভােগ প্রকৃতিকে শােষণ করে। ত্যাগ প্রকৃতিকে রক্ষা করে। ভােগ থেকে অধিকারবােধের জন্ম হয়। মানুষকে হিংসায় প্ররােচিত করে। ত্যাগ শান্তি দেয়। মানুষ, প্রকৃতি, পরিবেশ সুস্থ শৃঙ্খলা গড়ে তােলে।
উপনিষদের পথ প্রকৃতির স্বাভাবিক বিবর্তনই হিন্দু দর্শনের মূল তত্ত্ব। প্রকৃতির বিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত হয়েই জীবন সহজভাবে বিকশিত হােক। প্রকৃতি থেকে বিছিন্ন হয়ে নয়। হিন্দু ধর্মের শিক্ষা, সংসারে গৃহী সন্ন্যাসীর জীবনযাপন করে। বিবর্তনের মধ্য দিয়ে জীবনকে আরও উন্নত করে গড়ে তােল। হিন্দু ধর্মের গভীরে প্রবেশ করলে বােঝা যায় কত অমূল্য রত্ন সেখানে ছড়িয়ে আছে। জীবাত্মার কল্যাণে এমন ধর্ম শিক্ষা আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমন এক মহান ধর্মের শরিক হিন্দু বলে গর্বিত হতে হয়। হিন্দু দর্শন শুধু হিন্দুর জন্য নয়।
হিন্দু জীবনবােধ সমগ্র মানব জাতির জন্য। হিন্দুর জীবনযাত্রার শিক্ষা গ্রহণ করলে প্রকৃতিকে সম্পূর্ণ অন্য রূপে দেখা যাবে। প্রকৃতি তখন আর বহুভােগ্যা রমনী নয়, স্নেহময়ী মাতা রূপে মানব সমাজের কাছে প্রতিভাত হবে। মানব ও প্রকৃতি তখন পরমেশ্বরের অদ্বৈত রূপ হয়ে দেখা দেবে। ঐক্যবদ্ধ জীবন তখন পরস্পরকে সম মর্যাদায় ভালবাসতে শেখাবে। ব্যক্তি অধিকারবােধের পরিবর্তে সমষ্টির অধিকারবােধের জন্ম দেবে।
উপনিষদের প্রথম ছন্দবদ্ধ বানী, “এই বিশ্বের সমস্ত কিছুতেই ঈশ্বরের রূপ প্রতিভাত। সবই ঈশ্বরের দান। প্রতিটি বস্তুতেই সকলের সম্মান অধিকার। তাই সকলে একত্রে তা ভাগ করে নাও। অন্যের প্রাপ্য বস্তু জোর করে অধিকার করাে না।” অর্থাৎ গৈরিক চিন্তনই দূষণমুক্ত গ্রীন লিভিং বা সবুজ জীবনযাত্রা বিশ্বে গড়ে তুলতে সক্ষম।
গীতার পথ
মানব ও প্রকৃতির এই বন্ধন ও পারস্পরিক নির্ভরতার কথাই ভাগবত গীতার উপদেশে আছে। গীতার উপদেশে যজ্ঞের কথা বলা হয়েছে। এই যজ্ঞের বিধি নিয়ম এমন যে তা প্রাকৃতিক চক্রকে অব্যাহত রাখতে সাহায্য করে, গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের বারাে অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “পরমা প্রকৃতি আমাদের যে সম্পদ দিয়েছেন কেউ যদি তা ফিরিয়ে না দেয় তবে সে চোর ছাড়া আর কি?” সত্যি, প্রকৃতি আমাদের নির্মল বাতাস শুদ্ধ পানীয় জল দিয়েছে। সুতরাং বাতাস জলকে নির্মল পবিত্র রাখা আমাদের কর্তব্য ও দায়িত্ব।
মাটিতে জৈব প্রক্রিয়া ফসল ফলাতে মানুষকে সাহায্য করে। প্রকৃতির। এই জৈব প্রক্রিয়া খাদ্য সরবরাহ করে মানবের জীবন- চক্রকে অব্যাহত রেখেছে। প্রাকৃতিক জৈব-প্রক্রিয়ায় বিষ ছড়িয়ে তাকে ধ্বংস করলে জীবন-চক্রকেই ধ্বংস করা হবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাই গীতার বাণীতে বলেছেন, “যে ব্যক্তি প্রকৃতির জীবনচক্রে বাধা দেয় সে ইন্দ্রিয় সুখে আসক্ত মহাপাপী।” মাটি, জল, বাতাসে দূষণের বিষ ছড়ালে প্রাকৃতিক জীবনচক্র বিঘ্নিত হয়।
