বাঙ্গালী কারা? বাংলায় কথা বলেই কি সে বাঙ্গালী? বাংলাদেশের মানুষ কি সত্যিই বাঙালি নাকি বাং আলী? পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী হিন্দুরা বাংলাদেশের মানুষকে বাঙালি বলে মনে করে না কেন? ভাববার বিষয়!
যদি একজন আমেরিকান বাংলায় এসে ভালো ভাবে বাংলা শিখে বাংলা বলে সে কি বাঙ্গালী হবেন? আবার ধরুন বাংলা থেকে কেউ আরবে গিয়ে আরবি শিখে ভালো আরবি বলে সে কি এ্যারাবিয়ান হবেন? মোটেও না, কারণ কাওকে ইংরেজ, বাঙ্গালী বা এ্যারাবিয়ান হতে হলে আগে তাকে ঐ সংস্কৃতি চর্চা করতে হবে। তেমনি যদি কেউ বাংলা ভাষায় কথা বলে, কিন্তু বাংলা সংস্কৃতিকে ঘৃন্না করে সে কিভাবে বাঙ্গালী হবেন? এক কথা বাঙ্গালী হতে হলে তোমাকে শুধু বাংলা ভাষায় কথা নয়, বাঙ্গালী সংস্কৃতি চর্চা করতে হবে, তবে তুমি বাঙ্গালী হবে। অন্য থাই তোমার পরিচয় হবে পিত্রীহারা বাঙ্গালী। যার বাপের পরিচয় ঠিক নাই।
আচ্ছা বাঙালি কে? বাংলা তো একটা ভাষা। তাই বাংলা যার মাতৃভাষা সেই বাঙালি। তা যাদের আন্দোলনের ফলে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেল তারা বাঙালি নয়? বলেন কি মশাই?
আমার তো মনে হয় বাংলা ভাষা প্রেমের কারণে ভাষা আন্দোলন হয়নি। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে পূর্ব পাকিস্তান চাকরি বাকরি থেকে সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়বে এই বাস্তবতা থেকে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত।
বাংলা ভাষাকে ভালোবাসলে কেউ নিজের আত্মজের নাম বাংলা ভাষায় না রেখে আরবি ভাষায় রাখতে পারে? বিশেষ করে যে শব্দের মানে সে নিজেই জানে না! অর্থ না জেনে নাম রাখার ফলে কেউ তার আত্মজের নাম রেখে দেয় “জামাল!”
“জামাল”-এর অর্থ “উট” (🐫”) জানলে সে কখনো এই নাম রাখত বলে মনে হয়? জামাল যখন জানতে পারে যে তার নামের অর্থ “উট”, তখন কি মনে মনে প্রীত হয়?
বাংলা সাহিত্যের মহাকাব্যের যুগ, মঙ্গলকাব্যের যুগ, রবীন্দ্রযুগ বাদ দিলে বাংলাদেশের হাতে শুধু বখতিয়ার খিলজী পড়ে থাকে। না, ভুল বললাম, সেই সঙ্গে পড়ে থাকে আহমদ ছফার ‘বাংলাদেশী সাহিত্যের নিজস্ব’ ভাষা নির্মাণ করার প্রোপাগান্ডা।
পৃথিবীর যে কোনো সংস্কৃতি ও জাতিসত্ত্বার সঙ্গে ইসলামের বিরোধ একটি অনিবার্য ঘটনা। ইসলাম কীভাবে সাংস্কৃতিক ও জাতিগত উপনিবেশ চালায় তা বুঝতে হলে ইসলামের রাজনৈতিক চরিত্র বুঝতে হবে। ইসলাম ‘মুসলমান’ বলে যে জাতিসত্ত্বার কথা বলে তার কোনো নৃতাত্ত্বিক বাস্তবতা নেই। কোনো ভূখণ্ডে ইসলাম নিজের উপনিবেশ তৈরি করে বসত গড়ে কিন্তু সেখানে তাকে বাঁচতে হয় শিকড়হীন হয়ে।
