বউ বিক্রির প্রথা: সতীদাহ প্রথার নাম শুনেছে কিন্তু বউ বিক্রির প্রথা কথা কি শুনেছেন। জানি শুনেনি, শুনতে চাননি, বা শুনতে দেওয়া হয়নি। আজ শুনুন, ব্রিটিশরা ভারতের সতীদাহ প্রথা নিয়ে নাকি দারুণ চিন্তিত ছিল। কিন্তু নিজদেশে নারীদের সাথে কেমন ব্যবহার ছিল সেটা আপনি জানেনা।
যে ইংরেজরা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় ব্যাপক উন্নতি সাধন করে এক সময় প্রায় পুরো বিশ্ব শাসন করেছে, তাদেরই দেশে এক সময় চালু ছিল স্ত্রী বিক্রির মতো অসভ্য প্রথা। অদ্ভুত শোনালেও উনবিংশ শতাব্দীর মধ্য ভাগেও ইংল্যান্ডে এই প্রথা চালু ছিল। ইউরোপের ইতিহাস অন্তত তাই বলে।
বউ বিক্রির প্রথা
‘অক্সফোর্ড ডিকশনারি অব ন্যাশনাল বায়োগ্রাফি’ থেকে জানা যায়, ১৭৮০ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে ইংল্যান্ডে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদপত্রে স্ত্রী বিক্রির অনেক ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। তৎকালীন নথিপত্র থেকে জানা যায়, স্বামীর কাছে স্ত্রীকে বিয়ের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি দিতে তালাকের চেয়ে অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে দেওয়াটা সহজ ছিল।
আর স্ত্রী বিক্রির ঘটনা সর্ব প্রথম ঘটে ১৭৩৩ সালে। রেকর্ডকৃত নজিরটি এসেছে বিলস্টন নামের একটি ছোট্ট গ্রাম থেকে, যেটি ওলভারহ্যাম্পটন ও বার্মিংহামের খুব কাছেই। স্যামুয়েল হোয়াইটহাউজ নামের এক ব্যক্তি তার স্ত্রী ম্যারি হোয়াইটহাউজকে থমাস গ্রিফিথ নামের এক ব্যক্তির কাছে এক পাউন্ডে বিক্রি করেন।
১৭৯০ এর দশকের মধ্যে প্রথাটি এতটাই ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল যে, এটি সেই সময়ের একটি আলোচিত বিষয় ছিল। স্বামীরা বিক্রির জন্য স্ত্রীর গলায়, বাহু বা কোমরে বেঁধে নিয়ে আসত। এরপর বাজারে নিয়ে প্রকাশ্যেই তাকে নিলামে উঠাতেন এবং সর্বোচ্চ দরদাতার হাতে স্ত্রীকে তুলে দিতেন। স্ত্রী বিক্রির এ আজব প্রথা ২০ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত ইংল্যান্ডে চালু ছিল।
বউ বিক্রির প্রথা
আইনবিদ ও ইতিহাসবিদ জেমস ব্রাইসের মতে, ১৯০১ সালেও স্ত্রী বিক্রির ঘটনা নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। ইংল্যান্ডে স্ত্রী বিক্রির সর্বশেষ প্রতিবেদনের একটি হিসাবে, ১৯১৩ রহসালে লিডস (পশ্চিম ইয়র্কশায়ারের শহর) পুলিশ আদালতে একজন নারী দাবি করেন, তার স্বামী তাকে এক সহকর্মীর কাছে এক ডলারে বিক্রি করেছেন।
তবে জেমস ব্রাইসের মতে ‘স্ত্রী বিক্রয়’ প্রচলিত আইনে ছিল না। যেসব স্বামী-স্ত্রীর মাঝে খারাপ সম্পর্ক চলছিল কিংবা স্ত্রীর সঙ্গে তার প্রেমিকের প্রেমের সম্পর্ক ছিল সেক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিতে অসামর্থ্য হলে বিক্রি করে দিতো। ফলে বিয়ে তালাকের প্রতিকার হিসেবে গরীবদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই প্রথা।