তাই গীতার মহান উপদেশ, ইন্দ্রিয় সুখভাগের ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করাে। তােমার লােভ, ভাগেচ্ছা প্রকৃতিকে ধ্বংস করবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, বিশ্ব প্রকৃতির নিয়ন্ত্রক পুরুষােত্তম সকলের পরম মিত্র। তিনি কাউকে ঘৃণা করেন না। তিনি সর্বদা হিতকারী।
গীতার বাণী অনুসারে সর্বজনের হিত চিন্তা সত্য হলে প্রাকৃতিক সম্পদ শশাষণ বা লুণ্ঠনের প্রশ্ন আসে না। যেমন দুগ্ধবতী গাভীকে মাংসের জন্য হত্যা করা যেতে পারে। হত্যা করলে বড় জোর একবারই মাংস পাওয়া যেতে পারে। গাভীটিকে আর পাওয়া যাবে না। অথচ দুগ্ধবতী গাভীটিকে সযত্নে রক্ষা করলে দীর্ঘ বহু বছর ধরে দুধের অমৃতধারা ভােগ সম্ভব। ভারতীয় হিন্দু এই সহজ সত্যটি উপলব্ধি করেছিল।
হিন্দু তাই গাে সম্পদকে রক্ষা করেছে। মাংসের লােভে হত্যা করাকে অধর্মীয় মহাপাপ বলে ঘােষণা করেছে। পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায় তাঁর “একাত্ম মানবতাবাদ” প্রসঙ্গে বলেছেন, “প্রকৃত সভ্যতার বিস্তার কখনাে প্রকৃতিকে শােষণ করে হয় না। প্রকৃতিকে রক্ষা করে তাকে সযত্নে পুষ্ট করেই তার জয়যাত্রার রথ এগিয়ে চলে। প্রকৃতির দানকে যথাযােগ্য মর্যাদার সঙ্গে গ্রহণ করেই মানব জীবনকে সচল রাখার পদ্ধতি ও নীতিই সর্বশ্রেষ্ঠ পথ।”
লেখাটির
প্রথম পর্ব এখানে
তৃতীয় পর্ব এখানে
৪র্থ পর্ব এখানে
আরো পড়ুন….
বিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের সেই মর্মান্তিক কাহিনী
বেদ- একটা গল্প ও তার কাটাছেঁড়া, শ্রেণীসংগ্রাম অর্থাৎ ইতিহাস কিন্ত থেমে নেই, থেমে নেই পথ
জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান মেঘনাদ সাহা FRS, মেঘনাদ সাহা বাঙ্গালীর বিজ্ঞান জগতের এক উজ্জ্বল
আমার নিজস্ব ভাবে সমাধান সুত্র; ডাঃ মৃনাল কান্তি দেবনাথ
সূত্র:-
প্রাচীন ভারত – উইকিপিডিয়া
সিন্ধু উপত্যকা সভ্যতার তথ্য – প্রাচীন ভারতের ইতিহাস
প্রাচীন ভারত সভ্যতার রহস্যের …
হিন্দুধর্মের ইতিহাস
সিন্ধু সভ্যতা – উইকিপিডিয়া
হিন্দুধর্মের ঐতিহাসিক সভ্যতা
বৈদিক সভ্যতা – উইকিপিডিয়া
বৈদিক সভ্যতা (Vedic Civilisation) | BengalStudents
প্রাচীন বৈদিক সভ্যতার
আদি বৈদিক যুগের ইতিহাস জানার
লেখক-অভিরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
অধ্যাপক দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়
সভ্যতা, সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশ্লেষক।