যে কোনো ইসলামী উপনিবেশে মুসলমান সেখানকার নৃতাত্ত্বিক ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতিকে শিরক, বিদ্দত, জাহেলি মনে করে ঘৃণাসহকারে বিরোধীতার কথা বলে। যেমন ‘বাঙালী’ নামে পরিচিত এই জনগোষ্ঠীর মুসলমান অংশটি নিজেদের হাজার হাজার বছরের নৃতাত্ত্বিক ধারার উত্তরসূরি মনে না করে, আরবের কাউকে নিজের পূর্বপুরুষ মনে করে। নিজের নববর্ষকে এরা শিরক মনে করে দূরে থাকে। নিজের ঐতিহ্যগত পোশাক ও সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানী মনে করে ঘৃণা করে। এমনকি নিজের ভাষার হিন্দুয়ানী তার কাছে অস্বস্তিকর মনে হয়।
সে তাই স্নান করাকে গোসল বলে, হাত-পা ধোয়া কে অজু করা বলে, প্রার্থনা করাকে দোয়া করা বলে, অতিথি কে মেহমান বলে, জলখাবারকে নাস্তা বলে। শুদ্ধ সুশ্রাব্য বাংলা প্রতিশব্দ থাকা সত্ত্বেও কেন এই সব বিজাতীয় শব্দ ব্যবহার করে তা ইসলামের সাংস্কৃতিক ও জাতিগত উপনিবেশের বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকলে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। এই কারণেই সে “রামধনু” 🌈 বলতে পারে না, বলে “রংধনু”! বাংলা ভাষায় সপ্তাহের সাতটি বারের নাম হিন্দু দেবতার নামে (সোম, মঙ্গল, বুধ ইত্যাদি) এটা রামছাগলদের মাথায় আসে না, এলে হয়তো ভাষা আন্দোলনকারী জাতি এগুলোর বিকল্প খুঁজতে শুরু করবে। 🤭
এ প্রসঙ্গে সুষুপ্ত পাঠকের একটি লেখা কপি পেস্ট করছি। আগ্রহী পাঠক লেখাটি পড়ে নিজের মতামত দেবেন।
“ভাষা আন্দোলন বাংলা ভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা, কিংবা মাতৃভাষার প্রতি প্রচন্ড আবেগপ্রবণ একটি মুভমেন্ট ছিলো এরকম কোন প্রমাণ ইতিহাস থেকে অন্তত পাওয়া যায় না। কিছু গীতিকার, কবি, নাট্যকার ভাষা আন্দোলন নিয়ে যে আবেগপ্রবণ সাহিত্য গান রচনা করেন সেখান থেকেই পরিবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীদের বাংলা ভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসার গল্পটি ডালপালা মেলে।
ভারত ভাগ হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম যে দৈনিক পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় তার নাম রাখা হয়েছিলো ‘পয়গাম’। সম্পাদক ছিলেন ফয়েজ আহমেদ চৌধুরী। সংস্কৃতিবান ও শিক্ষিত মানুষের পত্রিকাগুলোর নাম দেখুন।
১৯৪৭ সালে ঢাকায় আরো একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয় যার নাম রাখা হয়েছিলো ‘জিন্দেগী’। ১৯৪৮ সালে মাওলানা আকরাম খাঁ প্রকাশ করেন “দৈনিক আজাদ’। এরপর আসে ‘ইত্তেফাক’, ‘ইনসান’, ও ‘ইনসাফ’। এইসব দৈনিক সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলো রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবীতে চলা আন্দোলনকে সমর্থন করে লেখালেখি করে।
রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ সদস্য ছিলেন ইত্তেফাক, ইনসান ও ইনসাফ পত্রিকার সম্পাদক ত্রয়ী। এরপর নাম করতে হয় আরো দুটি পত্রিকার নাম যথাক্রমে ‘ইত্তেহাদ’ ও ‘নওবেলাল’। নওবেলাল ছিলো কমিউনিস্ট সমর্থক পত্রিকা। মাওলানা ভাসানীর ‘হক কথা’ পত্রিকাও ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সোচ্চার ছিলো।