প্রথমদিকে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ তেমন কোন দৃষ্টি দিতো না। ফলে এই প্রথাটি আরো বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তবে এক পর্যায়ে এসে আদালত কর্তৃক হস্তক্ষেপের ফলে ক্রমশ এটি বন্ধ হয়ে যায় এবং যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদেরকে কারাগারে প্রেরণের আইন চালু হয়। স্ত্রী বিক্রির কয়েকটি মামলা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯ শতকের মধ্যভাগের শেষদিকে গ্রামীণ অঞ্চলে এই প্রথা চালু ছিল।
বউ বিক্রির প্রথা
কেন এমন প্রথা চালু হয়েছিল এমন প্রশ্নের উত্তরে ইতিহাসবিদ জেমস ব্রাইস বলেন, ১৮৫৭ এর আগে ইংল্যান্ডে আদালতে হাজির হয়ে স্ত্রী তালাক দেওয়া একটি কঠিন এবং ব্যয়বহুল কাজ ছিল। বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আইনত মামলা দায়ের এবং প্রায় ৩০০ ডলার খরচ করতে হতো, যা এখন প্রায় ১৫ হাজার ডলার এর মতো। মূলত, এই বিপুল পরিমাণ অর্থের খরচ বাঁচাতে সাধারণ ইংরেজদের অনেকে স্ত্রীদের সরাসরি ডিভোর্স না দিয়ে বিক্রি করে দেওয়ার প্রথা চালু করে। ইংল্যান্ডের দরিদ্র অঞ্চলগুলোতে নারীদের অনেকটা ক্রয়-বিক্রয়যোগ্য সম্পত্তির মতোই বিবেচনা করা হতো।
স্ত্রীদের রাখতে ইচ্ছুক নয় এমন স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের বাজারে নিয়ে নিলাম ডাকা শুরু করত। অনেক ক্ষেত্রে পত্রিকায় স্ত্রী বিক্রয়ের ঘোষণাও দেওয়া হতো। জানা যায়, অনেক নারী দাম্পত্য জীবনের অশান্তি দূর করতে নিজের ইচ্ছেতেই বিক্রি হতে রাজি হতেন। কম খরচে বিবাহিত জীবনের সমাপ্তি ঘটানোর জন্য আর কোনো বিকল্প পথ ছিল না। আইনগতভাবে প্রথাটি তখন অবৈধ হলেও কর্তৃপক্ষ বিষয়টির দিকে খুব বেশি নজর দিত না।
১৮২০ ও ১৮৩০-এর দশকে এই প্রথার চর্চা বেড়ে যেতে থাকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সমাজে এর প্রতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এরপর ১৮৫৫ সালে কটসওল্ড নামক এক ব্যক্তি তার সদ্যবিবাহিত স্ত্রীকে ২৫ হাজার ডলারে বিক্রি করেন। যদিও ঐ সময়ে স্ত্রী বিক্রির প্রথাকে মানুষজন সম্মানজনক বলে বিবেচেনা করতেন না। তারপরও কটসওল্ড তার নতুন স্ত্রীকে তিন রাতের জন্য ক্রেতার কাছে বিক্রি করেন। সেই ক্রেতা নতুন কনেকে দিয়ে যৌনাচারসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজ করান, যা সেই সময়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ছিল।
ফলে স্বামী তৃতীয় রাতে ক্রেতার বাড়ির বাইরে খাদ্য শস্যের স্তুপে আগুন লাগিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত ক্রেতা নতুন বউকে তার স্বামীর কাছে টাকার বিনিময়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এই ঘটনার পরই বিষয়টি নিয়ে কঠোর অবস্থানে যায় আদালত। অবশেষে ১৮৫৭ সালে ইংল্যান্ডে ডিভোর্স করার আইন শিথিল করা হয়।
তবে এর পরেও স্ত্রী বিক্রয়ের ঘটনা একবারে থেমে থাকেনি। তবে ‘অফিস অব ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্স’ অনুসারে, ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের বিপরীত লিঙ্গের দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদের হার ১৯৭৩ সালের পর থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। এখন ইংরেজদের মধ্যে স্ত্রীকে তালাক দেওয়া কিংবা বিবাহ ভেঙ্গে যাওয়ার বিষয়টিও কমে এসেছে। ফলে স্ত্রী বিক্রির প্রথাটিও বিলুপ্ত হয়ে গেছে।