বাংলা ভাষার জন্য এহেন গভীর মমতা আর ভালোবাসা জাগানো সম্পাদকীয় বের হতো এইসব আরবী ও উর্দু নামের পত্রিকাগুলো থেকে! একটা পত্রিকারও বাংলা নাম রাখা হয়নি। নওবেলাল ভাষা আন্দোলনের পক্ষে যে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে সেটাও ‘মুসলিম বাংলা ভাষা’ বললে অতিরিক্ত হবে না।
নওবেলাল লেখে, ‘পাকিস্তান লাভ করিবার পূর্বে পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের ধারণা ছিল যে, তাহাদের সংস্কৃতি, তাহজিব, তমদ্দুন সকল অবস্থায়ই অক্ষুন্ন থাকিবে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের এলাকাধীন বিভিন্ন প্রদেশের অধিকাংশ বাসিন্দা মুসলমান জাতিকে, তাহাদের মধ্যে মজহাবী একতা ছাড়া ভাষাগত বিষয়ে বিভিন্ন প্রদেশের নানাবিধ পার্থক্য রহিয়াছে তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। যদি একভাষার আধিপত্যে অন্য ভাষার প্রসার সংকুচিত হয় অথবা অন্য প্রদেশের সংস্কৃতি বিনষ্ট হইবার সূচনা দেখা যায় তাহা হইলে যে প্রদেশের মর্যাদাহানি হইয়াছে তাহার প্রতি অবিচার করা হইবে’।
অকারণে বাংলা ভাষায় আরবী উর্দুর আমদানি করে ভাষাটাকে সাম্প্রদায়িকভাবে পৃথক করার সচেতন চেষ্টা চালায় পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীরা। মূলত রাষ্ট্র ভাষা উর্দু হয়ে গেলে চাকরিতে বাঙালী মুসলমান পিছিয়ে পড়বে।
বাঙালী হিন্দুর জন্য মুসলমান উন্নতি করতে পারছে না- এই ছিলো পাকিস্তান গড়ার মূল মন্ত্র, এখন পাকিস্তান করে উর্দুর জন্য সেই একই হাল হলে পাকিস্তান করে মুসলমানদের কি লাভ হলো? এই প্রশ্ন থেকেই শিক্ষিত জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে মানতে চায়নি। রাষ্ট্র ভাষা উর্দু হলে সাধারণ চাষাভুষা, শ্রমিক, জেলে তাঁতির কোন মাথা ব্যথা হতো না। তারা এমনিতেই প্রতি সাপ্তাহে উর্দু সিনেমা দেখত। মূলত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পড়ুয়া তরুণরা বুঝেছিলো ভাষাগতভাবে তারা পাকিস্তানে পাঞ্জাবী পাঠানদের থেকে পিছিয়ে থাকবে।
এটা ঠিক ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনই পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালী জাতীয়তাবাদ জেগে উঠে। কিন্তু সেই বাঙালী জাতীয়তাবাদ পাঞ্জাবী পাঠানদের কাছ নিজেদের পরিচয় তুলে ধরা ছাড়া আদতে সেটা মুসলিম জাতীয়তাবাদই ছিলো। এটা ঠিক ষাটের দশকে বুদ্ধিজীবী লেখক শিল্পীদের একাংশ রবীন্দ্রনাথকে পূর্ণজাগরণ করে অভিন্ন বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির উত্তরাধীকার হিসেবে বাঙালী সংস্কৃতি চর্চা ঢাকা শহরে করছিলেন।
তবে এটি কিছুতে সামগ্রিক চিত্র নয়। এখনকার ছেলেমেয়েদের নাম খাটি আরবী কিংবা উর্দু শব্দে রাখা হতো। কাজি নজরুল ইসলাম তার সন্তানদের নাম রেখেছিলেন বাংলায় সব্যসাচী, অনুরুদ্ধ। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ছেলেমেয়ের নাম রাখতে গিয়ে সম্ভবত পাকিস্তান করার সময় তাদের ‘তাহজিব তমদ্দুন’ সম্পর্কে সজাগ থাকতেন তাই সন্তানদের নাম হতো আরবী উর্দুতে।
আপনাদের কি মনে হচ্ছে এটি সচেতন প্রয়াস নয়? তাহলে দেখুন অবিভক্ত বাংলার জাতীয় পত্রিকাগুলোর নাম তাদের সম্পাদকদের পরিচয়। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, প্রতিষ্ঠাতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্ত। সাপ্তাহিক সুলভ সমাচার, সম্পাদক- উমানাথ গুপ্তা। মাসিক পূর্ণিমা, সম্পাদক কবি বিহারী লাল। মাসিক বঙ্গদর্শন, সম্পাদনা করেছেন যথাক্রমে, বঙ্কিম চন্দ্র চট্টপাথ্যায়, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টপাধ্যায়, শ্রীশচন্দ্র চট্টপাধ্যায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মাসিক বিনোদনী, সম্পাদক- নবীবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। মাসিক ভারতী, সম্পাদক- স্বর্ণ কুমারী দেবী। মাসিক নবজীবন, সম্পাদক- অক্ষয়চন্দ্র সরকার। মাসিক বীণা, সম্পাদক- রাজকৃষ্ণ রায়। সাপ্তাহিক বঙ্গবাসী, সাম্পাদক- জ্ঞানেন্দ্রলাল মিত্র। সাপ্তাহিক হিতবাদী, সম্পাদক- কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য। মাসিক প্রবাসী, সম্পাদক- রামানন্দ চট্টাপাধ্যায়। সাপ্তাহিক ধূমকেতু, সম্পাদক- কাজি নজরুল ইসলাম। এছাড়া কল্লোল, শনিবারের চিঠি, বিচিত্রা, প্রগতি প্রমুখ পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিলো।
‘ইনসান’ ‘ইনসাফ’ নামগুলোর সঙ্গে এই নামগুলো বাংলা ভাষাভাষীর কাছে স্পষ্টতর করে একটা বিদেশী ভাবাবেগ কি এনে দেয় না? ভাষার জন্য রক্ত দেয়া একটা জাতি কি ১৯৫২ সালে হঠাৎ টুপ করে গাছ থেকে ফল পড়ার মত করে পড়েছিলো? সাহিত্য শিল্পে নামকরণ চেতনাকে উন্মচিত করে তোলে। যাদের সংবাদ সাহিত্য পত্রিকার নামই উর্দু আরবীতে রাখা হতো তাদের বাংলা প্রেম প্রশ্নবিদ্ধই মনে হচ্ছে…।”
শুধু নামকরণ নয়, ইসলাম যেখানে যায় সেখানে সে সাংস্কৃতিক উপনিবেশ নির্মাণ করে। ইসলামের প্রভাবে সেখানকার আবহমান কালের বাসিন্দারা নিজেদের নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও বাচিক ঐতিহ্য ভুলে নিজেদের ইসলামের অনুসারী মনে করতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে সে আগে মুসলমান পরে অন্যকিছু। তাই মুসলমান বাঙালি হলেও সেটা গৌন, সে আগে মুসলমান, পরে বাঙালি।
পরিশেষে একটি কথাই বলবো “সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা।” বাঙ্গালী কারা বাঙ্গালী কারা বাঙ্গালী কারা বাঙ্গালী কারা বাঙ্গালী কারা বাঙ্গালী কারা বাঙ্গালী কারা বাঙ্গালী কারা বাঙ্গালী কারা বাঙ্গালী কারা বাঙ্গালী কারা